শেষটায় বিশ্বাস করেছিলেন বটে, কিন্তু আমি না পৌঁছানো পর্যন্ত কারও কারও মনের ধোকা কাটেনি।
রাত্রে ছাতের উপর পাশাপাশি শুয়ে আছি দুজনাতে। আমি বললুম, চিন্নি, ঘুমুলি?
না।
আর তোর মা?
বিশ্বাস করবিনে, সেটা ভারি ইনট্রেটিং। জগন্নাথ রাওয়ের তার পৌঁছানোর পর থেকেই মায়ের মুখে শুধু এক বুলি, কিছুতেই হতে পারে না। আমার ছেলে নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। এই তো বছরের পয়লা দিনে আমি গণকার ঠাকুরকে ফি-বছরের মতো এবারও সবকটা ছেলের কোষ্ঠী দেখিয়েছি। তিনি এবারও বলেছেন, চিন্নির সামনে ফড়াটি পর্যন্ত নেই।
চিন্নি বলল, যখন পুরুতঠাকুর শ্রদ্ধের ব্যবস্থা করতে এসেছে তখনও তার মুখে ওই এক বুলি, কী হবে এসব ব্যবস্থা করে? গণকার বলেছে, এ বছরে চিন্নির জ্বর-জ্বালাটি পর্যন্ত নেই।
কে তাঁর সঙ্গে কথাকাটাকাটি করে বোঝাবে চিনি নেই?
আর শ্রাদ্ধে যা টাকা খরচা হওয়ার কথা ছিল সেটা মা দিয়েছে গণৎকারকে।
নটরাজনের একলব্যত্ব
বর্ষা নামার সঙ্গে সঙ্গেই পদ্মার উপর দিয়ে পুরবৈয়া বায়ু বইতে আরম্ভ করে না। সে হাওয়া আসে দিন আষ্টেক পরে। কিন্তু তখনই সাড়া পড়ে যায় বন্দরে বন্দরে মাঝি-মহল্লায়। হালের বলদ, পালের গরু বিক্রি করে তারা তখন কেনে নৌকোর পাল। পুরনো পালে জোড়াতালি দিয়ে যেখানে চলে যাওয়ার আশা, সেখানে চলে কাঁথার উঁচ আর মোটা সুতো। তার পর আসবে ঝোড়ো বেগে পুব হাওয়া। দেখ তো না দেখ, নারায়ণগঞ্জ নৌকো পৌঁছে যায় রাজশাহী। বিশ্বাস করবেন না, স্রোতের উজানে, তর তর করে।
আমিও বসে আছি হাল ধরে, পাল তুলে হাওয়া এই এল বলে। নোঙর নিইনি। এই শেষ যাত্রায় যেতে হয় এক ঝটকায়। কোথাও থামবার হুকুম নেই।
নাতি ডাবাটি এগিয়ে দিয়ে বলল দাদু, তামুক খাও।
হাওয়ার আশায় বসে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত আনন্দ-আবেশে ভরে যায়।
নাতি বলল, দাদু, সারাজীবন ধরে পদ্মার উজান-ভাটা করলে। কত লোকের সঙ্গেই না তোমার দোস্তি হল। বাড়িতে থেকে খেত-খামার করে দোকানপাট চালালে তো অতশত লোকের সঙ্গে তোমার ভাবসাব হত না– আর বিদেশিই বা কিছু কম। কঁহা কঁহা মুলুকের রঙবেরঙের চিড়িয়া। আমারে কও, তাদের কথা।
আমি পদ্মা নদীর মাঝি নই। কিন্তু আমার জীবনধারা বয়ে গেছে পদ্মার চেয়েও দেশদেশান্তরে। কত না অদ্ভুত অদ্ভুত পরিস্থিতি, কত না বিচিত্র চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এখন পাল তুলে ওপারে যাবার মুখে ভাবছি, এঁদের কারও কারও সঙ্গে আপনাদেরও পরিচয় করিয়ে দিই। কারণ এদের সম্বন্ধে অন্য কেউ যে মাথা ঘামাবে সে আশা আমার কম– প্রচলিতার্থে এঁরা দেশের কুতুবমিনার নন। অথচ আমার বিশ্বাস এঁরা যদি সত্যই এমৃবিশাস হতেন তবে আজ আমার মতো অখ্যাত জনের কাঁধে