বিশ্বকর্মাই জানেন স্যাকরার যন্ত্রপাতি কোত্থেকে সে জোগাড় করল, কী কৌশলে কাজ সমাধা করল। গয়না দেখে কে কী বলেছিলেন সেটা না বলে শুধু সবিনয় নিবেদন করি, হিন্দু বিয়েতে বরপক্ষ আকছারই সহিষ্ণুতায় যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আসেন না– তারা পর্যন্ত পঞ্চমুখে গয়নার প্রশংসা করেছিলেন।
নটরাজনের অন্যান্য গুণ উপস্থিত আর উল্লেখ করছি না। তার পরবর্তী ঘটনা বোঝার জন্য একটি গুণকীর্তন করি। এস্তেক বর্ণপরিচয় স্পর্শ না করে শুধু কান দিয়ে সে শিখেছিল অদ্ভুত সড়গড় চলতি বাঙলা। আমাকে শুধু গোড়ার দিকে একদিন শুধিয়েছিল, বাঙলার কি কোনও স্ট্যান্ডার্ড উচ্চারণ নেই? উচ্চারণে উচ্চারণে যে আসমান-জমিন ফারাক? কোনটা শিখি?।
শান্তিনিকেতনে তখন ছিল নিরঙ্কুশ বাঙাল রাজত্ব। পাঁচটা বাঁদরের বদলে পাস্টা বাদর হামেশাই ঝোঁপঝাড় থেকে বেরিয়ে পড়ার বদলে বেড়িয়ে পরত, অবিড়াম ঝড়ঝড় বাড়ি-ধাড়ার মাঝখানে। আমি নটরাজনকে বললুম আর যা কর কর, দোহাই আল্লার, আমার উচ্চারণ নকল করিনি। আমি বাঙালস্য বাঙাল– খাজা বাঙাল। আর করিসনি শুরুদেবের। তার ভাষা, তার উচ্চারণ তাঁর মুখেই শোভা পায়। করবি তো কর তোর গুরু নন্দলালের উচ্চারণ। বাঙলায় এম.এ. পাস ধুরন্ধররাও ওরকম সরল লৈতি বাঙলা বলতে পারে না।
তার পর ঝাড়া বিশটি বছর আমাদের দুজনাতে দেখাসাক্ষাৎ হয়নি, চিঠি-পত্রও না। এই বিশ বৎসরের ভিতর বাঙলা দেশে থাকলে পৌষমেলায় কখনও-সখনও শান্তিনিকেতন গিয়েছি। ওর সাক্ষাৎ পাইনি। সত্যি বলতে কি, ওর কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলুম। শুধু কেউ কখনও অচলিত গান
জগপতি হে
সংশয় তিমির মাঝে
না হেরি গতি হে
গাইলে মনে পড়ত নটরাজন ওর সুরটা বড় দরদভরা করুণ সুরে বাঁশিতে বাজাত।
১৯৪৭ সাল। স্বরাজ যখন পাকা ফলটির মতো পড়ি পড়ি করছে, ওই সময়ে আমি একদিন বাঙ্গালোরের এক রেস্তোরাঁয় বসে কফি খাচ্ছি। দেখি, তিনটি প্রাণী ঢুকে এককোণে আসন নিল। একজন চীনা কিংবা জাপানি ছোট্টখাট্টো একমুঠো মেয়ে, দ্বিতীয়া সুডৌলা তরুণী–খুব সম্ভবত তামিল– এবং সঙ্গে এ কে? নটরাজন! চেহারা রত্তিভর বদলায়নি। শুধু কপালটি আরও চওড়া হয়েছে, চুলে বোধহয় অতি সামান্য একটু পাক ধরেছে। আমার চেহারা বদলে গেছে আগাপাশতলা কিন্তু আর্টিস্ট নটরাজনকে ফাঁকি দিতে হলে প্লস্টিক সার্জারি করাতে হয়, এবং চোখদুটো আই-ব্যাঙ্কে জমা দিতে হয়। নটরাজন আমাকে দেখামাত্র উঠে এসে আমাকে তার টেবিলে নিয়ে গিয়ে মহিলাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। তামিলটি লেডি ডাক্তার, বিধবা, প্র্যাকটিস করেন, এবং জাপানিটি তাঁর স্ত্রী। শুধালাম, তুমি আবার জাপান গিয়েছিলে নাকি? সেই মুখচোরা নটরাজন মুখচোরাই রয়ে গেছে। বলল, অনেক বছর কাটিয়েছি।
