বিনায়ক রাও বললেন, ক্রমে ক্রমে আমরা লক্ষ করলুম, পাহাড় থেকে নেমে আসছে সবাই, উপরের দিকে যাচ্ছে না কেউই। চটির পর চটি দেখি হয় জনমানবহীন দরজা খা-খা করছে কিংবা তালাবন্ধ– সমস্ত শীতকাল এখানে তো আর কেউ আসবে না।
আমরা চড়াইয়ের দিকে শেষ কাফেলাও মিস করেছি।
কিন্তু হাসেগাওয়ার ওই একটি মহৎ সদণ্ডণ যে, কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অত্যন্ত প্রয়োজন না হওয়ার পূর্বে তিনি ওই নিয়ে মাথা ঘামান না।
আমরা যতই উপরের দিকে উঠছি, ততই রাস্তা এবং চট্ট জনবিরল হতে লাগল। শেষটায় আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা চলার পরও কাউকে নেমে আসতে দেখি না— ওঠার তো প্রশ্নই ওঠে না। তখন দেখি এক পরিত্যক্ত চট্টর সামনে একজন সাধু বসে আছেন। সন্ধ্যা হয়-হয়। মোক্ষম শীত পড়েছে কিন্তু সাধুজি কৌপিনসার। সর্বাঙ্গে ভস্মও মাখেননি কিংবা অন্য কোনও ব্যবস্থারও প্রয়োজনবোধ করেননি। অথচ দেহটির দিকে তাকালে মনে হয়, এইমাত্র প্রচুর তেল ডলাইমলাই করে স্নান সেরে উঠেছেন– গা বেয়ে যেন তখনও তেল ঝরছে। আমাদের সঙ্গে চাপাতি ও শুকনো তরকারি ছিল। সাধুজিকে তার থেকে হিস্যে দিলুম। তিনি কোনওপ্রকারের বাক্যালাপ না করে খেলেন। আমরাও কোনও প্রশ্ন শুধালুম না। পরের দিন ভোরবেলা দেখি, তিনি তখনও সেখানে ঠায় বসে। আমরা তাঁকে প্রণাম করে রাস্তায় নামবার সময় মনে হল এই যেন সর্বপ্রথম তার চোখে ভাবের পরিবর্তন দেখা গেল– সে পরিবর্তনে যেন আমাদের প্রতি আশীর্বাদ রয়েছে। রাস্তায় নামার পর হাসেগাওয়া বলল, আমার দুশ্চিন্তা গেছে। আমাদের যখন উনি চড়াইয়ের পথে যেতে বারণ করলেন না, তখন মনে হচ্ছে, আমাদের যাত্রা সফল হবে।
হিমালয়ের অন্যতম এই রহস্যের সমাধান এখনও হয়নি। এইসব একাধিক সন্ন্যাসী সমস্ত শীতকালটা এসব জায়গায় কাটান কী করে? পাঁচ-সাত হাত বরফ এখানে তো জমেই– সেখানে না আগুন, না কোনওপ্রকারের খাদ্য। এক চট্টিওলা আমাকে পরে বলেছিল, বরফের তলায় নাকি একরকমের লতা গজায়। তারই রস নাকি এদের খাদ্য, বস্ত্র, আগুন– সব।
আর হাসেগাওয়া তুলে যাচ্ছে, একটার পর একটা ছবি। এই গিরি অভিযানে বেরুবার তার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য– যত পারে, যতরকমের হয়, ফটোগ্রাফ তোলা। দাঁড়ান, আপনাকে বইখানা দেখাই।
বিনায়ক রাও নিয়ে এলেন ঢাউস এক ফটোগ্রাফের বই। মলাটের উপরকার ছবি দেখেই আমার বুঝতে বাকি রইল না যে, এই বই জাপানি। জর্মনরাও বোধহয় এরকম প্রিন্ট করতে পারে না। কে বলবে এগুলো ব্লক থেকে তৈরি! মনে হয় কন্টাক্ট প্রিন্ট!
