পিতাই লক্ষ করলেন তার বিষণ্ণ ভাব। পিতাপুত্রে সখ্য ছিল– দূরত্ব নয়। সব শুনে বললেন, বাধা পথে যে চলে না তার কপালে দুঃখ অনেক। কিন্তু আপন পথ খুঁজে নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার দুঃখ আরও বেশি। তোমার ওপর আমার আশীর্বাদ রইল।
অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম যুগ। যারা গোলামি-তালিম চায় না, তারা যাবে কোথায়? বিশ্বকবি কবিগুরু যেন বিধির আদেশে ঠিক ওই শুভলগ্নেই শান্তিনিকেতনে তাদের জন্য নীড় নির্মাণ করেছিলেন– যত্র বিশ্ব ভবত্যেক নীড়ম্। দূর সিন্ধু, মালাবার, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, আসাম থেকে ছেলেমেয়ে আসতে লাগল– দলে দলে নয়, একটি-দুটি করে।
যারা এল তাদের মধ্যে দু-চারটি ছিল লেখাপড়ায় বিদ্যেসাগর, বাপ-মা-খ্যাদানো বিশ্ববকাটে। বিশ্বভারতীই তো বিশ্ববকাটেদের উপযুক্ত স্থান, ওই ছিল তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আসলে এরা ছিল কোনও কৌশলে স্কুল থেকে নাম কাটানোর তালে। অসহযোগের সহযোগিতায় তারা সে কর্মটি করল নিশান উড়িয়ে দামামা বাজিয়ে।
বলা বাহুল্য আমি ছিলুম এই দলের।
হিন্দি-উর্দুতে বলে পাঁচো উঙলিয়া ঘিমে আর গর্দন ডেগমে অর্থাৎ পাঁচ আঙুল ঘিয়ে আর গর্দানটাও হাঁড়ায় ঢুকিয়ে ভোজন। আমরা যে ভূমানন্দ– ভূমা, বিশ্বপ্রেম, অমৃতের পুত্র এসব কথা তখন ছিল আমাদের ডালভাত– আমাদের মধুরতর স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি, এখানে এসে দেখি সে-অমৃত উপচে পড়ছে। সে যুগে বিশ্বভারতীর প্রথম নীতি ছিল, আমি অক্ষরে অক্ষরে তুলে দিচ্ছি : The system of examination will have no place in Visvabharati, nor will there be any conferring of degrees.!!
বঙ্কিম চাটুয্যের কল্পনাশক্তি বড়ই দুর্বল। তিনি রচেছিলেন,
ছাত্রজীবন ছিল সুখের জীবন
যদি না থাকিত এগজামিনেশন।
বিশ্বভারতী বঙ্কিমের সে স্বপ্ন মূর্তমান করেছিল।
এবং ধর্মত ন্যায্যত প্রাক্তনীতির পিঠ পিঠ আসে : যেখানে পরীক্ষা নেই সেখানে ক্লাসে উপস্থিত হওয়া না-হওয়া ছাত্রের ইচ্ছাধীন। অতএব রেজিস্ট্রি নেই, রোল-কল্ নেই!
