আমার আজ মনে নেই, কোন এক সীমান্তে গিয়ে ওই পুণ্যসরোবরে যাবার জন্য পারমিট নিতে হয়। বিনায়ক রাও আমাকে বললেন, সব সরকারই বিদেশিদের ডরায়, ভাবে ওরা গুপ্তচর, কী মতলব নিয়ে এসেছে, কে জানে। ওসব জায়গায় তো যায় মাত্র দু ধরনের লোক। তীর্থযাত্রী, আর যেটুকু সামান্য ব্যবসা-বাণিজ্য আছে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারবারি লোক– ওরা যায় ক্যারাভান বা কাফেলার দল বানিয়ে। আমি খ্রিস্টান, হাসেগাওয়া বৌদ্ধ; মানসসরোবর আমাদের কারওরই তীর্থ হতে পারে না। তবু ফর্মে লিখে দিলুম তীর্থযাত্রী, নইলে পারমিট অসম্ভব। হাসেগাওয়া বললেন, আমরা গা-ঢাকা দিয়ে রইব, যতদিন না পারমিট পাই, পাছে আমাদের স্বরূপ না ধরা পড়ে। ইতোমধ্যে তোমাকে মাউন্টেনিয়ারিং বা পাহাড় চড়ার আর্টে তালিম দেব। বিনায়ক রাও বললেন, আমি তো মনে মনে হাসলুম। হাসেগাওয়ার তুলনায় আমি তো রীতিমতো পায়লওয়ান। আমি পাহাড় চড়ি চড় চড় করে– ও আবার আমায় শেখাবে কী? কিন্তু ভুল ভাঙল প্রথমদিনই। পাশেই ছিল একটা ছোটখাটো পাহাড়। সেইটে দিয়েই হল আমার প্র্যাকটিস শুরু। হাসেগাওয়া আমাকে পই পই করে বার বার বললেন, কনে-বউটির মতো চলি চলি পা পা করে ওঠো, নইলে আখেরে পস্তাবে। আমি মনে মনে বললুম, দুত্তোর তোর পা পা। চড় চড় চড় করে উঠতে লাগলুম চড়াই বেয়ে বাঘের শব্দ পেলে বাঁদর যে-ধরনে সোদরবনে সুন্দরী গাছ চড়ে। উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু মশাই, ঘণ্টাদুই পরে দেখি অবস্থা সঙ্গিন। আর যে এক কদমও পা চলে না। ভিরমি যাবার উপক্রম। সম্পূর্ণ অনিচ্ছায় আমি বসে পড়লুম একটা পাথরের উপর। ঘন্টাটাক পরে হাসেগাওয়া আমাকে পাস্ করলেন, আমার দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হেসে। তিনি চূড়ায় উঠলেন। আমি বসে বসে দেখলুম। নেমে এলেন। বিশ্বাস করবেন না, সৈয়দসাহেব, আমার আত্মাভিমানে লাগল জোর চোট।
আমি বললুম, দাক্ষিণাত্যের তিরু আন্নামলাইয়ের রমণ মহর্ষির নাম শুনেছ নিশ্চয়ই। তিনি অরুণাচল পাহাড়ের উপর কাটান চল্লিশ না পঞ্চাশ বছর কিংবা ততোধিক। পাহাড়টা কিছু মারাত্মক উঁচু নয় কিন্তু ঝড়ে-বাদলায়, গরমে-ঠাণ্ডায়, কখনও-বা অত্যন্ত অসুস্থ দুর্বল শরীর নিয়ে তাঁকে দিনে অন্তত একবার করে ওঠানামা করতে হত। এক পুণ্যশীলা গ্রামের মেয়ে তার জন্য প্রতিদিন খাবার নিয়ে আসত পাহাড়ের তলায়, যেখানে আজকের দিনের আশ্রম। তিনিও আমাদের ওই চলি চলি পা পা-র উপদেশ দিয়েছেন, খুব ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে। তার পর বল।
বিনায়ক রাও বললেন, পরদিন আরেকটা পাহাড়ে চেষ্টা দিলুম। সব জেনেশুনেও আমার কিন্তু ওই কনে-চাল কিছুতেই রপ্ত হচ্ছিল না। আর হাসেগাওয়া প্রতিদিন আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে পাস্ করতেন ও জিততেন লজ্জাকর মার্জিন রেখে।
