***
৫ জুলাই বনবিহারী পঞ্চভূতে লীন হন।
সাহিত্যিকশ্রেষ্ঠ বনফুল তার সম্বন্ধে দেশ পত্রিকার ১৫ই শ্রাবণ সংখ্যায় অতি অল্প কয়েকটি কথা বলেছেন, কিন্তু হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে, এবং তার প্রত্যেকটি শব্দ যেন আমার বুকের উপর হাতুড়ি পিটছে। আমি এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে যা প্রকাশ করতে সক্ষম হইনি, তিনি অল্প কথাতেই সেটি মূর্তমান করেছেন।
বঙ্গ সাহিত্য-ভাণ্ডারে তাঁর (বনবিহারীর) দান চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে। রাজনৈতিক সামাজিক কোনও অন্যায়ের সঙ্গে কখনও তিনি রফা করেননি। অনবদ্য তীক্ষ্ণ ভঙ্গিতে সে-সবের বিরুদ্ধে সাহিত্যিক প্রতিবাদ তিনি করে গেছেন। সেকালের ভারতবর্ষ, বঙ্গবাণী, শনিবারের চিঠি, বেপরোয়া প্রভৃতি সাময়িক পত্রিকাগুলির পৃষ্ঠায় তাঁর কীর্তি এখনও মণি-মুক্তার মতো ঝলমল করছে। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অনমনীয় দুর্বার প্রকৃতির লোক। কখনও কারও অন্যায় সহ্য করতে পারেননি। সুতরাং কারও সঙ্গে তিনি মানিয়ে চলতে পারেননি, কারও সঙ্গে তার বনেনি। এজন্যে শেষ জীবনে প্রায় একা একা নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে হয়েছে তাঁকে। অতিশয় বিচক্ষণ চিকিৎসক ছিলেন। সিভিল সার্জন হয়ে বগুড়া থেকে রিটায়ার করেন।… পৃথিবীতে নিখুঁত মানুষ নেই, নিখুঁত মানুষের সন্ধানেই তাঁর সারা জীবন কেটেছে। কিন্তু কোথাও সে মানুষ পাননি। নিঃসঙ্গ জীবনই কাটাতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর একটি ভাই তাঁকে ছাড়েননি। বন্ধুবিহারীই শেষ পর্যন্ত ছিলেন তার সঙ্গে। শেষে তিনি নিজের ঠিকানাও কাউকে জানাতেন না। গত ৫ জুলাই তিনি মারা গেছেন।
বনফুল তো চেনে বনবিহারীকে। আর এই বনবিহারী নাম সার্থক দিয়েছিলেন তার গুরুজন! জনসমাজে বাস করেও তিনি যেন সারাজীবন বনেই বিহার করলেন।
আমার আর মাত্র দুটি কথা বলার আছে।
বনবিহারী যে হিন্দু-সমাজ ও বাঙালির কঠোর সমালোচনা করে গিয়েছেন তার কারণ এই নয় যে, তিনি এই দুটিকেই পৃথিবীর নিকৃষ্টতম বলে মনে করতেন। তিনি নিজেকে প্রফেট বা রিফর্মার বলে মনে করতেন না। কাজেই বিশ্বভুবনের তাবৎ জাড্য দূর করার ভার আপন স্বন্ধে তিনি তুলে নেননি। এমনকি তার হাতের আলোটিও তিনি উঁচু করে তুলে ধরেননি। সে-আলো তাই পড়েছিল মাত্র তার আশপাশের সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, সাহিত্যের ওপর। তারই মলিনতাটুকু তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন মাত্র। তবুও আমার মনে হয়েছে, তিনি রবীন্দ্রনাথের জ্যাঠামশাই ও রলাঁর জ্যাঁ ক্রিসতফ-এর সমন্বয় কোনও কোনও ক্ষেত্রে। জ্যাঁ ক্রিসতফ বনবিহারীর অন্যতম প্রিয় পুস্তক (ডাক্তার হয়েও সিরিয়াস ডাক্তাররা সাহিত্যচর্চার সময় পান কম– তিনি সম্পূর্ণ নিজের সাধনায় বিশ্বসাহিত্যের কতখানি আয়ত্ত করেছিলেন সেটা বোঝাবার চেষ্টা করব না)।
