তদুপরি আরেকটি অতিশয় আশ্রমপ্রিয় সদগুণ তার ছিল, যার প্রসাদাৎ তিনি সর্বত্রই ককে পেতেন। উচ্চতায় যদ্যপি পাঁচ ফুট দুই, কিন্তু পেশিগুলো যেন মানওয়ারি জাহাজের দড়া দিয়ে তৈরি, এবং ফুটবল-চৌকস। বীরভূমের কাকরময় গ্রাউন্ডে ডজন খানেক আছাড় খেয়ে সর্বাঙ্গে রক্তলাঞ্ছন আঁকার পরও তিনি বুলেটবেগে ছুট লাগাতে কসুর করতেন না এবং হাসিমুখে। বিচক্ষণ জন সে হাসিতে নষ্টামির গোপন চিহ্ন দেখতে পেত।
আমাদের দোস্তি প্রথমদিন থেকেই। নাম যখন শুধালুম সেটা দ্রুতগতিতে দায়সারার মতো বলে নিয়ে জানাল, ওটা ভোলা নাম। আমার ডাকনাম চিন্নি। তোমার?
সীতু।
পরবর্তী যুগে চিন্নি, ওরফে মি. রাও, স্বৰ্গত শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে দিল্লিতে কাজ করে। তার ভুলে ভর্তি অনর্গল বাঙলা কথার তুবড়িবাজি রাশভারী শ্যামাপ্রসাদের মুখেও কৌতুকহাস্য এনে দিত এবং বিশেষ করে ওই কারণেই তিনি চিন্নিকে মাত্রাধিক স্নেহ করতেন। চিনি উত্তম ইংরেজি বলতে পারত, কিন্তু তার বক্তব্য, দিল্লির মন্ত্রণালয়ই হোক আর ভুবনডাঙার ঝুরঝুরে চায়ের দোকানই হোক, সে তার শান্তিনিকেতনে শেখা বাঙলা ছাড়বে কেন? স্বয়ং গুরুদেবের সঙ্গে সে বাঙলায় কথা কইত নির্ভয়ে চারটিখানি কথা নয়, এবং শ্যামাপ্রসাদ এই তত্ত্বটি আবিষ্কার করে, চিন্নির ডজন ডজন ভুল-ভর্তি বাঙলা সম্বন্ধে বলতেন, রাও কিন্তু তার বাঙলা প্রতিদিন ইমপ্রুভ করে যাচ্ছে। অর্থাৎ ভুল বাড়ছে!
শ্যামাপ্রসাদ মন্ত্রিত্ব রিজাইন দিলে পরে চিন্নিও তার জুতো থেকে দিল্লির ধুলো ঝেড়ে ফেলে মাদ্রাজ চলে যায়। সেখান থেকে ইউনেস্কোর আহ্বানে তাইল্যান্ড কলম্বো, জিনিভা, ওয়াশিংটন, বাগদাদে কীর্তিজাল বিস্তার করে।
সে যে দড়মালে তৈরি সেটা আশ্রমে তার আঠারো বছর বয়সেই ধরা পড়ে। সেখানে স্কুলের ছেলেরা দু বেলা উপাসনা করে, প্রস্তাব হল আমাদেরও করতে হবে। চিনি উচ্চকণ্ঠে জানিয়ে দিল সে নাস্তিক। ফৈসালা করার জন্য আমাদের মিটিং বসল। প্রিন্সিপাল মেসেজ পাঠালেন, তিনি চান, আমরা যেন উপাসনা করি। চিন্নি বলল, স্কুলের ছেলেদের বাপ-মা উপাসনার কথা জেনেশুনেই বাচ্চাদের এখানে পাঠিয়েছেন। আমাদের অধিকাংশই এসেছি তাদের অমতে (একথাটা খুবই খাঁটি; আমাদের গার্জেনদের অধিকাংশই ছিলেন সরকারি চাকুরে; তাঁরা অসহযোগ আন্দোলনে সায় দেন কী প্রকারে? আমার পিতাকে তো ইংরেজ রীতিমতো ভয় দেখায়)। আমরা সাবালক; আমি নাস্তিক। চিন্নি পার্লামেন্টেরেনও বটে– তার দোস্ত মসোজিকে চ্যালেঞ্জ করে বলল, তুমি তো ক্রিশ্চান; তোমার সর্ব প্রার্থনা পাঠাতে হয় প্রভু যিশুর মাধ্যমে। আশ্রমের উপাসনায় যোগ দেবে কী করে? আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই তো মিয়া ভাই (মুসলমান)! পাঁচবেকৎ নেমাজ করিস (করব বলে বাবার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে এসেছিলুম)। সভাপতির দিকে তাকিয়ে বলল, ওর ঘাড়ে আরও দুটো চাপানো কি ধর্মসম্মত? ইত্যাদি, ইত্যাদি। রেভারেন্ড অ্যানড্রজ আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন সভাকে রাজি করাতে। পাদ্রিসাহেবের যাবতীয় স্কিল, তদুপরি তাঁর সরল আন্তরিকতা, তিনি সবকিছু প্রয়োগ করে খুব সুন্দর বক্তৃতা দেন। কিন্তু ভোটে চিন্নিপন্থিরা কয়েকটি ভোটে জিতে গেল। তখন সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস হল, গুরুদেব যা আদেশ দেবেন তাই হবে। অ্যানদ্ভুজ সাহেবকেই আমরা দূত করে পাঠালুম।
গুরুদেব মাত্র একটি শব্দ উচ্চারণ করেন– না।
এই গেল চিন্নির পরিচয়।
ইতোমধ্যে আরেকটি ছেলে এল অন্ধ থেকে। মাধব রাও। সে-ও চমৎকার ফুটবল খেলে।
***
রাজ রাজমহেন্দ্ৰবরাম নগর– অর্থাৎ রাজমনড্রির শ্ৰীযুত জগন্নাথ রাও চিন্নির বন্ধু। তিনি চিন্নিদের বাড়ির ছেলের মতো। শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ব্রাহ্মছাত্র অন্ধ্রদেশের শ্রীযুক্ত চালাময় গুরুদেবের প্রচুর কবিতা গল্প উপন্যাস এবং বিশেষ করে তাঁর ধর্ম সম্বন্ধীয় রচনা অনবদ্য তেলেগুতে অনুবাদ করেন। জগন্নাথ রাও সেগুলো পড়ে আকণ্ঠ রবীন্দ্রভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। চিন্নির আশ্ৰমাগমনের ফলে তাঁর আশ্রমদর্শনের সদিচ্ছা প্রবলতর হল। চিন্নিকে আকস্মিক আনন্দদানের উদ্দেশ্যে তাকে কোনওপ্রকারের নোটিশ না দিয়ে শুধু চিন্নির পিতামাতাকে জানিয়ে এক শুভপ্রাতে রওনা দিলেন কলকাতা অভিমুখে।
কলকাতায় উঠলেন বড়বাজার অঞ্চলে এক অন্ধ মেসে। সেখানে শুধোলেন, শান্তিনিকেতন কী প্রকারে যেতে হয়? কেউ কিছু জানে না বলে টাইমটেবল জোগাড় করা হল– সেখানেও শান্তিনিকেতনের সন্ধান নেই। তখন একজন বলল, কাছেই তো পোয়েটের বাড়ি; সেখানে গেলেই জানা যাবে। শ্ৰীযুত জগন্নাথ রাও তাই করলেন। সেখানে দেখেন বিশ্বভারতী পাবলিকেশন্স দফতর খোলা বটে, কিন্তু লোকজন কেউ নেই। শেষটায় একটি ছোকরা কেরানিকে আবিষ্কার করা হলে সে বলল, হাওড়া থেকে যেতে হয়, সে কখনও ওখানে যায়নি। যারা যাওয়া-আসা করেন, তারা সবাই গেছেন শোনে। শান্তিনিকেতনের কে এক মিস্টার রাও সেই ভোরে হাসপাতালে মারা গেছেন।
জগন্নাথ রাও ত্রিভুবন অন্ধকার দেখলেন। সম্বিতে ফিরে আর্তকণ্ঠে শুধোলেন, কে? ছোকরাটি বলল, বড়ই দুঃখের বিষয়। মিস্টার রাও আশ্রমের হয়ে ফুটবল খেলতে যান শিউড়িতে। সেখানে খেলাতে জোর চোট লাগার ফলে তারা হার্নিয়া স্ট্রেনগুলেটেড় হয়ে যায়। অ্যান্ড্রজ সাহেব এখানকার হাসপাতালকে জরুরি চিঠি লিখে লোকজনসহ তাঁকে পাঠান কাল রাত্রে। সবই করা হয়েছিল, কিন্তু তাকে বাঁচানো গেল না।