শীতে যাতে তারা কষ্ট না পায় তার জন্য লেপের ব্যবস্থাও হল। মিরাৎ-ই-সিকন্দরির লেখক বলছেন, কিন্তু এসব লক্ষ্মীছাড়া ভ্যাগাবন্ডদের কেউ কেউ আপন আপন লেপ বিক্রি করে দিয়ে মদ খেত। খবরটা কী করে জানি হুজুরের কানে গিয়ে পৌঁছল। আমার মনে সন্দেহ হয়, হয়তো-বা আমাদের সেই সিনিক প্রধানমন্ত্রী উজির-ই-আজম্ সাহেবই মজা চেখে চেখে বাঁকা নয়নে তাকিয়ে হুজুরের অপব্যয়ের চরম পরিণামটি হুজুরেরই খেদমতে পেশ করেন!
তিনি নিজে করে থাকলে সেটা বুমেরাঙের মতো তারই কাছে ফিরে আসে। হুজুর বললেন, এটা কী করে ঠেকানো যায়, বল তো উজির। উজির অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ভাবখানা করলেন, স্বাধীন সম্রান্ত আসমুদ্র রাজস্থানব্যাপী গুর্জরভূমির মহামান্য সম্রাটের অতিমান্য প্রধানমন্ত্রী নেপাতা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারেন না! হুজুর কিন্তু উজিরের অতশত সূক্ষ্মানুভূতির পশ্চাদ্ধাবন করেন না। বললেন, রাতটা ভেবে দেখ। উজির-ই আলা যেভাবে কুর্নিশ করে বিদায় নিলেন তাতে মনে হল না যে, তিনি ত্রিযামা-যামিনী অনিদ্রায় যাপন করবেন।
পরদিন ফজরের নামাজের পরই, অর্থাৎ ব্রাহ্ম-মুহূর্তেই প্রধানমন্ত্রীর তলব পড়ল। হুজুর সহাস্য আস্যে তাঁকে বললেন, বুঝলে হে উজির সাহেব, আমিই কাল রাত্রে চিন্তা করে দাওয়াইটা বের করেছি। প্রত্যেককে আলাদা লেপ না দিয়ে চার-চারজনকে এক-একটা করে বড় লেপ দাও। চারজনই তো আর মদের গোলাম হবে না যে একজোট হয়ে লেপ বিক্রি করে দেবে। যারা খায় না তারা ঠেকাবে।
এ ধরনের চুটকিতে মিরাৎ-ই-সিকন্দরি ভর্তি। তাছাড়া দীর্ঘতর কাহিনীও এ কেতাবে আছে। এমনকি বিশাল বিরাট বীরপুরুষ মুহম্মদ বেগড়ার (এর গোঁফ নাকি এতই দীর্ঘ ছিল যে তিনি তার দুই প্রান্ত মাথা ঘুরিয়ে পিছনে এনে ঘাড়ের উপরে গিঠ বেঁধে রাখতেন!) যৌনজীবনও তিনি নির্বিকারচিত্তে সালঙ্কার বর্ণনা করেছেন। কিন্তু প্রাদেশিক ইতিহাস বলে, এ কেতাব তার ন্যায্য মূল্য পায়নি।
শেষ মোগলদের ইতিহাসে একটি অতিশয় হতভাগ্যের জীবন ও একটি ঈষৎ হাস্যরস-মিশ্রিত ঘটনা– এই দুই আমার মনে আসে। পুজোর বাজারে অন্য পত্রিকায় একটা করুণ রস লিখে আমার রেশন খতম। দ্বিতীয়টাই শুনুন।
পূর্বেই নিবেদন করেছি মোগলসম্রাট মাত্রেরই মৃত্যু হলে রাজপুত্রদের ভিতর লাগত যুদ্ধ। আওরেঙ্গজেবের মৃত্যুর পরও তার ব্যতিক্রম হল না। লড়াই জিতে বাদশাহ হলেন শাহ আলম বাহাদুর শাহ। পাঁচ বৎসর রাজত্বের পর তাঁর মৃত্যু হলে পুত্র জাহান্দার শাহ তখতে বসলেন। মোগল বংশের ওপর আর কেউ এর মতো কলঙ্ক-কালিমা লেপন করেননি। একটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি। একটি বাইজি– লালকুনওরকে তিনি দিয়েছিলেন বেগমের সম্মান ও তাঁকে নিয়ে বেরোতেন দিল্লির প্রকাশ্য রাস্তায় মদ্যপান করতে।