এঁদের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবার ভার পড়ত না, আর পড়লেও সেটা আমি গ্রহণ করতুম না। কারণ এদের আমি ভালোবেসেছিলুম এঁরা লাওৎসের চেলা বলে। তারই উপদেশমতো এঁরা জীবনের মধ্য-পথ অবলম্বন করেছিলেন। পাঁচজনের সঙ্গে মিলেমিশে, আপন প্রতিভা যতদূর সম্ভব চাপা রেখে গোপনে গোপনে তার পরিপূর্ণ বিকাশ দেবার চেষ্টা করেছেন। বাধা পড়লে পড়াই দিতেন মোক্ষম, কিন্তু সর্বক্ষণ এঁদের চরিত্রে একটা বৈরাগ্য ভাব থাকত বলে মনে মনে বলতেন, হলে হল, না হলে নেই।
কিন্তু আমাকে একটু সাবধানে, নাম-পরিচয় ঢেকে চেপে লিখতে হবে। পূর্বেই ইঙ্গিত দিয়েছি এরা জীবন-সভাস্থলে প্রধান অতিথির আসনে বসে ফুলের মালা পরতে চাননি, তাই পাঠক সহজেই বুঝে যাবেন, কারও লেখাতেও তারা হ্যাঁমলেট, রঘুপতি হতে চান না– আমার নাতিপরিচিত লেখাতেও না।
মনে করুন তার নাম নটরাজন। তার পিতা ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মচারী, আশা করেছিলেন ছেলেও তাঁর মতো চারটে পাস দিয়ে একদিন তারই মতো বড় চাকরি করবে। অন্যায্য আশা করেননি, কারণ নটরাজন ক্লাসের পয়লা নম্বরি না হলেও প্রোমোশন পেত অক্লেশে, আর একটা বিষয়ে স্কুলের ভিতরে-বাইরে সবাইকে ছাড়িয়ে যেত অবহেলে। ছবি আঁকাতে। তার অঞ্চলে এখনও দেওয়ালে রঙিন ছবি আঁকার (মুরাল) রেওয়াজ আছে। তারই ওস্তাদ পটুয়ারা স্বীকার করতেন, নটরাজনের চতুর্দশ পুরুষে যদিও কেউ কখনও ছবি আঁকেননি– তাঁরা খানদানি, পটুয়া হতে যাবেন কোন দুঃখে– এ ছেলে যেন জন্মেছে তুলি হাতে নিয়ে। শুধু তাই না– প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে এদেশে যখন হরেকরকম রঙের অভাব চরমে পৌঁছেছে তখন নটরাজন দেশের কাদামাটি কাঁকর পাথর ফুলপাতা থেকে বানাতে আরম্ভ করল নানা রকমের রঙ। এটা ঠিক আর্টিস্টের কাজ নয়– এর খানিকটে কেমিস্ট্রি, বাকিটা ক্রাফটসম্যানশিপ। পটুয়ারা নটরাজনকে প্রায় কোলে তুলে নিলেন। তখন তার বয়েস বারো-তেরো।
রবিবর্মা তার অঞ্চলেরই লোক। ওঁর ছবি কিন্তু নটরাজনকে বিশেষ বিচলিত করেনি। হঠাৎ একদিন সে দেখতে পেল নন্দলালের একখানা ছবি। জঘন্য রিপ্রডাকশন রেজিস্ট্রেশন এতই টালমাটাল যে মনে হয় প্রিন্টার তিনটি বোতল টেনে তিনটে রঙ নিয়ে নেচেছে।
নটরাজন কিন্তু প্রথম ধাক্কায় স্তম্ভিত। দ্বিতীয় দর্শনে রোমাঞ্চিত। মধ্য রজনী অবধি সে ছবিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।
নটরাজন ছিল অসাধারণ পিতৃভক্ত। তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে পিতা কী আশা পোষণ করেন সে তা জানত। কী করে তাকে বলে যে সে তার গুরুর সন্ধান পেয়ে গিয়েছে; সর্বস্ব ত্যাগ করে তাঁর পদপ্রান্তে তাকে যেতেই হবে। তদুপরি কোথায় মালাবার আর কোথায় শান্তিনিকেতন!