বিনায়ক রাও সেদিনের স্মরণে একটুখানি শ্বাস ফেলে বললেন– বৃদ্ধকে আমি বলব কী– স্পষ্ট দেখতে পেলুম, সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে যেন কাফেলা থেকে সে বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ে। এই যে আমি তার তুলনায় শক্তিশালী, আমারই থেকে থেকে মনে সন্দেহ হচ্ছিল, আমিই কি পৌঁছতে পারব গন্তব্যস্থলে? তখন হৃদয়ঙ্গম করলুম, এখানে এ-সংকট থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য শারীরিক বলের প্রয়োজন আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন মানসিক বলের। এবং এ বৃদ্ধের সেটা যেন আর নেই। তীর্থদর্শন হয়ে যাওয়ার পর ফেরার মুখে অনেকেই সেটা হারিয়ে ফেলে– কারণ তখন তো সামনের দিকে আর কোনও উদ্দেশ্য নেই, আর কোনও চরম কাম্য বস্তু নেই। ফিরে তো যেতে হবে আবার সেই সংসারে, তার দিনযাপনের প্রাণ-ধারণের গ্লানির ভিতর।
আমার মনে হচ্ছিল আমি নিজে যেন সন্তরণে অক্ষম, আরেক সন্তরণে অক্ষম জনকে সাহায্য করার নিষ্ফল প্রচেষ্টা করছি। তবু বললুম, আরেকটুখানি পরেই উত্রাই। চলুন। এই সামান্য কটি শব্দ বলতে গিয়েই যেন আমার দম বন্ধ হয়ে এল।
বুড়ো আমার দিকে তার ঘোলাটে চোখ তুলে তাকিয়ে হঠাৎ কী যেন দেখতে পেল। অতি কষ্টে ধীরে ধীরে বলল, বাবু, তোমার বোতল থেকে একটু শরাব।
বিনায়ক রাও বললেন, আমি জীবনে কখনও শরাব স্পর্শ করিনি; আমার বুকের পকেটে ছিল চ্যাপ্টা বোতলে জল।
কোনও গতিকে বললুম, জল। বুড়ো বিশ্বাস করে না। কাতর নয়নে তাকায়।
আস্তে অতি আস্তে বুড়ো এগোচ্ছে ওই শরাবের আশায়।
এইভাবে খানিকক্ষণ চলল। হঠাৎ বুঝি বুড়ো লক্ষ করেছে কাফেলা একেবারেই অন্তর্ধান করেছে। কাঁপতে কাঁপতে বুড়ো বলল, জিরো। আমি শুষ্ককণ্ঠে যতখানি পারি চেঁচিয়ে বললুম, না না! আমি জানি এ জিরোনোর অর্থ কী। এই বসে পড়ার অর্থ, সে আর উঠে দাঁড়াবে না। তার মনে হবে এই তো পরমা শান্তি আরাম, আরাম। আর শেষ নিদ্রায় ঢলে পড়বে।
বুড়ো তার শেষ ক-টি কথা বলল যার অর্থ, এক ঢোক শরাব পেলে সে হয়তো সংকট পেরুতে পারবে। আমার দিকে হাত বাড়াল। আমি আর কী করি? দিলুম বোতল। সে টলতে টলতে বসে পড়ল। এ কী সর্বনাশ! তার পর বোতল মুখে দিয়ে যখন দেখল সত্যি জল, তখন আমার দিকে শেষবারের মতো তাকিয়ে কাৎ হয়ে শুয়ে পড়ল।
এই শরাবের আশাতেই সে এতক্ষণ আমার সঙ্গে সঙ্গে কোনও গতিকে এসেছে। এবারে শেষ আশা বিলীন হতে সে ঢলে পড়ল।
***
চলেছি তো চলেছি। কতক্ষণ চলার পর উত্রাই আরম্ভ হয়েছিল, কখন যে উপত্যকায় নেমেছি সেগুলো আমার চৈতন্যসত্তা যেন গ্রহণ করেনি।