* তখনকার দিনে আজকের পানওলার দোকানের মতো মদের দোকান থাকত– অর্থাৎ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চো করে একপাত্র মদ্যপান করে ফের অন্য দোকানে আরেক পাত্র করে করে বাড়ি পৌঁছানো যেত। কিংবা রাস্তায় গড়াগড়ি দেওয়া যেত। হুজুর বাদশাহ সালামত সেই বাইজি লালকুনওরের পাশে দাঁড়িয়ে এইসব অতি সাধারণ শ্রেণির দোকান ও তাদের খদ্দেরের সঙ্গে ঢলাঢলি করতে করতে পাত্রের পর পাত্র গলায় ঢালতেন এবং লালকুনওরের তো কথাই নেই। তিনি একদা যে হাফ-গেরস্থ অঞ্চলে (ফরাসিতে হুবহু একেই বলে দেমি-দ, এদের স্ত্রীলোক বাসিন্দা দেমিমঁদেন) তাঁর ব্যবসা চালাতেন, সেখানকার লোফাররা এসে সেখানে জুটত। বাদশাহ সালামত দরাজ দিলে ঢালাই পাইকিরি হিসেবে মদ্য বিতরণ করতেন। তখনকার দিনে দিল্লির বাদশারা বয়েলের গাড়ি চড়ে বেড়াতে ভালোবাসতেন। তার ড্রাইভারও সেই সর্বজনীন গণতান্ত্রিক পানোৎসবে অপাঙক্তেয় হয়ে রইত না। রাস্তায় ভিড় জমে যেত। আমির-ওমরাহ হঠাৎ এসে পড়লে পাল্কি ঘুরিয়ে নিতেন; পদাতিক ভদ্রজন এই বেলেল্লাপনার মাঝখানে পড়ে ব্ৰিত না হওয়ার জন্য গুত্তা মেরে ডাইনে-বাঁয়ের কোনও দোকানে আশ্রয় নিতেন।
[*এ যুগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পূর্বে হিটলারের প্রধান সেনাপতি ব্লমবের্ক বৃদ্ধ বয়সে ভালো করে অনুসন্ধান না করে তাঁর স্টেনোকে বিয়ে করে ফেলেন। অথচ ইনি একদা একাধিক শহরে দেমি-দেন ছিলেন। বিয়ের রাত্রে পৃথিবীর এই সর্বপ্রাচীন ব্যবসায়ের মেয়েরা তাদের পাড়ায়। পাড়ায় বিয়েটা সেলেব্রেট করে– যেন তারা সমাজে কল্কে পেয়ে গেল এবং শুধু তাই না, যেসব পুলিশ তাদের ওপর চোটপাট করত তাদের ফোন করে তাদের হেলথ ড্রিঙ্ক করে। পরে হিমলার দলিল-দস্তাবেজসহ হিটলারের কাছে কেলেঙ্কারিটা ফাস করলে পরে তিনি ব্লবের্ককে রিটায়ার করতে আদেশ দেন।]
মুসলমান শাস্ত্রে মদ্যপান নিষিদ্ধ। অবশ্য দেশবাসী জানত যে রাজা-বাদশারা এ আইনটি এড়িয়ে যান, কিন্তু তারাও চক্ষুলজ্জার খাতিরে খোলাখুলিভাবে সচরাচর মদ্যপান করতেন না। এ যুগে রাজা ফারুক প্রায় জাহান্দার শার মতো আচরণ করে কাইরোর জনসাধারণের আক্কেল গুডুম করে দেন। রোজার মাসে আবার বলছি উপবাসের মাসে তিনি তাঁর নিত্যপরিবর্তিত দেমি-দেন নিয়ে প্রশস্ত দিবালোকে এক বার থেকে আরেক বারে ঘুরে বেড়াতেন মাতা এবং প্রাসাদের অন্যান্য মুরুব্বিদের সর্ব সদুপদেশ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে। এরই পরিত্যক্তা এক দেমি-দেন প্রেয়সী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, এই মহাপুরুষটি গুরুভোজন বা অত্যধিক পানের ফলে গতাসু হবেন। বন্ন ভক্ষণ করে রাজ্যচ্যুত অবস্থায় ইনি অধুনা রোম শহর থেকে সাধনোচিত ধামে গেছেন– ঝিনুকের ভিতরকার বস্তু মাত্রাধিক খাওয়ার ফলে।