মুচকি হেসে বলল, তাঁর কন্যার—
মিসেস উঠে বললেন, আমি চললুম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া।
নটরাজন বলল, তার কন্যার পাণিগ্রহণের অনুমতি চাইলুম।
আমি বললুম, সে কী! এর তো কিছু বলনি!
বললুম তো, সে অন্য নাট্য। আরেক দিন বলব।
গুরু কী বললেন?
দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। বললেন, আমার দুর্ভাবনার অন্ত ছিল না যে আমার গুণী মেয়ে কোন আনাড়ির হাতে পড়ে, যে সেরামিকের রস জানে না। তোমরা দুজনাতে আমার ঘরানা বাঁচিয়ে রাখবে, সমৃদ্ধ করবে। আমার স্ত্রী সত্যি ভালো কাজ করতে পারে।
***
পরের দিন শুধালুম, দেশে ফিরে কী করলে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানতুম এদেশে অলঙ্ বাধাবিঘ্ন। কাদা-কিলুনের কথা বাদ দাও, আমার হ্যান্ডপেন্টেড অরিজিনাল জিনিস পাঁচশো-হাজার টাকা দিয়ে কিনবে কে? এদেশে তো এসব কেউ জানে না– ভাববে আমি পাগল, একটা টি-সেটের জন্য পাঁচশো টাকা চাইছি। এদেশে জাপানি ক্রোকারি আসে মেশিনে তৈরি মাস্-প্রোডাকশন্। আমার তো প্রতি মাসে অন্তত সাতশো, হাজার টাকা চাই। জাপানে প্রতি মাসে পাঁচ-সাত হাজারও কামিয়েছি।
আমি বললুম, এ কী ট্র্যাজেডি! যা শিখলে তার সাধনা করতে পেলে না?
হেসে বলল, আমি কি পয়লা না শেষ? বিদেশ থেকে উত্তম সায়ান্স শিখে এসে কত পণ্ডিত উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অভাবে এদেশে শুকিয়ে মরে! আর যারা ছবি আঁকে? তাদেরই-বা কজনের অন্ন জোটে? তাই একটা চাকরি নিয়েছি– দেখি, অবসর সময়ে যদি কিছু
আমি উৎসাহের সঙ্গে বললুম, তোমার চাকরিটা তো ভালো। তোমাদের সেরামিক ফ্যাক্টরি শুনেছি, ভারতের সর্বোত্তম। সবচেয়ে বেশি টেম্পারেচার তুলতে পারো তোমাদের কিনে।
অট্টহাস্য করে নটরাজন বলল, ইনসুলেটার! ইনসুলেটার! লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি! টেলিগ্রাফের খুঁটির মাথায় সাদা মুণ্ডুটা দেখেছ? আমরা বানাই সেই মাল। অষ্টপ্রহর তাই বানিয়েও বাজারের খাই মেটাতে পারিনে। কোম্পানির ওতেই লাভ, ওতেই মুনাফা। আর দয়া করে ভুলো না, হরেক রকম ইনসুলেটর সেরামিক পর্যায়েই পড়ে! হা-হা হা-হা, যেমন দেয়ালে যে রঙ লাগায় সে-ও পেন্টার, অবন ঠাকুরও পেন্টার।
ইনসুলেটার হে, ইনসুলেটার!!
