আমি বুদ্ধের নামে শপথ করলুম।
তার পর, ভাই আরম্ভ হল আমার পিঠের উপর ব্লাদা চালানো। একই কাজ একশো বার করিয়েও তিনি তৃপ্ত হন না–আর মোস্ট এলিমেন্টারি টাস। সঙ্গীতের উপমা দিয়ে বলতে পারি, এ যেন স্রেফ সা রে গা মা পা ধা নি সা সা নি ধা পা মা গা রে সা। সা রে গা মা পা ধা নি–
আমি বললুম, বোমা পড়ে জাপানি!
নটরাজন অবাক হয়ে বলল, সে আবার কী? আমি বললুম সিলেটে গত যুদ্ধে প্রথম জাপানি বোমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম্য কবি রচেন,
সা রে গা মা পা ধা নি
বোমা পড়ে জাপানি
বোমার মধ্যে কালো সাপ
বিটিশে কয় বাপ রে বাপ!
নটরাজন বলল, আমার অবস্থা তখন ব্রিটিশের চেয়েও খারাপ। তারা তো পালিয়ে বেঁচেছিল, আমার যে পালাবারও উপায় নেই। তবে শুরু এখন বাঙ্ময়। চা খেতে খেতে, বেড়াতে যেতে যেতে ফাইয়াস-পর্সেলিনের গুহ্যতম তত্ত্ব বোঝাতেন, কিন্তু রেওয়াজের বেলা সেই প্রাণঘাতী সা রে গা মা।
পাক্কা দেড়টি বছর পরে পেলুম দ্বিতীয় পাঠ!
ইতোমধ্যে দেখি, এ-দেশের ব্যাপারটাই আলাদা! অনেকদিন একটানা পাত্র গড়ে তার উপর ছবি এঁকে যখন এক উঁই তৈরি হল তখন গুরু কিনে সেগুলো ঢুকিয়ে করলেন ফায়ারিং। ইতোমধ্যে পটারির সমঝদারদের কাছে নিমন্ত্রণ গেছে, অমুক দিন অমুকটার সময় তাঁর পটারির প্রদর্শনী। ঢাউস ঢাউস মোটর চড়ে, গ্রাম্যপথ সচকিত করে এলেন লক্ষপতিরা। তাঁরা চা খেলেন। সার্ভ করলুম। সবাই ভাবলেন আমি বিদেশি চাকর। একজন একটু কৌতূহল দেখিয়েছিলেন, গুরু সেটা অঙ্কুরেই বিনাশ করলেন। তার পর ওঁদের সামনেই কিলন থেকে পটারি বের করা হল। পাঁচশো থেকে আরম্ভ করে, এক এক সেট দুহাজার তিন হাজার টাকায় সব– সব বিক্রি হয়ে গেল। দেশে, বিলেতে মানুষ যেরকম ছবি, মূর্তি কিনে নিয়ে আপন কলেশন বানায়।
তার পর আস্তে আস্তে অনুমতি পেলুম পাত্রের গায়ে ছবি আঁকবার। পুরো এক বছর ধরে পাত্র গড়ি, ছবি আঁকি কিন্তু কিনে ঢোকবার অনুমতি পাইনে। ভেঙে ফেলতে হয় সব। সে কী গব্বযন্ত্রণা!
