বিনায়ক রাও বললেন, পঙ্গুও ঈশ্বরপ্রসাদাৎ গিরি লঙ্ন করে– এটা মানসে পৌঁছে জন্মের মতো উপলব্ধি করলুম। হাসেগাওয়ার দর্শনই ঠিক পঙ্গু বাধ্য হয়েই এগোয় অতি ধীরে-মন্থরে, তাই শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যায় মানসসরোবরে। পঙ্গুর কাছে যা বিধিদত্ত, সুস্থ মানুষকে সেটা শিখতে হয় পরিশ্রম করে। *
[* চেকোশ্লোভাকিয়ার পাহাড়-পর্বত হিমালয়ের তুলনায় নগণ্য। সেখানে পাহাড় চড়তে গিয়ে শ্রীযুক্ত মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের যে অভিজ্ঞতা হয় সেটি এস্থলে তুলে দেবার লোভ সম্বরণ করতে পারলুম না।
মিরেক (একজন পাহাড়-বন-বিভাগের চৌকিদারকে) শুধোল, আচ্ছা, আপনি এত আস্তে চলছেন কেন?
প্রশ্ন শুনে চৌকিদার হো হো করে খুব খানিকটা হেসে নিলেন। তার পর বললেন- শুনুন। বহু বছর, চল্লিশেরও উপর, বনের পথে, পাহাড়ে রাস্তায় নানান গতিতে হেঁটেছি। কখনও জোরে কখনও ধীরে। আপনাদের মতো আগে হাঁটতুম, আরও জোরে হাঁটতুম। লাফিয়ে ঝাফিয়ে পাহাড়ে উঠে তার পর হাঁপাতুম। হাত-পা ছড়িয়ে ঘাসের উপর শুয়ে জিরিয়ে নিতুম, তারপর আবার চলতুম। কাজের তাগিদে কখনও সারাদিন হাঁটতে হয়েছে, কখনও সারারাত। কিন্তু এই যে এখনকার আমার চলার গতি দেখছেন, এ হচ্ছে বহুদিনের বহু সাধনার পর আবিষ্কৃত। এ গতিতে চললে কখনও ক্লান্তি আসবে না শরীরে। যত দূর-দূরান্তরে বনান্তরে যান না কেন, যাত্রার শুরুতে যেমন শরীর তাজা তেমনিই থাকবে। চরণিক, প্রথম (বেঙ্গল) সংস্করণ, পৃ. ১১৩/১৪।]
বিনায়ক রাও ভেবে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, সরোবরে স্নান করেছিলুম। আমার জীবনের মহামূল্যবান অভিজ্ঞতার ভিতর এটা আমার চিরকাল মনে থাকবে।
সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে গেল না? পুণ্যস্নান তো বটে।
বিনায়ক রাও শিউরে উঠলেন, বাপরে বাপ! জলে দিয়েছি ঝাঁপ আর সঙ্গে সঙ্গে মেরেছি পারের দিকে লাফ। সেদিন আকাশ ছিল পরিষ্কার। দ্বিপ্রহরের সেই উগ্র রৌদ্রে আমি ঘণ্টাদুয়েক ছুটোছুটি করেছিলুম শরীরটাকে গরম করার জন্যে। ছুটেছি পাগলের মতো দু-হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পা-দুটো ছুঁড়ে ছুঁড়ে আছাড় মেরে মেরে। তার পর ক্লান্ত হয়ে থামতে বাধ্য হয়েছি। ফাঁসির লাশের মতো জিভ বেরিয়ে গিয়েছে হাঁপাতে হাঁপাতে। ফের ছুটতে হয়েছে গা গরম করার জন্য। গা আর কিছুতেই গরম হয় না। সে কী যন্ত্রণাভোগ!
আমি বললুম, শুনেছি, গত যুদ্ধে যেসব অ্যার পাইলট শীতকালে ইংলিশ-চ্যানেলের জলে পড়েছে, তাদের কেউই কুড়ি মিনিটের বেশি বাঁচেনি।
বিনায়ক রাও বললেন, লোকে বলে, অগ্নিপরীক্ষা? আমি বলি শীতের পরীক্ষা।
হ্যাঁ, আফ্রিকাবাসীরাও বলে– Heat hurts, cold kills.