আজ তিনি জীবিত নেই, তাই বলবার সাহস পাচ্ছি, তিনি বাঙালিকে ভালোবাসতেন। তাঁর জীবিতাবস্থায় একথা বললে তিনি বোধহয় আর আমার মুখ দর্শন করতেন না। বাঙালি বলতে তিনি হিন্দু বিশেষ করে তথাকথিত নিম্নশ্রেণির হিন্দু-মুসলমান, ইলিয়ট রোড অঞ্চলের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, সকলকেই বুঝতেন।
এইবারে আমার শেষ বক্তব্যটি নিবেদন করি। এ কথাটি তার জীবিতাবস্থায় বললে তিনি সুনিশ্চিত রামদা নিয়ে আমার পশ্চাদ্দেশে ধাবমান হতেন।
ইংরেজিতে বলে– মিল্ক অব হিউমেন কাইনেস্।
অনিচ্ছায় বলছি, কিন্তু এস্থলে বলার প্রয়োজন, আমি বিস্তর দেশ-বিদেশ দেখেছি। বহু সমাজসেবী, হাসপাতাল চালক মিশনারি, রেডক্রসের একনিষ্ঠ সেবক কর্মী, সর্বত্যাগী মহাজন, স্তালিনগ্রাদের বিভীষিকাময় রক্তাক্ত রণাঙ্গন-প্রত্যাগত সার্জনকে আমি চিনি। বনবিহারীর হৃদয়ের অতিশয় গোপন কোণে যে ভুবন-জোড়া স্নেহমমতার ভাণ্ডার ছিল– সেরকম তো আর কোথাও দেখলুম না। সেই স্নেহমমতাই তাঁর আপন সুখশান্তি হরণ করেছিল। সেই বেদনাবোধই তাঁকে উত্তেজিত করত খড়গ ধারণ করে অন্যায়, অসত্য, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে।
এই স্নেহমমতা তিনি এমনই সঙ্গোপনে রেখেছিলেন যে, অধিকাংশ লোকই তাঁর কঠোর ভাষা, তীব্র কণ্ঠ, নির্মম ব্যঙ্গ শুনে বিভ্রান্ত হয়েছে। বনবিহারীর সে জন্য কণামাত্র ক্ষোভ ছিল না। তাঁর সহানুভূতি তিনি রাখতেন আরও গোপন করে।
আমরা বোধহয় অত্যন্ত সহিষ্ণু। কিংবা যথেষ্ট ইতিহাস পড়িনি। নইলে সোক্রাতে খ্রিস্টের জন্য একদা যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল বনবিহারীর জন্য সেটা করা হল না কেন?
কিন্তু এই অনুভূতিগত অভিজ্ঞতা গদ্যে প্রকাশ করা যায় না।
বনবিহারীর প্রয়াণ উপলক্ষে বনফুল যে সনেটটি লিখেছেন সেটি উদ্ধৃত করি :
‘বনবিহারী মুখোপাধ্যায়’
পাষাণে আঘাত হানি, অসি তীক্ষ্ণধার চূর্ণ-বিচূর্ণ হল? কঙ্কর কন্টক
জয়ী হল বিক্ষত করিয়া বার বার বলিষ্ঠ পথিক-পদ? ধূর্ত ও বঞ্চক সাধুরে লাঞ্ছিত করি বিজয়-কেতন আস্ফালন করিল আকাশে? অন্ধকার গ্রাসিল কি রবি? না– না– নতি-নিবেদন করি পদে উচ্চকণ্ঠে কহি বারংবার নহে ব্যর্থ, পরাজিত, হে বহ্নি-কমল তমোহন্ত্রী, হে প্রদীপ্ত মশাল-বর্তিকা, অগ্নি তব অনির্বাণ, চির-সমুজ্জ্বল, অনবদ্য অপরূপ ঊর্ধ্বমুখী শিখা। মহাপ্রস্থানের পথে বিগত অর্জুন অস্ত্রাগারে রেখে গেছে শরপূর্ণ তূণ।
কোষ্ঠী-বিচার
আমি তো রেগে টং।
মুসলমান বাড়িতে সচরাচর গণস্কার আসে না, যদিও শুনেছি ঔরঙ্গজেবের মতো গোড়া মুসলমান, হিটলারের মতো কট্টর বিজ্ঞান-বিশ্বাসীরা নাকি রাশিকুণ্ডলী মাঝে-মধ্যে দেখে নিতেন। আমাদের বাড়িতে গণস্কার এসেছিল। তা আসুক। মেয়েরা জটলা পাকিয়েছিল। তা পাকাক। কাউকে রাজরানি, কাউকে রাজেশ্বরী, কাউকে ডাক্তার হওয়ার আশা দিয়ে গিয়েছে তা দিক, তাতেও আমার আপত্তি নেই। আমি রাগে টং হলুম যখন শুনলুম, পাশের বাড়ির আট বছরের মেয়ে মাধুরীলতা, আমার বোনের ক্লাসফ্রেন্ড, সে-ও নাকি এসেছিল এবং গণকার বলেছে, তার কপালে বাল-বৈধব্য আছে।