কিন্তু আর না।
ওস্তাদ ওসিমা সম্বন্ধে খবর নিয়ে কিন্তু বিশেষ ভরসা পেলুম না। তিনি বাস করেন এক অজ পাড়াগাঁয়ে, এবং গত দশ বছর ধরে কোনও শাগরেদ নিতে রাজি হননি। তবে সবাই একবাক্যে বললেন, ওরকম গুণী এখন তো কেউ নেই-ই; সেরামিকের ইতিহাসেও কমই জন্মেছেন।
যা হয় হবে কুল-কপালে। সব জিনিসপত্র বিক্রি দিয়ে, একফালি বিছানা আর একটি সুটকেস নিয়ে পৌঁছলুম সেই গায়ে, খুঁজে বের করলুম ওস্তাদের বাড়ি।
জাপানি ভাষা কিন্তু আমি বাঙলার মতো সুদু কান দিয়ে শিখিনি। প্রথম দিন থেকে রীতিমতো ব্যাকরণ অভিধান নিয়ে তোমরা যেরকম আশ্রমে শাস্ত্রীমশায়ের কাছে সংস্কৃত
আমি বললুম, থাক, থাক্।
ওস্তাদের ঘরে ঢুকে, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে তাঁকে প্রণাম করে অতিশয় বিনয়, ততোধিক বশ্যতা প্রকাশ করে তাঁর শিষ্য হওয়ার ভিক্ষা চাইলুম।
যেন বোমা ফাটল : বেরিয়ে যাও এক্ষুণি, বেরোও এখান থেকে।
আমি ভয়ে ভয়ে এসেছিলুম সত্যি, কিন্তু এরকম পদাঘাত প্রত্যাশা করিনি।
আরম্ভ করলুম কাকুতিমিনতি, সুদূর ইন্ডিয়া থেকে এসেছি, আমি হত্যে দেব ইত্যাদি। আর শুধু মাটিতে মাথা ঠেকাই।
অনেকক্ষণ পর তিনি অতিশয় শান্ত সংযত কণ্ঠে বললেন, আমি কী করি না করি সেকথা কাউকে বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন বোধ করিনে। তবু তোমাকে বলছি– বিদেশি বলে। আমার কাছে লোক এসে দু-চার মাস তালিম নিয়ে পালিয়ে গিয়ে রটায় তারা আমার শিষ্য। কিছুই তারা শেখেনি– আর আমার নাম ভাঙিয়ে খায়। তাই আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আর কোনও শিষ্য নেব না।
আমি বললুম, নটরাজন, বরোদার ওস্তাদ গাওয়াইয়া ফইয়াজ খানও হুবহু ঠিক একই কারণে তাঁর জীবনের শেষের দিকে আর কোনও চেলা নিতেন না।
নটরাজন বলল, ওদের দোষ দিইনে, কিন্তু আমার দিকটাও তো দেখতে হবে। আমি আমার ওস্তাদকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলুম, আমি ওরকম কোনও কুমতলব নিয়ে আসিনি। তিনি অটল অচল, নির্বাক।
কী আর করি! বারান্দায় গিয়ে বসে রইলুম বিছানাটার উপর দেয়ালে হেলান দিয়ে আমি নাছোড়বান্দা, জীবনমরণ আমার পণ।
ঘণ্টাখানেক পর ওস্তাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় চলে গেলেন আমাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। আমি এক লফে ঘরের ভিতর ঢুকে তার চাকরকে খুঁজে বের করে বললুম, দাদা, এখন তুমিই আমার একমাত্র ভরসা। তুমি আমায় সাহায্য কর। সে আগেই শুরুর সঙ্গে আমার বাক্যালাপ শুনেছিল। তাকে বখশিশের লোভও দেখালুম। তার অনুমতি নিয়ে ওস্তাদের সবকখানা ঘরে লাগালুম ঝট, ঝাড়াই-পোঁছাই, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তন্ন তন্ন করে। গামলার জল পাল্টালুম, রঙতুলি গুছিয়ে রাখলুম, জামা-কিমোনো ভাঁজ করলুম, বিছানা দুরুস্ত করলুম। তার পর ফের বারান্দায়, বিছানার উপর। ওস্তাদ ঘন্টাখানেক