ইংরেজ ফারসিতে লিখিত ইতিহাসরাজির সবকটাকেই গণ্ডায় আণ্ডা মিলিয়ে নিন্দাবাদ করে বলেছে, এ-সবেতে আছে শুধু লড়াই আর লড়াই। বিবেচনা করি, ওগুলোতে যদি গণ্ডায় গণ্ডায় শান্তিকামী পীর-দরবেশ ঘুরে বেড়াতেন, কিংবা তার চেয়েও ভালো হত যদি রাজা-প্রজায় সবাই মিলে চাঁদনি চৌকে হাল্লেলুইয়া হৰ্ষরব তুলে ইংরেজের আগমনী গান ধরতেন, তা হলে বোধহয় শ্বেত সমালোচকেরা সন্তুষ্ট হতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে মোগলরা যে-ঐতিহ্য সঙ্গে এনেছিল সেটা তার বিকৃততমরূপে দেখা দিল তাদের পতনের সময়। ফলে স্বার্থে স্বার্থে যে সংঘাত উপস্থিত হল তার সমাধান যুদ্ধ ভিন্ন অন্য কোনও পন্থায় সম্ভব ছিল না। ঐতিহাসিকরা সেসব যুদ্ধের বর্ণনা না দিয়ে দি নেশন অব শপলিফটারসের জন্য সেই সঙ্কর্মের টেকনিক্ বয়ান করলে সত্যের অপলাপ হত।
কিন্তু এসব ইতিহাস শুধু যুদ্ধে যুদ্ধে ভর্তি ছিল একথা বললে আরেকটা খুব বড় সত্য গোপন করা হয়। এদের প্রচুর সাহিত্যিক মূল্যও যে ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
তার পূর্বেই একটি সত্য স্বীকার করে নিই। বিদেশাগত কিছু লোক ভিন্ন এদেশের কারওরই মাতৃভাষা ফারসি ছিল না। এবং মাতৃভাষা ভিন্ন অন্য ভাষাতে শত ভেল্কিবাজি দেখাতে পারলেও সেখানে সত্যকার সাহিত্য সৃষ্টি করা যায় না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ তত্ত্বও অনস্বীকার্য যে, সাহিত্য যে উপাদানে নির্মিত হয় তার অভাব ভারতবর্ষে রচিত ফারসি ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। তুলনা দিয়ে বলা যায়, রামায়ণের কাহিনী যত কাঁচা ভাষাতেই রচা হোক না কেন, তার চিত্তাকর্ষণী শক্তি কিছু না কিছু থাকবেই।
তাই ফারসি ভাষায় রচনাকারী ঐতিহাসিকরা হামেশাই কোনও বাদশার রাজত্বকালের তাবৎ লড়াই, বাদশার প্রসন্ন দৃষ্টি লাভের জন্য আমিরদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, কূটনৈতিক চতুরঙ্গ ক্রীড়ার মারপ্যাঁচ ইত্যাদি বর্ণনা করার পর পঞ্চমুখ হতেন বাদশার বিবাহের সালঙ্কার বর্ণনা দিতে; সেই উপলক্ষে সম্মিলিত কবিকুলের বর্ণনা দিতে, এবং সর্বশেষে বাদশার ব্যক্তিগত গুণাগুণের উল্লেখ করতে। সবসময় যে তারা নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে সমর্থ হতেন তা নয়, কিন্তু বাদশা সজ্জন হলে তাঁর গুণ বর্ণনায় পঞ্চমুখ হতে কোনও অসুবিধাই উপস্থিত হত না।
যেমন গুজরাতের এক বাদশা ছিলেন অত্যন্ত আচারনিষ্ঠ, পুণ্যশীল। তাঁর জীবিতাবস্থায়ই গুণমুগ্ধ প্রজাসাধারণ তাঁর নাম দেন অল-হালি পুণ্যশীল। মিরাৎ-ই সিকন্দরি গুজরাতের প্রখ্যাত ইতিহাস। তার লেখক অল-হালিমের সময়কালীন যুদ্ধবিগ্রহের বর্ণনা দেবার পর পরমানন্দে হুজুর বাদশার সর্বপ্রকারের পুণ্যশীল খামখেয়ালির বর্ণন-পর্বে প্রবেশ করেছেন। কে বলবে তখন আমাদের এই ঐতিহাসিক শুধু যুদ্ধবিগ্রহের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েই উল্লাস বোধ করেন। বস্তুত এই অনুচ্ছেদে প্রবেশ করার পর মনে হয় তাঁর যেন আর কোনও তাড়া নেই, মাথুরে পৌঁছনোর পর কীর্তনিয়ার যে অবস্থা হয়। এ ইতিহাস তাকে যে একদিন শেষ করে তামাম্ শুদৃ লিখতে হবে সে ভাবনা তার চৈতন্য থেকে যেন সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে।
