জগন্নাথ রাও টলতে টলতে বেরিয়ে এলেন। চিনি ওয়ালটেয়ারে আরেকবার এই রকম খেলার মাঠে বেহুঁশ হয়।
রাস্তা থেকে আবার ফিরে গেলেন ছোকরাটির কাছে। শুধোলেন, তার বাড়িতে তার পাঠানো হয়েছে? ছোকরাটি বলল সে জানে না।
জগন্নাথ রাও মেসে ফিরে এসে শয্যা নিলেন। দেশবাসীরা পরামর্শ করে তাঁর কথামতো চিন্নির বাড়িতে তার পাঠালেন দুঃসংবাদটা জানিয়ে।
জগন্নাথ রাওয়ের কোনওই ইচ্ছা আর রইল না শান্তিনিকেতন যাবার, কিন্তু তিনি পরিবারের বন্ধু এখন এতদূর কলকাতা অবধি এসে যদি সবিস্তার খবর নেবার জন্য সেখানে না যান তবে সবাই দুঃখিত হবেন।
নিতান্ত কর্তব্যের পীড়নে জগন্নাথ রাও হাওড়া গিয়ে, বোলপুরের ট্রেন ধরলেন।
বিকেলের দিকে যখন আশ্রমে পৌঁছলেন তখন গেস্ট হাউসে হিতলাল (বর্তমান কালোর দোকানের কালোর পিতা) ভিন্ন কেউ ছিল না–হিতলাল ইংরেজি জানে না। জগন্নাথ বিছানাপত্র সেখানে রেখে বেরুলেন কলাভবনের সন্ধানে। চিনি তাঁকে কলাভবনের ঠিকানা দিয়ে চিঠি লিখত।
সে কলাভবন বাড়ি আর নেই। তবে তার ভিতটা এখনও দেখতে পাওয়া যায়, গুরুদেবের দেহলী বাড়ির কাছে, বোলপুর যাবার রাস্তার পাশে।
কলাভবন সে সময়টায় নির্জন থাকে। নিচের তলায় কাউকে না পেয়ে তিনি সিঁড়ি দিয়ে ল্যান্ডিঙে পৌঁছে সেখান থেকে উপরের দিকে তাকিয়ে দেখেন—
আমি যাচ্ছিলুম বোলপুর নস্যি কিনতে; হঠাৎ শুনি, সেই অবেলায় কলাভবনে শোরগোল, স্পস্ট চিনতে পেলুম আর্টিস্ট রমেন চক্রবর্তীর গম্ভীর গলা। কিন্তু আর্ত কন্ঠে… তুমি যাও, শিগগির যাও, জল নিয়ে এস। আমি ততক্ষণে দেখছি–
তিন লক্ষে সেখানে পৌঁছে দেখি, চিন্নি দেহলী বাড়ির দিকে কালবোশেখী বেগে ছুটেছে। আমি সেদিকে খেয়াল না করে সিঁড়ি বেয়ে মাঝখানে উঠে দেখি কে একজন লোক দু-পা ইয়া ফাঁক আর দু-হাত ইয়া লম্বা করে ধূলি-শয়নে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। জোয়ারের সমুদ্র বেলাতটকে মড়া ফিরিয়ে দিলে সে যেরকম শুয়ে থাকে। ঠোঁটদুটো তার কাঁপছে, আর বিড়বিড় করে বলছে, চিন্নি, চিন্নি! চক্রবর্তী বললেন, সে আবার কী? তিনি বিশ্বনাথ রাওয়ের ডাকনাম জানতেন না। আমি বুঝিয়ে বললুম। চক্রবর্তী বললেন, দেখো তো সৈয়দ, ডাক্তার এসেছে কি না, বিকেলে তো মাঝে-সাঝে আসে। আমি বললুম, দেখি, মনে তো হচ্ছে ভিরমি কেটে যাচ্ছে।
খানিকক্ষণ পরে ফিরে এসে দেখি, ওদের কেউই আর সেখানে নেই।