পরে ফিরে এসে দরজার সামনে এক লহমার তরে একটু থমকে দাঁড়ালেন। কিন্তু নির্বাক। এবার চাকরকে চায়ের হুকুম দিলেন। আমি আড়াল থেকে লক্ষ করলুম। ঘন্টাখানেক পরে খেয়ে শুতে গেলেন। আমি গাঁয়ের যে একটিমাত্র খাবারের দোকান ছিল সেখানে শুটকি-ভাত খেয়ে এলুম। ওস্তাদ ঘুম থেকে উঠে চায়ের জন্য হাঁক দিতেই আমি রান্নাঘর থেকে চায়ের সরঞ্জাম এনে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে চা তৈরি করে কাপ এগিয়ে দিলুম। তিনি তখন আমার দিকে পিছন ফিরিয়ে ভেজা পাত্রে ছবি আঁকছিলেন। পেয়ালা হাতে নিয়েই ঘাড় ফিরিয়ে একবার কুটি-কুটিল নয়নে আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু নির্বাক। এর পর আমি রঙ গুলে দিতে লাগলুম। যাই বল, যাই কও– আমিও আটিস্ট। কখন কোন রঙের দরকার হবে আগের থেকেই বুঝতে পারি। তাকে অপেক্ষা করতে হয় না। তিনি নির্বাক।
সে রাত্রে আমি বারান্দাতেই ঘুমিয়েছিলুম। কিন্তু ওই এক রাত্রিই।
ভোর থেকেই লেগে গেলুম চাকরের কাজে। তার পরের দিন। ফের পরের দিন। চাকরটা এখন আর তার ঘরেই ঢাকে না। তিনি নির্বাক।
আমি দু বেলা হোটেলে গিয়ে শুটকি-ভাত খাই, আর রাত্রে চাকরের পাশে শুই।
বিশ্বাস করবে না, এই করে করে প্রায় একমাস গেল। তিনি নির্বাক।
মাসখানেক পরে একরাত্রে আমি আমার ইচ্ছা, আর কিছুতেই দমন করতে পারলুম না। যা দেখেছি সেইটে কাজে লাগাবার অদম্য কামনা আমার ঘুম তাড়িয়ে দিয়েছে। অতি চুপিসাড়ে ওস্তাদের পটার্স হুইলের পাশে বসে একটা জাম-বাটি তৈরি করতে লাগলুম তন্ময় হয়ে। হঠাৎ পিঠের উপর একটা বিরাশি সিক্কার কিল আর হুঙ্কার।
কোন গর্দভ তোমাকে শিখিয়েছে ওরকমধারা বাটি ধরতে? কোন মর্কট তোমাকে শিখিয়েছে ওরকম আঙুল চালাতে? প্রত্যেকটি জিনিস ভুল। যেন ইচ্ছে করে যেখানে যে ভুলটি করার সেটা মেহন্নত করে করে শিখেছ। হটো ইহাসে!
গুরু প্রথম নিজে করলেন। কী বলব ভাই, তাঁর দশটি আঙুল যেন দশটি নর্তকী। প্রত্যেকটির ফাংশান যেন ভিন্ন ভিন্ন, নাচে আপন আপন নাচ। তার পর আমাকে বসিয়ে আমার হাতে হাত ধরে শুরু করলেন গোড়ার থেকে। আর শুধু বলেন, হা আমার অদৃষ্ট, এসব গলদ মেরামত করতে করতেই তো লেগে যাবে পাঁচটি বচ্ছর!
এই আমার প্রথম পাঠ। ভোর অবধি চলেছিল।
সকালবেলা চা খেতে খেতে শান্ত কণ্ঠে বললেন, ভুল প্র্যাকটিস যে কী মারাত্মক হতে পারে তার কল্পনাও তোমার নেই। তোমার ঘর ঝাট দেওয়া, রঙ গোলা থেকে আমি অনুমান করেছিলাম তোমার হাত আছে, কিন্তু অসম্ভব খারাপ রেওয়াজ করে করে তার যে সর্বনাশ করে বসে আছ সেটা জানলে প্রথমদিনই পুলিশ ডেকে তোমাকে তাড়িয়ে দিতুম। এখন দেখি, কী করা যায়। এ-ও আমার এক নতুন শিক্ষা! তোমাকে নেব দুই শর্তে। প্রথম, আমি অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার কাজ জনসাধারণকে দেখাতে পারবে না। দ্বিতীয়, আমি অনুমতি না দেওয়া পর্যন্ত তুমি শিক্ষা ক্ষান্ত দিয়ে পালাতে পারবে না।