পুচ্ছ (প্র) দর্শন
কুকুর মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে– এ তথ্য কিছু নতুন নয়। কিন্তু কুকুরের কাটা লেজের অবশিষ্ট চার আঙুল পরিমাণ একটা ছ ফুট লম্বা তাগড়া জোয়ানকে বাঁচিয়েছে এটা অবিশ্বাস্য। কিন্তু যে-ব্যক্তি এ ঘটনাটির বর্ণনা আমাকে দেন, তিনি অনেকের কাছেই সুপরিচিত এবং তারা সকলেই সানন্দে শপথ করতে প্রস্তুত হবে যে, শ্ৰীযুত বিনায়ক রাও শিবরাম মসোজিকে কেউ কখনও মিথ্যা-ভাষণ করতে শোনেননি।
আমার শুধু ক্ষোভ যে, বিনায়ক রাও যখন আমাকে প্রাগুক্ত ঘটনার সঙ্গে বিজড়িত তাঁর হিমালয় ভ্রমণ বর্ণন করে যান, তখন আমার সুদূর কল্পনাদৃষ্টি দিকচক্রবালে এতটুকু আভাস দেখতে পায়নি যে, আমার মতো নগণ্যজনও একদিন বাঙলা সাহিত্যের সংস্পর্শে আসবে; নইলে সেদিন আমি সাতিশয় শ্রদ্ধা ও যত্নসহকারে বিনায়ক রাওয়ের ভ্রমণকাহিনীটি সবিস্তার লিখে রাখতুম। কারণ আমাদের পরিচিত জন নিত্য নিত্য মানসসরোবর দর্শনে যায় না; তা-ও পিঠে মাত্র একটি হ্যাঁভারস্যাক নিয়ে। পরবর্তী যুগে আমাকে এক মারাঠা দম্পতি বলেন যে, মানসসরোবরে (না মানস সরোবরে তাই আমি জানিনে) যাবার পথে ডাকাতের ভয় আছে বলে তাঁরা সঙ্গে সেপাইশান্ত্রি নিয়ে যান।
বিনায়ক রাও শ্ৰীযুত নন্দলালের শিষ্য এবং শিক্ষাশেষে তিনি গুরু নন্দলালের সহকর্মীরূপে কলাভবনে সহকারী অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। নন্দলাল যেরকম দেব-দেবীর ছবি আঁকতেন, বিনায়ক রাও তেমনি ভারতীয় দৃষ্টিবিন্দু থেকে ভারতীয় বাতাবরণে, ভারতীয় বেশভূষায় মান্না মা-মেরির একাধিক ছবি এঁকে দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেন। ইউরোপীয় চিত্রকরদের মান্না দেখে দেখে আমরা ভুলে গিয়েছিলুম যে, মা-মেরি প্যালেস্টাইন-বালা এবং প্যালেস্টাইন প্রাচ্যভূমি। বিনায়ক রাওয়ের একখানি উৎকৃষ্ট মান্না কিছুদিন পূর্বেও এলগিন রোডের একটি গির্জার শোভাবর্ধন করত।
তিনি যে চিত্রকর ছিলেন, তার উল্লেখ করছি আমি অন্য কারণে। আর্টিস্ট মাত্রেরই অন্যতম প্রধান গুণ যে, তারা কোনও বস্তু প্রাণী বা নৈসর্গিক দৃশ্য দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যগুলো (ক্যারেকটারিস্টিক) লক্ষ করেন এবং ঠিক সেইগুলো মাত্র কয়েকটি আঁচড়ে প্রকাশ করতেই আমাদের কাছে রূপায়িত বিষয়বস্তু প্রাণবন্ত হয়ে ধরা দেয়। ভ্রমণ-কাহিনী বর্ণনার সময় বিনায়ক রাও দৃশ্যের পর দৃশ্য মাত্র কয়েকটি ক্যারেকটারিস্টিক শব্দের দ্বারা প্রকাশ করতেন, আর সঙ্গে সঙ্গে আমি হিমালয়ের গিরি-পর্বত-তুষার-ঝঞ্ঝা চট্টি-কাফেলা সব যেন স্পষ্ট চোখের সামনে দেখতে পেতুম। সেটা এখানে এখন আমার পক্ষে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। কারণ আমি কোনও অর্থেই আর্টিস্ট নই।
বিনায়ক রাওয়ের গভীর বন্ধুত্ব ছিল এক জাপানি ভদ্রলোকের সঙ্গে নাম খুব সম্ভব ছিল– এতকাল পরে আমার সঠিক মনে নেই- হাসেগাওয়া। পাঁচ ফুটের বেশি দৈর্ঘ্য হয় কি না হয়, কিন্তু তার প্রত্যেকটি পেশি ছিল যেন ইস্পাতের স্প্রিং দিয়ে তৈরি। প্রায় কিছু না খেয়েই কাটাতে পারতেন দিনের পর দিন এবং বীরভূমের ১১০ ডিগ্রিতেও তাঁর মুখে কোনও ভাবের পরিবর্তন দেখা যেত না। বিনায়ক রাওয়ের সঙ্গে তার আরেকটা বিষয়ে ছিল হুবহু মিল, দুজনাই অত্যন্ত স্বল্পভাষী। হাসেগাওয়াই প্রস্তাব করেন মানসসরোবরে যাওয়ার।