তা যা-ই হোক, জাহান্দার শাহ একদিন ইত্যাকার রোদ মারতে মারতে বেএক্তেয়ার হয়ে যান না হওয়াটাই ছিল ব্যত্যয়– এবং আধামাতাল গাড়োয়ান হুজুর ও লালকুনওরকে কোনও গতিকে গাড়িতে তুলে পাশাপাশি শুইয়ে দিয়ে লালকেল্লা পানে গাড়ি চালায়। বয়েল দুটো সর্বশ্রেষ্ঠ জাতের। পথ চিনে সোজা কেল্লার ভিতরে প্রাসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। লালকুনওর টলতে টলতে প্রাসাদে ঢুকলেন। বয়েল দুটো চলল– আপন মনে বয়েলখানার দিকে, কারণ গাড়োয়ান সম্পূর্ণ বেহুশ।
ঘণ্টাখানেক পরে পড়ল খোঁজ খোঁজ রব। বাদশা কোথায়, বাদশা কোথায়? এ যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। খবরটা যদি রটে যায় তবে বাদশার যে কোনও ভাই, চাচা, ভাতিজা নিজেকে রাজা বলে অবশ্যই ঘোষণা করবেন এবং তা হলেই তো চিত্তির। বিরাট লালকেল্লা তন্ন তন্ন করে খোজা হল, কিন্তু হুজুর যেন মহাশূন্যে অন্তর্ধান করেছেন।
তখন এক সুবুদ্ধিমানের মাথায় অলৌকিক অনুপ্রেরণা এল। এক মাইল দূরের বয়েলখানাতে অনুসন্ধান করে দেখা গেল, হজুর অঘোর নিদ্রায়, গাড়োয়ানও তদ্বৎ।
বলা বাহুল্য, পথচারী মদ্যপায়ী মহলে হুজুর অতিশয় জনপ্রিয় হলেও আমির ওমরাহ মায় প্রধানমন্ত্রী, যদিও তিনি জানতেন; জাহান্দার শাহ তখৎ-হীন হলে তাঁরও নবীন রাজার হাতে জীবন সংশয়– সকলেই তার ওপর বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন।
ওদিকে দুই প্রধান আমির সিন্ধু দেশের সৈয়দ আব্দুল্লা ও সৈয়দ হুসেন আলি ব্যাক করছেন অন্য ঘোড়া– জাহান্দার শাহ্-এর ভ্রাতা আজীম্ উশ-শান-এর পুত্র সুদর্শন, সুপুরুষ–বলা হয় তৈমুরের বংশে এরকম বলবান সুপুরুষ আর জন্মাননি- ফররুখসিয়ারকে। তারা দিল্লির দিকে রওনা হয়েছেন সিংহাসন অধিকার করতে। যুদ্ধে জাহান্দার পরাজিত হয়ে বন্দি হলেন। সিংহাসন হারিয়ে তিনি যত না শোক প্রকাশ করেছিলেন তার চেয়ে বেশি মর্মবেদনা প্রকাশ করলেন, বার বার বেদনাতুর, মিনতিভরা আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে, আমার লালকুনওকে আমার কাছে আসতে দাও, দয়া করে লালকুনওরকে আসতে দাও। সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় তখনই তাদের স্বরূপ দেখাতে আরম্ভ করেছেন–অর্থাৎ তারা গ্লাডস্টোনের মতো কিংমেকার, তারা রাজা ম্যানুফেকচার করেন– লাকুনওর অনুমতি পেলেন জাহান্দার-এর বন্দি জীবনের সাথী হওয়ার।
অধম শুধু পটভূমিটি নির্মাণ করছে; নইলে জাহান্দার শাহ বা ফররুখসিয়ার কেউই আমার লক্ষ্য প্রাণী নন। তবু ফররুখসিয়ার সম্বন্ধে যৎসামান্য বলতে হয়। ইনি বুদ্ধি ধরতেন কম, এবং যে কূটনীতিতে ছিলেন সম্পূর্ণ অজ্ঞ সেইটে প্রয়োগ করতে চাইতেন দুই ধুরন্ধর পকৃসিদ্ধ, অস্বাভাবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের বিরুদ্ধে। তাঁদের একজন প্রধানমন্ত্রীর