বিনায়ক রাও বললেন, জাপানে ফিরে গিয়ে হাসেগাওয়া তার তোলা ছবির একটি প্রদর্শনী দেখান। সে-দেশের রসিক-বেরসিক সর্বসম্মতিক্রমে এই সঞ্চয়ন ফটোগ্রাফির প্রথম বিশেষ পুরস্কার পায়।
ছবি বোঝাবার জন্য এ-বইয়ে টেক্সট অত্যল্প। আমার বড় বাসনা ছিল বইখানা যেন ভারতের বাজারেও জাপানিরা ছাড়ে। কিন্তু ঠিক তখনই মার্কিন হিরোশিমার উপর এটম বোমা ফেলছে। পরবর্তীকালে আমি আবার কঁহা কঁহা মুলুকে চলে গেলুম।
এ-বইখানা আনাতে কিন্তু আমার অসুবিধা সৃষ্ট হল। বিনায়ক রাও বই আনার পর আর বর্ণনা দেন না। শুধু বলেন, এর পর আমরা এখানে এলুম বলে দেখান একটা ফটো, ফের দেখান আরেকটা অনবদ্য ছবি। কিন্তু এখন আমি সেসব ছবির সাহায্য বিনা তাদের যাত্রাপথের গাম্ভীর্য, মাধুর্য, বিস্ময়, সংকট, চিত্র-বৰ্ণন করি কী প্রকারে! পাঠক, তুমি নিরাশ হলে আমি নিরুপায়।
বিনায়ক রাও, হাসেগাওয়া তোমার ও আমার পরম সৌভাগ্য যে, ওঁরা দুজনা পথিমধ্যে একটি কাফেলা পেয়ে গেলেন এবং অবিশ্বাস্য, সেটা যাচ্ছে উপরের দিকে। এদের ভিতর আছে তীর্থযাত্রী ও অল্পবিত্ত ব্যবসায়ী। এই শেষ কাফেলা। নানা কারণে এদের বড় বেশি দেরি হয়ে গিয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের মনে শঙ্কা, বরফ-নামার পূর্বে এঁরা পাহাড় থেকে নামতে পারবেন কি না। তীর্থযাত্রীদের মনে কিন্তু কোনওপ্রকারের দুশ্চিন্তা নেই। এ ধরনের তীর্থদর্শনে যারা বেরোয়, তারা ঘরবাড়ির মোহ, প্রাণের মায়া সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েই সম্মুখপানে পা ফেলে। পথিমধ্যে মৃত্যু, মানসে মৃত্যু, গৃহ-প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত যেখানেই মৃত্যু হোক না কেন, তারা আশ্রয় পাবেন ধূর্জটির নিবিড় জটার মাঝখানে– যে-জটা হিমালয়ের চূড়ায় সৃষ্টির প্রথম প্রভাত থেকে চিরজাজ্বল্যমান।
আর কাফেলার ওইসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করলে মনে হয়, কী বিচিত্র দ্বন্দ্বময় পরস্পরবিরোধী কার্যকলাপ এদের জীবনে। যে প্রাণরক্ষার জন্য এরা দুটি মুঠি অন্ন উপার্জন করতে এসেছে এখানে, সেই প্রাণ তারা রিস্ক করছে প্রতিদিন, প্রতি বৎসর। হুবহু সার্কাসের স্টান্ট খেলাড়িদের মতো প্রাণধারণের জন্য যারা প্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলে প্রতি সন্ধ্যায়!
তা সে যাক্। এ লেখাটি এখন সংক্ষিপ্ত করি। কারণ, হিমালয়ের বর্ণনাই যখন দিতে পারছিনে, তখন হিমালয় নিয়ে কাহিনী বলা শিবহীন দক্ষযজ্ঞ এবং যদ্যপি হিন্দু পুরাণের সঙ্গে পরিচয় আমার ঘনিষ্ঠ নয়, তবু এটুকু জানি, সে প্রলয়কাণ্ড ঘটেছিল এই হিমালয়েই– দক্ষালয়ে।
আমি অরসিক। হঠাৎ শুধালুম, বিনায়ক রাও! তোমরা খেতে কী?
শেষের দিকে পথে যেতে যেতে– পথ বললুম বটে কিন্তু আমি আপনারা পথ বলতে যেটা বোঝেন, সেটাকে অপমান করতে চাইনে– আমার শ্যেনদৃষ্টি থাকত কিসের ওপর জানেন? শকুনি, শকুনি– আমি তখন সাক্ষাৎ শকুনি। শকুনি যেমন নির্মল নীলাকাশে ওড়ার সময়ও তাকিয়ে থাকে নিচে ভাগাড়ের দিকে, আমিও তাকিয়ে থাকতুম নিচের দিকে। কোথাও যদি ভারবাহী য়া পশুর এক চাবড়া গোবর পেয়ে যাই। সে-ঘুঁটেতে আগুন ধরিয়ে ধুয়োর ভিতর নাড়াচাড়া করি, চেপে ধরি, দু হাত দিয়ে চড়চাপড় মেরে তৈরি করা এবড়ো-থেবড়ো রুটি– গুজরাতিতে যাকে বলে রোটলা, কাবুলি নানের চেয়েও তিন ডবল পুরু। কিন্তু সেই উঁশা রুটিই মনে হত সাক্ষাৎ অমৃত– ওলড টেস্টামেন্টের বিধিদত্ত মান্না, যার স্বাদ আজও ইহুদিকুল ভুলতে পারেনি।