চিন্নি ভালো অভিনয় করতে জানে। রাত্রে তার ঘরে সে দেখাল জগন্নাথ রাও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ তাকে দেখে সে আর চক্রবর্তী তখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন– থমকে গিয়ে কাঁপতে লাগলেন। দু হাত দু দিকে দুটো হাঁটুর সঙ্গে একতালৈ মৃগী রুগির মতো কাঁপতে কাঁপতে ধপাস। চিন্নি বলল, অবশ্য আমার মুখেও জগন্নাথ বিস্ময় দেখতে পেয়েই ভয় পেয়েছিল আরও বেশি। ভাগ্যিস রমেনবাবু সঙ্গে ছিলেন! আমাকে ওই আবছায়া আলোতে একলা-একলি দেখতে পেলে তার কোনও সন্দেহ থাকত না যে, আমার ভূত কলাভবনের মায়া কাটাতে না পেরে সন্ধ্যার নির্জনে সেখানে আবার এসেছে।
হঠাৎ দেখি জগন্নাথ রাওয়ের মুখ এক্কেবারে রক্তহীন, মাছের পেটের মতো পাঁশুটে হয়ে গিয়েছে। কাঁপতে কাঁপতে যা বললেন তা শুনে রমেনবাবুর মতো ঠাণ্ডা মাথা স্থিরবুদ্ধির লোক পর্যন্ত অচল দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এতক্ষণে জগন্নাথের খেয়াল গেছে যে, তিনি চিন্নির বাপ-মাকে তার করে জানিয়ে বসে আছেন যে, চিন্নি নেই।
আমি তেড়ে বললুম, আপনি তো আচ্ছা– নেভার মাইন্ড!–রাও তো আপনাদের দেশে প্রত্যেক সেকেন্ড ইডিয়ম।
জগন্নাথ বার বার বলেন, চিন্নি তো আমায় জানায়নি যে আরেকজন অন্ধ্রবাসী এসেছে। তার ওপর ফুটবল, তার পর পেটে
রমেনবাবু গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ওহে! এতক্ষণ তো খুব রগড় করলে! শোন, ব্যাপারটা সিরিয়াস! অ্যান্ড্রজ সাহেবের কাছে যাও। আর কারও টেলিগ্রাম বাপ-মা বিশ্বাস না-ও করতে পারেন। গুরুদেব তো বার্লিনে!
সাহেব মোটেই চটলেন না। নাস্তিক চিন্নির জন্য খাঁটি খ্রিস্টান ছ পাতা লম্বা তার করলেন সব বুঝিয়ে। আর আমি চিন্নিকে তাঁর সামনেই বললুম, এবার প্রার্থনা করোগে, বাড়িতে যেন ভালো-মন্দ কিছু একটা না হয়। দুই অন্ধ ভাইজ্যাগ বাগের ট্রেন ধরলেন।
চিন্নি ফোককে ছুটি মেরে হপ্তা তিনেক পরে ফিরল। আমরা শুধালুম, কী, আপন ছেরাদ্দ সাপটাবার মতো ঠিক সময়ে পৌঁছেছিলি তো? হুঁকোটা লে, খুলে ক!
চিন্নি বলল, টেলিগ্রাম পৌঁছেছিল দেরিতে। ইতোমধ্যে দাদাকে আনানো হয়েছে মাদ্রাজ থেকে। বাড়িতে কান্নাকাটি সে আর কি বলতে অবশ্য আমার শোনা কথা। যেদিন তার পৌঁছল সেদিন বামুন এসেছে শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করতে। আর ট্র্যাজেডিটা দেখ, বাড়িসুদ্ধ সবাই শোকে এমনি বিকল যে, কে একজন তারটা সই করে নিয়ে একপাশে রেখে দিয়েছে, ঘণ্টা দুই কেউ খোলেনি, ভেবেছে, কী আর হবে কন্ডলেন্স্ টেস্। খুলেছিল শেষটায় আমার ছোট ভাই। সে-ও নাকি প্রায় ওই জগন্নাথ রাওয়ের মতো পাঙাশ মেরে রাম ইডিয়টের মতো গা-গা ডাক ছেড়েছিল। বাকিরা ভাবল, আবার কে মরল? তার পর কেউ বিশ্বাস করে না তারটাকে, যদিও সবাই করতে চায়। অ্যানড্রজ সাহেব এত বিখ্যাত লোক, তিনি আমাদের চিন্নিটার জন্য ইত্যাদি…।