এমন সময় এল শুরুর আরেকটা প্রদর্শনী। আমি গোপনে গুরুর উঁইয়ের সঙ্গে আমার একটা কাপ এক কোণে রেখে দিলুম। ডিজাইন দিয়েছিলম পারশিয়ান। আমাদের দেশে তো সেরামিকের ঐতিহ্য নেই, আর পারশিয়ান ডিজাইন জাপানে প্রায় অজানা।
চায়ের পর কিলন খোলার সময় প্রায় একই সময়ে সকলের দৃষ্টি পড়ে গেল আমার কাপটার ওপর। আমি আশা করেছিলুম, ওটা আমি গোপনে সরিয়ে নিতে পারব। আমি তখন ছোঁ মেরে সেটা সরিয়ে করলুম পলায়ন। ওঁদের ভিতর তখন আরম্ভ হয়ে গিয়েছে আমার কাপ নিয়ে নিলাম। গুরু বসবার ঘরে এসে আমাকে ডাকলেন। আমি এসে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে তার পায়ের কাছে কাপটি রাখলুম। তখন তারা বুঝলেন, এটা কার কাজ। গুরু স্মিতহাস্যে ওঁদের সবকিছু বয়ান করে বললেন, শিগগিরই ওর আপন প্রদর্শনী হবে। আপনারা কে কী চান অর্ডার দিয়ে যান।
ওরা চলে গেলে আমি সব বুঝিয়ে গুরুর কাছে মাফ চাইলুম। তিনি প্রসন্ন বদনে বললেন, দু-চার মাসের ভিতর এমনিতেই হত। তোমাকে কিছু বলিনি।
আমি কাজে লেগে গেলুম। গুরু আপন কাজ বন্ধ করে দিয়ে পই পই করে তদারকি করলেন আমার প্রত্যেকটি পদক্ষেপ বা অঙ্গুলিচালনা।
নিমন্ত্রণপত্র বেরুল তাঁর নামে। আমার প্রথম প্রদর্শনী। গুরু বললেন, তোমার একটা ফটো ছেপে দাও চিঠিতে।
নটরাজন বলল, দাঁড়াও, সে চিঠির একটা কপি বোধহয় বউয়ের কাছে আছে। তাঁকে স্মরণ করা হলে তিনি নিয়ে এলেন একটা অ্যালবাম্। তাতে মেলা প্রেস-কাটিংস। নটরাজনের প্রদর্শনীর রিভিউ। নিমন্ত্রণপত্রে তাজ্জব হয়ে দেখি ফটোতে নটরাজনের মাথায় খাস পাঠান পাগড়ি! আমি বললুম এ কী? বলল, ভাই, জাপানিরা ওই পাগড়িটাই চেনে। ওটা হলেই ইন্ডিয়ান!
আমি শুধালুম, তার পর?
প্রদর্শনী হল। গুরু ময়ূরটার মতো প্যাখম তুলে ঘোরাঘুরি করলেন। বেবাক্ মাল বিক্রি হয়ে গেল। কড়া কড়া টাকা পেলুম। কাগজে কাগজে রিভিউ বেরোল।
নটরাজনের স্ত্রী বললেন, তিনি জাপানের অন্যতম সেরা আর্টিস্ট বলে স্বীকৃত হলেন।
নটরাজন বলল, সেসব পরে হবে। আমার মস্তকে কিন্তু সাত দিন পরে সাক্ষাৎ বজ্রাঘাত। চাঁদের আলোতে ঝরনাতলায় চুকচুক করে সাকে খেতে খেতে গুরু বললেন, এইবারে বৎস, তোমার ছুটি। টোকিওতে গিয়ে আপন পসরা মেলো।
আমি আর্তকণ্ঠে বললুম, গুরুদেব, আমার যে কিছুই শেখা হয়নি।
গুরু বললেন, বৎস শেখার তো শেষ নেই। কিন্তু গুরুর কাছ থেকে তালিম নেবার একটা শেষ থাকে। তোমাদের স্কুল-কলেজেও তো শেষ উপাধি দিয়ে বিদায় দেয়। তখন কি আর গুরু শোনে তোমার মিনতি যে, তোমার কিছুই শেখা হয়নি? আমি যেসব হুনর পুরুষানুক্রমে পেয়েছি তার প্রত্যেকটি তোমাকে শিখিয়েছি। এবারে আরম্ভ করো সাধনা।
আমার সব অনুনয়-বিনয় ব্যর্থ হল। বললেন, মাঝে মাঝে এসো; তোমার কাজ দেখে আলোচনা করব। নির্দেশ দেব না, আলোচনা করব।
আমি পরের দিন আমার সঞ্চয়ের সব অর্থ গুরুর পদপ্রান্তে রাখলুম– গুরুদক্ষিণা। তিনি একটি কড়িও স্পর্শ করলেন না। অনেক চেষ্টা দিলুম। আবার তিনি নির্বাক! সেই প্রথমদিনের মতো।
বেশ খানিকক্ষণ কী যেন একটা ভেবে নিয়ে নটরাজন বলল, এঁর সঙ্গে কিন্তু একটা সাইড-ড্রামাও আছে।
সেটা কী?