সম্বিতে এলুম হঠাৎ বরফপাতের সঙ্গে সঙ্গে। অতি হালকা চাদরের মতো কী যেন নেমে এল। তবু সম্মুখপানে খানিকটা দেখা যায়। ঈষৎ দ্রুততর গতিতে চলতে আরম্ভ করলুম। কয়েক মিনিট পরেই বরফপাত থেমে গেল। আমি স্বস্তির নিশ্বাস ফেললুম। তার পর সামনের দিকে তাকিয়ে ভয়ে আতঙ্কে আমি হৃদয়ঙ্গম করলুম, একটুখানি বেশি আগেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বসেছি।
সামনে উপত্যকা, এবং এইমাত্র যে বরফপাত হয়ে গেল তারই কল্যাণে মুছে গেছে কাফেলার পদচিহ্ন। এবং সংকটটাকে যেন তার বীভৎসতম রূপ দেবার জন্য সামনে, ধীরে ধীরে, নেমে আসছে কুয়াশার জাল দিনের আলো ম্লান হয়ে গেছে।
তারই ভিতর দিয়ে লক্ষ করলুম, আরেকটু সামনে একটা পাথরের টিলা। সেখানে পৌঁছে আমাকে যেতে হবে হয় বাঁয়ে নয় ডাইনে। কিন্তু মনস্থির করি কী প্রকারে? বরফের উপর যে কোনও চিহ্নই নেই। তবু আমার মনে যেটুকু দিক্-বিদিক জ্ঞান ছিল সেটা পরিষ্কার বললে, যেতে হবে বাঁ দিকে।
এমন সময় হঠাৎ কুয়াশার ভিতর যেন একটু ছিদ্র হল, এবং তার ভিতর দিয়ে এক মুহূর্তের তরে, যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল, দেখি একটা কুকুরের ইঞ্চিতিনেক লেজ, বো করে ডান দিকে মোড় নিল, কুকুরটাকে কিন্তু দেখতে পেলুম না।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, কুকুর! কোথাকার কুকুর? কুকুরের কথা তো এতক্ষণ কিছু বলনি!
ও। সত্যি ভুলে গিয়েছিলুম। ওই কুকুরটা থাকত একটা চট্টিতে। আমরা সে চড়িতে, বৃষ্টির জন্য আটকা পড়ে, দিন তিনেক ছিলুম। ওই সময় আমি ওটাকে সামান্য এটা-সেটা দিয়েছি। সে চট্টি ছাড়ার খানিকক্ষণ পরে দেখি, তিনি আমার পিছু নিয়েছেন। বিস্তর হাই-হুই করে পাথর ছুঁড়েও তাকে চট্টিতে ফেরত পাঠাতে পারলুম না।
আমি বললুম, এই তো সেই জায়গা যেখানে যুধিষ্ঠিরের সারমেয় তাঁকে ত্যাগ করতে চায়নি।
মসোজি বললেন, এসব কেন, কোনও কুকুরেরই লেজ কাটা উচিত নয়; তবু কে যেন বেচারির বাচ্চা বয়সে তার লেজ কেটে দিয়েছিল। আমি দেখতে পেলুম সেই টুকরোটুকু, যেটুকু অবশিষ্ট ছিল। এবং সেটা মোড় নিল ডানদিকে।
আমার অভিজ্ঞতা, আমার পর্যবেক্ষণ, আমার বিচারশক্তি সব-সব আমাকে চিৎকার করে বলছিল, বাঁ দিকে বাঁ দিকে মোড় নাও আর অতি স্পষ্ট যদিও অতিশয় ক্ষণতরে আমি দেখলুম, কুকুরটার লেজ মোড় নিল ডান দিকে।
আমি নিজের বুদ্ধিবৃত্তির চেয়ে কুকুরটার লেজকেই বিশ্বাস করলুম বেশি।
কুকুরটাকে কিন্তু তখনকার মতো আর দেখতে পেলুম না।
ঘণ্টাটাক পরে চডিতে পৌঁছলুম। হাসেগাওয়া বললেন, আমি বুড়োর জন্য অপেক্ষা করার পর থেকেই কুকুরটা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছিল। শেষটায় সে অদৃশ্য হয়ে যায়।
আমি শুধালুম, আর বাঁ দিকে মোড় নিলে কী হত? প্রশ্নটা জিগ্যেস করেই বুঝলুম আমি একটা ইডিয়ট।