আমাদের অভাব ছিল মাত্র একটি উৎকৃষ্ট নিকৃষ্ট যা-ই হোক– চায়ের দোকান। তাই ছিল ঘরে ঘরে স্টোভ আর চায়ের সরঞ্জাম।
সত্যকুটিরের বারান্দায় মোড়ার উপর বসে শুনছি ভিতরে স্টোভের শব্দ। কেনগরের মণি গাঙ্গুলি চা বানাচ্ছে। সামনে, গৌরপ্রাঙ্গণ পেরিয়ে, লাইব্রেরির বারান্দায় ঈষৎ প্রাণচাঞ্চল্য আরম্ভ হয়েছে। বৈতালিকের মূলগায়েন শ্রীযুক্ত অনাদি দস্তিদার (পরবর্তী যুগে খ্যাতিপ্রাপ্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতজ্ঞ) ও দোহারদের ফুলু রায় গান বাছাই করছেন। পূজনীয় বিধু-ক্ষিতি-হরি একটু পরেই আসবেন।
তখনকার দিনে প্রথা ছিল, যারা গত চব্বিশ ঘণ্টার ভিতর এই প্রথম আশ্রমে এসেছে তারা ভোরের বৈতালিকে উপস্থিত হত। আমাদের দলটা গুঁড়ি গুডিদের তুলনায় ছিল সংখ্যালঘু। অবশ্য আমরা দম্ভভরে গুরুদেবকেই উদ্ধৃত করে বলতুম, The rose which is single need not envy the thorns which are many. কিন্তু তক্কে তক্কে থাকতুম, দল বাড়াবার জন্য।
হঠাৎ চোখ পড়ল নয়া মালের দিকে। দুর থেকে মনে হল চেহারাটা ভালোই ভালোমানুষ। জানালা দিয়ে ভিতরের গাঙ্গুলিকে বললুম, এসেছে রে। গাঙ্গুলি এক ঝলক তাকিয়ে নিয়ে গান ধরল,
শুনে তোমার মুখের বাণী
আসবে ছুটে বনের প্রাণী—
অর্থাৎ বিশ্বভারতীর ডাক শুনে বনের প্রাণীরা এসে জুটেছে!
ইনিই হলেন আমাদের নটরাজন।
দুপুরবেলা খাওয়ার পর তাকে গিয়ে শুধালুম, টেনিস খেলতে জানো? বড়ই গাইয়া– মাস ছয় পূর্বে আম্মা ছিলুম, এবং বললে পেত্যয় যাবেন না, এখনও আছি– হকচকিয়ে ইয়েস ইয়েস, নো নো, ইয়েস ইয়েস বলল। র্যাকেট নেই? কুছ পরোয়া ভি নেই, আমারটা দোবখন। এর পর ভাব হবে না কেন?
তবে লাভ হল না। কলাভবনের ছাত্র। আমাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় কম। তবে দেখলুম, বাউণ্ডুলে স্বভাব ধরে। যখন-তখন স্কেচবই নিয়ে খোয়াইডাঙার ভিতর ডুব মারে। সঁওতাল গ্রাম থেকে ডিম কিনে এনে গোপনে যে সেদ্ধ করে খাওয়া যায় আশ্রম তখনও নিরামিষাশী– সেটা ওকে শিখিয়ে দিলুম। সে তো নিত্যি নিত্যি খোয়াই পেরিয়ে সাঁওতাল গাঁয়ে যায় তার পক্ষে ডিম জোগাড় করা সহজ।
কিন্তু ওই গোবেচারাপারা ছোঁড়াটা পেটে যে কত এলেম ধরে সেটা অন্তত আমার কাছে ধরা পড়ল অল্পদিনের ভিতর। আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে অনেকক্ষণ অবধি এদিক থেকে, ওদিক থেকে, এগিয়ে পিছিয়ে পর্যবেক্ষণ করে তুলল দুটি ফটো। পরে প্রিন্ট দেখে আমার চক্ষুস্থির। এ যে, বাবা, প্রফেশনালেরও বাড়া! এবং আজ আমি হুনুরের দেবতা বিশ্বকর্মাকে সাক্ষী মেনে বলছি, পরবর্তী যুগে কি বার্লিন কি লন্ডন কেউই টেকনিক্যালি আমার এমন পারফেক্ট ছবি তুলতে পারেনি এবং স্মরণ রাখবেন, নটরাজনের না ছিল কৃত্রিম আলো বা স্টুডিয়ো।
এর পর যা দেখলুম সে আরও অবিশ্বাস্য। নটরাজনের অন্যতম গুরুর প্রথম মেয়ের বিয়ে। কোথায় গয়না গড়ানো যাবে সেই নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। স্বল্পভাষী নটরাজন অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ শোনার পর বলল, আমাকে মালমশলা দিন। আমি করে দিচ্ছি। সবাই অবাক; তুমি শিখলে কোথায়? বলল, শিখিনি, দেখেছি কী করে বানাতে হয়। নন্দলাল চিরকালই অ্যাডভেঞ্চার-একত্সপেরিমেন্টের কলম্বাস দিলেন হুকুম, ঝুলে পড়।