ও অন্যজন প্রধান সেনাপতির পদ গ্রহণ করে বাদশা সালামতকে প্রায় উপেক্ষা করে রাজত্ব চালনা করতে লাগলেন। নানাপ্রকার মেহেরবানি বণ্টন করে দুই ভাই শক্তিশালী আমির-ওমরাহ গোষ্ঠী নির্মাণ করলেন এবং প্রত্যক্ষত সন্দেহ রইল না যে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় স্বাধিকারপ্রমত্ত হয়ে যা-ই করুন না কেন, শাহি ফৌজ তাঁদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে না। বেচারা বাদশাহ ক্রমেই ক্ষমতা হারাতে লাগলেন এবং শেষটায় চেষ্টা দিলেন, যেসব ভাগ্যান্বেষী অ্যাডভেনচারাররা ইরান-তুরান থেকে দিল্লি আসত তাদের নিয়ে একটা দল সৃষ্টি করতে।
একদা এদের মধ্যে যারা সত্যকার কৃতবিদ্য কিংবা রণবিশারদ তারা দিল্লি দরবারে ও জনসাধারণের ভিতর সম্মান পেতেন। কিন্তু পাঁচশো বসুর মোগল রাজত্ব চলার পর দিল্লির খাসবাসিন্দা মুসলমান ও হিন্দুগণ একটা জোরদার স্বদেশী পার্টি তৈরি করে ফেলেছিলেন। সৈয়দ ভাইরা ছিলেন এ দলের নেতা। (দুর্ভাগ্যক্রমে এ যুগের ঐতিহাসিকরা এই স্বদেশী দলের মাহাত্ম্য পরিপূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করেননি; আর ইংরেজ ঐতিহাসিক অবশ্যই চাইত না যে, এরই অনুকরণে নিত্য নবাগত ইংরেজ ভাগ্যান্বেষীদের বিরুদ্ধে ভারতে একটা স্বদেশী পার্টি গড়ে উঠুক)।
নিরুপায় হয়ে ফররুখসিয়ার তার শ্বশুর যোধপুরের রাজা অজিত সিংকে দিল্লিতে আসবার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ জানিয়ে দূত পাঠালেন। কারণ তখন তিনি সত্যই বুঝে গিয়েছিলেন। যে সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় তাঁকে আর বেশিদিন বরদাস্ত করবেন না। তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে অন্য ক্রীড়নককে তখৎ-ই-তাউসে বসাবেন।
অজিত সিং দিল্লি পৌঁছানো মাত্রই সৈয়দরা তাঁকে সংবর্ধনা করতে অগ্রসর হলেন– বাদশা সালামত তখন কার্যত লালকেল্লায় বন্দি। তারা ওই স্বদেশী বিদেশির জিগিরটি উচ্চকণ্ঠে গাইলেন। অজিত সিং-ও বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন, সৈয়দদের সঙ্গে মোকাবেলা করার মতো শক্তি তার নেই। ফররুখসিয়ারকে সিংহাসনচ্যুত করা বাবদে তিনি সম্পূর্ণ সম্মতি স্পষ্ট ভাষায় দিয়েছিলেন কি না বলা কঠিন।
সৈয়দদ্বয় ফররুখসিয়ারকে ধরে আনবার জন্য অন্দরে সৈন্য পাঠালেন। হারেমে রমণীরা উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করে উঠলেন। তুর্কি রমণীদের সাহস যথেষ্ট, নূরজাহান-জাহানারা অতি কৃতিত্বের সঙ্গে তাবৎ ভারত শাসন করেছেন, কিন্তু এঁদের ভিতর কেউ সেরকম ছিলেন না, কিংবা হয়তো দম্ভী ফররুখসিয়ার এঁদের মন্ত্রণায় কর্ণপাত করেননি। অবশ্য তাকে সবলে টেনে আনতে দূতদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। কারণ তাঁর শরীরে ছিল অসাধারণ বল।