আমরা দিনের পর দিন প্রহর গুনছি–পারমিট আর আসে না, ওদিকে আমরা জনমানবহীন পাহাড়গুলো চড়ছি আর ভাবছি, আত্মগোপন করেছি উত্তমরূপেই। কিন্তু ইতোমধ্যে সিজন যে বেশ এগিয়ে গিয়েছে, আর বেশি দেরি হলে তো বরফ পড়তে আরম্ভ করবে।
শেষটায় এক বড়কর্তার কাছে ডাক পড়ল। তার প্রাসাদে উঠে দেখি, ইয়া আল্লা। তার সেই উঁচু টিলার স্ট্যান্ডের উপর খাড়া জোরদার টেলিস্কোপ। আমরা যখন অস্ট্রিচ পাখির মতো বালুতে মাথা গুঁজে আত্মগোপনের আত্মপ্রসাদ অনুভব করছি, ইনি তখন প্রতিদিন নির্ঝঞ্ঝাটে আমাদের প্রতিটি পাহাড় ওঠা পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং কৌতূহলী হয়ে আমাদের সম্বন্ধে সর্বসংবাদ সংগ্রহ করেছেন। বেশ রসিয়ে রসিয়ে আদ্যোপান্ত বললেন। আমাদের মুখ শুকিয়ে গেল– ইস্তেক যে-জাপানি বদন অনুভূতি প্রকাশে সম্পূর্ণ অনভ্যস্ত ও অনিচ্ছুক সেটিও কিঞ্চিৎ বিকৃত হল।
কিন্তু বৃথাই আতঙ্ক; আমরা খামোখাই ঘামের ফোঁটায় কুমির দেখছিলুম। আমাদের অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন। বড়কর্তা সর্বসংবাদ শুনে আমাদের অভিযানাকাঙ্ক্ষা প্রসন্নতর দৃষ্টিতে আশীর্বাদ করেছেন। কারণ, আমরা ধর্ম বা অর্থ কোনওটাই সঞ্চয় করতে যাচ্ছি না– আমরা আসলে তীর্থযাত্রী নই, আর ব্যবসায়ী তো নই-ই। তবে তখনও জানতুম না, আরেকটু হলেই অনিচ্ছায়, অন্তত আমার, মোক্ষ লাভটা হয়ে যেত।
অমি বললুম, ধর্ম, অর্থ, মোক্ষ তিনটের তো জমা-খরচ হল আর কাম?
মসোজি বললেন, রাম, রাম। ওর মতো রিটান আমি কোনও মঠ, কোনও মনাস্টেরিতে দেখিনি।
তার পর বিনায়ক রাও আমার চোখের সামনে একটার পর একটা ছবি এঁকে যেতে লাগলেন। কত না বনস্পতি, অজানা-অচেনা বিহঙ্গের সঙ্গে প্রথম পরিচয়, আন্দোলিত উপত্যকার উপর ক্রোশের পর ক্রোশব্যাপী দোদুল্যমান ফুলের বন্যা, পার্বত্য-নদী, জলপ্রপাত, অভ্রংলেহী পর্বত, পাতালস্পর্শী অন্ধকূপ, সংকটময় গিরি-সংকট, পান্থশালা, চট্ট, পার্বত্য শ্রমণদের জিহ্বানিমণপূর্বক তৎসঙ্গে ঘন ঘন বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠদ্বয় আন্দোলন দ্বারা অভিবাদন, দুর্গন্ধময় স্নেহজাতীয় পদার্থসহ চা-পানের নিমন্ত্রণসহ অতিথি সৎকার। আরও এতসব বিজাতীয় বস্তু ও কল্পনাতীত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন যে, সেগুলোর নির্ঘণ্ট মাত্র দিতে হলে প্রচুর অবকাশ ও প্রচুরতর পরিশ্রমের প্রয়োজন। য়েতি বা এমিনেবল স্নোম্যান সম্বন্ধে যেসব কাহিনী বর্ণন করেছিলেন শুধু সেগুলো শিকের হাঁড়িতে সযত্নে তুলে রেখেছি : অম্মদেশীয় সম্পাদক ও প্রকাশকদের শেষশয্যায় সেগুলো তাদের রসিয়ে রসিয়ে শুনিয়ে শুনিয়ে তাদের শেষ যাত্রাটি বিভীষিকাময় করে দেবার জন্যে।