আমি বাধা দিয়ে নটরাজনকে বললুম, আমাদের কুমোররা—
বলল, হায়, হায়! ওই টেম্পারেচারে মাটির হাঁড়িকুড়ি হয়। গ্লেজড পটারির– এদেশের সব বস্তুই তাইজন্য আরও টেম্পারেচার তুলতে হয়, আর কমসে কম দু হাজার ফারেনহাইট না হলে–
আমি বললুম, থাক, থাক্। ওসব অমি বুঝব না।
বলল, হ্যাঁ, সেই ভালো। তার পর খবর নিয়ে ন্যাজেমডো অবধি ওকিবহাল হয়ে গেলাম। নিজের চাই শুধু একটা পটারস হুইলকুমোরের চাক। বাজার থেকে রেডিমেড কাদা এনে তাতে চড়িয়ে বানাবে যা খুশি। সেগুলো ভেজা থাকতে থাকতেই তার উপর আঁকবে ছবি নিজস্ব আপন অনুপ্রেরণায়, এবং একই ছবি দুসরা সেটে আবার নকল করবে না, যেরকম খাস পেন্টাররা একই ছবি দু দুবার আঁকেন না। ছবি আঁকা শেষ হয়ে গেলে সেগুলো ঠেলায় করে নিয়ে যাবে কিওলার কাছে। বহু লোকের কাছ থেকে একরাশ জমা হলে তবে সে ফায়ার করবে, নইলে খর্চায় পোষায় না। তবে মোটামুটি বলে দেয় কবে এলে তোমার মাল তৈরি পাবে। মাল খালাসির সময় দেবে তার মজুরি। তার পর তুমি তোমার মাল পর্সেলিনের দোকানে দিয়ে আসতে পারো তারা বিক্রি করে তাদের কমিশন নেবে কিংবা তুমি ঠেলা ভাড়া করে তার উপর মাল সাজিয়ে ফেরি করে বেড়াতে পারো।
আমি বললুম ব্যবস্থাটা উত্তম বলতে হবে। তার পর?
জিনিসটা যে এত সরল-সহজ করে এনেছে জাপানিরা সেটা আমি জানতুম না। সেইদিনই সবকিছু জোগাড় করে লেগে গেলুম কাজে। টেকনিকেল দুটো-একটা সামান্য জিনিস ল্যান্ড লেডির করার ধরন থেকে অনায়াসে শিখে নিলুম। আর এ ব্যাপারে তো এই আমার পয়লা হাতেখড়ি নয়। আর কাপ, পটে আঁকার মতো ছবির বিষয়বস্তু নিয়েও আমার কোনও দুর্ভাবনা ছিল না।
মাল যখন সমুচা তৈরি হল, তখন কিছুটা দিলুম দোকানে; আর ঠেলা নিয়ে ফেরি করতে কার না শখ যায়?
ভারতীয় বলে সর্বত্রই পেলুম অকৃপণ সৌজন্য ও সাহায্য। তুমি জানো কি না জানিনে, এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এক ভবঘুরে জাপানি না জানি কী করে ভাসতে ভাসতে পৌঁছয় তোমাদের ঢাকা শহরে। ভাবতেই কীরকম মজা লাগে– দুনিয়ার সব জায়গা ছেড়ে ঢাকা। তবে ওই চিরসবুজের দেশ– আমারও দেখা আছে– তাকে এমনি মুগ্ধ করল যে, সে সেখানে একটা সাবানের কারখানা খুলল এবং শেষটায় একটি হিন্দু মেয়েকে বিয়েও করল। বাপ-মাকে দেখাবার জন্য একবার নিয়ে গেল তার বউকে জাপানে। বুদ্ধের দেশের মেয়ে জাপানে এসেছে খবরটা দেশময় ছড়িয়ে পড়ল মুখে মুখে। সেই অজ পাড়াগাঁ রাতারাতি হয়ে গেল জাপানের তীর্থভূমি। হাজার হাজার নরনারী লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সেখানে কন্যার দর্শনাভিলাষে। ভাবো, মেয়েটার অবস্থা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকে বসতে হল পদ্মাসনে, আর নতন্ত্র জাপানিদের লাইন তাকে প্রণাম করে পাদ্যঅর্থ দিয়ে নিজেদের ধন্য মনে করল।