বিনায়ক রাও বললেন, হাসেগাওয়া প্রাণভরে ছবি তুললেন। তার পর প্রত্যাবর্তন। অন্য পথ দিয়ে।
চলেছি তো চলেছি; তার পর এল আমাদের কঠিনতম সংকট। আমাদের একটা গিরিসংকট পেরুতে হবে। এবং এটা পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ গিরিসংকট। সমুদ্রতট থেকে বারো হাজার ফুট উঁচুতে না বাইশ হাজার আমার মনে নেই। এবং একটুখানি যাওয়ার পরই আরম্ভ হয় চড়াইয়ের পর চড়াই। ক্যারাভানের এক ব্যবসায়ী আমাকে বলেছিল, যেসব তীর্থযাত্রী মারা যায়, তাদের অধিকাংশই মরে এইখানে।
ক্রমেই বাতাসের অক্সিজেন কমে আসছিল। অতিকষ্টে আমরা ধীরে ধীরে এগুচ্ছি। এমন সময় চোখে পড়ল একটা লোক অকাতরে ঘুমুচ্ছে পথের একপাশে। কাছে এসে বুঝলুম, মৃতদেহ! এবং সম্পূর্ণ অবিকৃত মৃতদেহ। এ বছরে মরেছে, না গেল বছরে বুঝতে পারলুম না। কারণ, আমি শুনেছিলুম, উপরে-নিচে বরফ থাকে বলে মড়া পচে না।
এর পর আরও কয়েকটা। আমি মাত্র একবার একজনের মুখের দিকে তাকিয়েছিলুম, আহা! সে কী শান্ত, প্রশান্ত, নিশ্চিন্ত মুখচ্ছবি। মায়ের কোলে ঘুমিয়ে-পড়া শিশুর মুখেও আমি এরকম আনন্দভরা আত্মসমর্পণের ছবি দেখিনি।
ইতোমধ্যে আমার দৃষ্টি গেল অন্যদিকে। দেখি, আমাদের দলের একজন বৃদ্ধ তীর্থযাত্রী অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছে। কারও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ পর্যন্ত নেই। আমি জানতুম, এবং হাসেগাওয়াও আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এখানে বলবান যুবা পুত্রও হাত বাড়িয়ে মাতাকে পর্যন্ত সাহায্য করতে পারে না। কারও শরীরে একবিন্দু উদ্বৃত্ত শক্তি নেই যে, সে সেটা অন্যের উপকারে লাগাবে। সামান্য দুটি কথা বলে যে সাহস দেবে সে শক্তিও তখন মানুষের থাকে না। আমার মনে হল, হালকা একটি পালক দিয়েও যদি কেউ আমাকে ঠোনা দেয় আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাব।
আমি খুব ভালো করেই জানতুম, কাফেলা কারও জন্য অপেক্ষা করে না, করলে সমস্ত কাফেলা মরবে। আমাদের যে করেই হোক সন্ধ্যা নাগাদ সামনের আশ্রয়স্থলে পৌঁছুতে হবে।
এমনিতেই আমাদের প্রত্যেকেরই ছিল শম্বুকগতি। আমি সেটাও কমিয়ে দিলুম ওই বৃদ্ধকে সঙ্গ দিতে। হাসেগাওয়া বুঝতে পেরেছে। আমার দিকে রহস্যভরা নয়নে সে তাকাল। আমি ইঙ্গিতে জানালুম, সে যেন তার গতি শ্লথ না করে।
এস্থলে আমি সামান্য একটি তথ্যের উল্লেখ না করলে কর্তব্যবিচ্যুতি হবে।
বিনায়ক রাওয়ের মতো পরদুঃখকাতর মানুষ আমি এ জীবনে কমই দেখেছি, এবং একেবারেই দেখিনি পরোপকার গোপন রাখতে তাঁর মতো কৃতসংকল্পজন। প্রভু যিশুর আদেশ, তোমার বাঁ হাত যেন না জানতে পারে তোমার ডান হাত কী দান করল। এরকম অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে আমি কোনও খ্রিস্টান অখ্রিস্টান– কাউকে দেখিনি। কাফেলার বৃদ্ধের প্রতি তাঁর দরদ গোপন রাখতে পারলে তিনি নিশ্চয়ই তাই করতেন– এ সত্য আমি কুরান স্পর্শ করে বলতে রাজি আছি। কিন্তু এটা গোপন রাখলে তাঁর মূল বক্তব্য একেবারেই বিকলাঙ্গ হয়ে যেত বলে তিনি যতটা নিতান্তই না বললে নয়, সেইটুকুই বলেছিলেন।