সেদিন আর বেশি কথাবার্তা হল না। শুধু বলল, শহরের তিন মাইল দূরে ফাঁকা জায়গায় সেরামিকের ছোটখাটো কারখানা করেছে, বাড়িও। আমাকে শনিবার দিন উইক-এন্ড করতে সেখানে নিয়ে যাবে। আমার ঠিকানাটা টুকে নিল।
এস্থলে বলে রাখা কর্তব্য বিবেচনা করি, আমি কুমোরের হাঁড়িকুড়ি থেকে আরম্ভ করে সেরামিক, পর্সেলিন, গ্লেজড পটারি, ফাইয়াস এসবের কিছুই জানিনে। শুধু এইটুকু জানি যে স্টোনওয়েয়ার পাথরের জিনিস নয়– সেটা আমরা যাকে তামচিনি বলি, মেয়েরা যেসব বোয়ামে আচার-টাচার রাখেন। এটা উল্লেখ করার প্রয়োজন হল এই কারণে যে, সেই সন্ধ্যায় এক বন্ধুকে নটরাজনের কথা তুলতে তিনি বললেন, সেরামিক বাবদে ও যা জানে না, সেটা জানার কোনও প্রয়োজন নেই। বিগেস্ট একত্সপার্ট ইন দি ইস্ট। এখানকার সরকারি সেরামিক ফ্যাক্টরির বড় কর্তা।
শনির সন্ধ্যায় নটরাজন আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেল। তার বউ একটিমাত্র কথা না বলৈ যা যত্ন-আত্তি করল সেটা দেখে বুঝলুম কেন চীন-জাপানে প্রবাদ প্রচলিত আছে চীনা খাদ্য আর জাপানি স্ত্রী স্বর্গ-সুখ; চীনা স্ত্রী আর জাপানি খাদ্য– নরক ভোগ। জাপানি স্ত্রীজাতির মতো কর্মঠ, শান্ত, সেবাপরায়ণ রমণী নাকি ইহসংসারে নেই।
আহারাদির পর নটরাজনের স্ত্রী বললেন, দুই বন্ধুতে কথাবার্তা বলুন।
নানা কথা হওয়ার পর আমি বললুম, জাপানের কথা কও।
নটরাজন সে রাত্রে কিছুটা বলেছিল, পরে আরও সবিস্তার।
বলল, শান্তিনিকেতন ছাড়ার পর আমার ধারণা হল যে, আর্টসের চেয়ে ক্রাফটুসেই আমার হাত খোলে বেশি।
আমি বললুম, সে আর বলতে! সেই যে, গয়না বানিয়েছিলে!
বলল, সেকথা আর তুলো না। হাত ছিল তখন বড়ড় কাঁচা। তা সে যাক্। নানা ক্রাফ্ট শিখলুম অনেক জায়গায়। শেষটায় চোখ পড়ল পর্সেলিনের দিকে। সামান্য কিছুটা শেখার পরই বুঝলুম, এ একটা মারাত্মক ব্যাপার, একটা নতুন জগৎ, এর সাধনায় আস্ত একটা জীবন কেটে যায়। মেলা কেতাবপত্র ঘেঁটে আবিষ্কার করলুম যে, যদিও চীন এই কর্মে একদা সর্বশ্রেষ্ঠ ছিল, ড্রেসডেনও একদা অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল, এখন কিন্তু জাপান এর রাজা।
ঘটি-বাটি বিক্রি করে চলে গেলুম জাপান।
টোকিয়ো পৌঁছনোর কয়েকদিন পরেই দেখি আমার ল্যান্ডলেডি চীনামাটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। তার কাছ থেকে খবর পেলুম, পর্সেলিন অর্থাৎ চীনামাটির বাসনকোসন, কাপ-সসার বানানো এদেশে কুটিরশিল্পও বটে। সে কী করে হয়! যে মাটি দিয়ে পর্সেলিন তৈরি হয় তার থেকে বালু আর অন্যান্য খাদ সরাবার জন্য ব্যাপক বিস্তৃত ব্যবস্থা করতে হয় অনেকখানি জায়গা নিয়ে আমি এখানে, বাঙালোরে এসে করেছি, কিন্তু ঠিক ওত্রাচ্ছে না, এখানকার মাটি ভালো নয়– খরচাও বিস্তর। ল্যান্ডলেডি বলল, বাজারে রেডিমেট কাদা বিক্রি হয়। আমি ল্যান্ডলেডিকে বললুম, সে না হয় হল, কিন্তু পোড়াবে (fire করবে) যে, তার জন্যে কিলন ফারনেস্ (পাঁজা) পাবে কোথায়?