হুজুর অল-হালিমকে এক বিদেশাগত পাঁচক এক নতুন ধরনের পোলাও খাওয়ালে পর হুজুর পরম পরিতৃপ্তি প্রকাশ করে বললেন, উজির! আমার প্রজারা কি কখনও-সখনও এ রকমের পোলাও খায়? উজির স্মিতহাস্য করে বললেন, হুজুর, তা কখনও হয়! হুজুর বললেন, একা একা খেয়ে আমি কেমন যেন সুখ পাচ্ছিনে। হুকুম দিলেন, মহল্লা মহল্লায় বিরাট বিরাট পাত্রে করে যেন হুবহু ওইরকমের পোলাও তৈরি করে তাবৎ আহমদাবাদবাসীদের খাওয়ানো হয়। আমাদের ঐতিহাসিকটি যেন ঈষৎ আমোদ উপভোগ করে ইঙ্গিত করেছেন, প্রধানমন্ত্রী হুজুরের এসব খামখেয়ালির অপব্যয় দেখে ভারি বিরক্ত হতেন।
তা সে যা-ই হোক-তাবৎ আহমদাবাদবাসী সেদিন কাজকর্ম ছেড়ে দিয়ে দিনভর ফিস্টি খেল। যে সাবরমতীর পারে বসে বহু যুগ পরে রবীন্দ্রনাথ ক্ষুধিত পাষাণ রচেছিলেন সেই সাবরমতীর পারে সেদিন আর কেউ ক্ষুধিত রইল না।
ঠিক ওইরকমই দিল্লির শেষ মোগলদের কোনও এক বাদশার বিয়ের শোভাযাত্রায় উঁচু হাতির পিঠ থেকে রুপো দিয়ে বানানো ফুল রাস্তার দু পাশের দর্শকদের উপর মুঠো মুঠো ছড়ানো হয়। ঐতিহাসিক খাফি খান–কিংবা খুশ হা-চন্দ বা অন্য কেউ হতে পারেন, আমার মনে নেই- যখন তার ইতিহাস লিখলেন তখন দিল্লির বড় দুঃখের দিন। সেই আঁকজমক শান-শওকতের স্মরণে যেন উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছেন, এ অধমও সেই দর্শকদের মধ্যে ছিল। সে-ও তার কুর্তার দাম (অগ্রভাগ, অঞ্চল) দু হাত দিয়ে প্রসারিত করে উদ্গ্রীব আকাক্ষায় প্রতীক্ষা করল। এ অধমের কী সৌভাগ্য, কী খুশ-কিস্মাৎ! আম্বো তিনটে ছোট ছোট ফুল পেয়ে গেলুম। জয় হোক দিল্লিশ্বরের! জগদীশ্বর তাকে দীর্ঘজীবী করুন!
এ যুগের ইতিহাস বিষাদময়, কিন্তু ঘটনাবহুল বলে একাধিক ফারসিজ্ঞ হিন্দুও তার সুদীর্ঘ বিবরণ লিখে গিয়েছেন। তার একটি ঘটনার বর্ণনা দেবার জন্য বক্ষ্যমাণ লেখন। কিন্তু তৎপূর্বে এক লহমার তরে আহমদাবাদ ফিরে যাই।
মিরাৎ-ই সিকন্দরি ইতিহাস বলে, অল্-হালিম্ আহমদাবাদের দুর্দান্ত শীতে লক্ষ করলেন, গৃহহীনদের দুরবস্থা। আদেশ দিলেন যে, প্রতি চৌরাস্তায় যেন সন্ধ্যার পর কাঠ পুড়িয়ে আগুন জ্বালানো হয়। বহু গৃহহীন এমনকি গৃহস্থও সেই আগুন ঘিরে বসে আগুন পোহাতে পোহাতে গাল-গল্প, গান-বাজনা করে রাত কাটাত। এতেও সন্তুষ্ট না হয়ে অল্-হালিম্ বৃহৎ আবাস নির্মাণ করে দিলেন– ভিখিরি-গরিবদের বসবাসের জন্য। ঐতিহাসিকরা বলতে পারবেন, এ ধরনের পুয়োর হোম পৃথিবীর এই সর্বপ্রথম কি না।