আমি বললুম মহিলাটি ঢাকায় ফিরে তাঁর জাপান-অভিজ্ঞতা বাঙলায় লেখেন, বড় সবিনয় ভাষায়। আমি পড়েছি। সে তো এলাহি ব্যাপার হয়েছিল।
হবে না? আমার আমলে আমাদের রাসবিহারীবাবু ছিলেন জাপানিদের সাক্ষাৎ দেবতা। ভারতবর্ষ থেকে জাপানে যে কেউ আসুক না কেন– এমনকি ইংরেজও তার কাগজপত্র যেত ওঁর কাছে। তিনি না বললে পত্রপাঠ আগন্তুকের জাপান ত্যাগ ছিল অনিবার্য। আর গুরুদেবের কাছ থেকে কেউ চিঠি নিয়ে এলে রাসবিহারীবাবু তাকে সমাজের সর্বোচ্চদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেন। বৈশাখী পূর্ণিমায় বুদ্ধের জন্মদিনে তার বাড়ি থেকে প্রসাদ বিতরণ হত– কিউ দাঁড়াত মাইল দুয়েক লম্বা। সিঙাড়া না আমাদের দেশের কী একটা খাবার জাপানিদের কাছে রোমান্টিক এবং হোলি।
আমি অবশ্য পারতপক্ষে মাতৃভূমির পরিচয় দিতুম না।
তবু বিক্রি হতে লাগল প্রচুর। তার কারণ সরল। পাত্রের গায়ে অজানা ডিজাইন, নবীন ছবি– তা সে ভালো হোক আর মন্দই হোক– সক্কলেরই চিত্ত-চাঞ্চল্য এনে দেয়। তারই ফলে আমি পরমানন্দে দিন কাটাতে লাগলুম। ফেরি-টেরি আর করিনে– নিতান্ত দু মাসে ছ মাসে এক-আধ দিন রোমাসের জন্য। করে করে দু বছর কেটে গেল।
একদিন ওই ঠেলা গাছের ছায়ায় দাঁড় করিয়ে আমি জিরোচ্ছি, এমন সময় এক থুরথুরে অতিবৃদ্ধ জাপানি খানদানি সামুরাই অন্তত আমার তাই মনে হল– থমকে দাঁড়ালেন ঠেলার সামনে। কিন্তু এর মুখে দেখি তীব্র বিরক্তি। পুরু পরকলার ভিতর দিয়ে ক্ষণে তাকান আমার দিকে, ক্ষণে ঠেলার মালের দিকে। জাপানিরা অসহ্য রকমের অসম্ভব দ্র; অসন্তুষ্টি কিছুতেই প্রকাশ করতে চায় না। এর কিন্তু ধৈর্যের বাধ যেন টুটে গেল। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, এসব কী? এসব কী করেছ? যাও, যাও, ওস্তাদ ওসিমার কাছে। তোমাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। তার পর আমাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললেন, এরকম সুরেলা গলা নিয়ে কি বিশ্রী বেসুরা গান!
আমি বাড়িতে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লুম। সত্যিই তো, আমি এ দু বছরে নতুন শিখেছি কী? কাদা কী করে তৈরি করতে হয়, কিলন কী করে জ্বালাতে হয়– অন্যসব বাদ দিচ্ছি–কিছুই তো শিখিনি। দেশে ফিরলে ওগুলো আমায় করে দেবে কে? আর বাসনকোসনের শেপে, ছবিতে নিশ্চয়ই মারাত্মক ত্রুটি আছে, নইলে রাস্তার বুড়ো ওরকম খাপ্পা হল কেন?
চিন্তা করতে করতে মনে পড়ল শান্তিনিকেতন মন্দিরে গুরুদেবের একটা সারমনের কথা। সোনার পাত্রে সত্য লুকানো রয়েছে– সবাই পাত্র দেখে মুগ্ধ, ভিতরে হাত দিয়ে খোঁজে না, সত্য কোথায়। আমার হয়েছে তাই। এখানে কাঁচা পয়সা কামিয়ে আমি অবহেলা করেছি সেরামিকের নিগূঢ় তত্ত্ব।