ডন কুইকসটের সঙ্গে বনবিহারীর মাত্র একটা বিষয়ে পার্থক্য। বিস্তর মধ্যযুগীয় রোমান্টিক কাহিনী পড়ে পড়ে ডনের মাথা গরম হয়ে যায়। তিনি ভাবলেন তিনি সে যুগের শিভালরাস্ নাইটদের একজন। ব্যস, আর যাবে কোথায়। দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে একাকী, সম্পূর্ণ একা তিনি খোলা তলওয়ার হাতে আক্রমণ করলেন জলযন্ত্রকে (উইন্ডমিলকে)।
তারও বহু পরে যিনি এ-যুগের সর্বশেষ নাটক বলে নিজেকে প্রচার করেন তিনি ফিল্ড মার্শাল হেরমান গ্যেরি নর্নবের্গ মোকদ্দমায়। তাঁর কৃতিত্ব : জর্মনিতে তিনিই সর্বপ্রথম কনট্রেশন ক্যাম্প স্থাপনা করেন (অবশ্য তার বহু পূর্বে ইংরেজ করেছিল বোয়ার-যুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকায়) এবং আইষমানের ইহুদিহননে তার সম্মতি ছিল। নিহত ইহুদিদের ভিতর লক্ষাধিক কুমারী কন্যাও ছিল।
বনবিহারী কপিল-জীন-চার্বাক পড়ে পড়ে ডনের মতো মাথা গরম করেননি। ধীরস্থির মনে চিন্তা করে, মীমাংসায় পৌঁছে তিনি আক্রমণ করলেন বঙ্গদেশের জগদ্দল জাড্যকে। এখনও তার মাথা কতখানি ঠাণ্ডা সেটা বোঝা যায় এর থেকে যে, তখনও তার ঠোঁটে হাস্য-ব্যঙ্গ-রস– তাঁর নব-প্রকাশিত নাস্তিক্য প্রচারকামী পত্রিকা বেপরোয়ার (বাঙলা দেশে
এ ধরনের কাগজ বোধহয় এই প্রথম আর এই শেষ) প্রথম সংখ্যায় প্রথম war song-এ তিনি বললেন,
টুলবো না কো অনুস্বার আর বিসর্গের
ঐ ছররাতে
কিংবা দেখে টিকির খাড়া সঙ্গীন!
সে পত্রিকায় কী না থাকত? ধর্ম, দর্শন, নীতিশাস্ত্র থেকে আরম্ভ করে সাহিত্য, চিত্র– এস্তেক পদিপিসির মাদুলি, হচি-টিকটিকি। এর পূর্বে তিনি ভারতবর্ষে ব্যঙ্গচিত্রসহ বঙ্গজীবনবৈচিত্র্য তাবলো পদ্ধতিতে প্রকাশ করেছেন : তার একটি ছিল কেরানি– লোলচর্ম অস্থিসার জীর্ণবেশ রুক্ষ-কেশ কেরানির ছবির নিচে ছিল–
চাকরি গেল, চাকরি গেল, চাকরি রাখা
বিষম দায়
ঐ গো, বুঝি নটা বাজে, ওই গো বুঝি
চাকরি যায়।
বিজলি-বাতির ফানুস হেন ঠুনকো
মোদের চাকরি ভাই!
ফট করে সে ফাটে, কিন্তু ফাটার শব্দে
চমকে যাই।
সর্বশেষে কেরানি যেন বৈদ্যগুরু, কবিরাজ, ডাক্তার, মহামান্য শ্ৰীযুত বনবিহারী মুখোপাধ্যায়কেই ব্যঙ্গ করে বলছে (উইথ ও টুইস্টেড আইরিশ স্মাইল)–
ভরা পেটে ছুটতে মানা? চিবিয়ে খাওয়া স্বাস্থ্যকর?
চাকরি আগে বাচাই দাদা, প্রাণ বাঁচানো সে তার পর।
রবীন্দ্রসৃষ্টির সঙ্গে আমি ঈষৎ পরিচিত। রবীন্দ্ররসিকদের রচনা আমি পড়েছি। অধুনা রবীন্দ্ৰায়ণও (অত্যুকৃষ্ট প্রবন্ধ সংকলন, তদুপরি অতুলনীয় সম্পাদন) অধ্যয়ন করেছি। তার পরও বলব, মুক্তকণ্ঠে বলব, বনবিহারীর মতো রবীন্দ্রসৃষ্টির চৌকস সমঝদার আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। তাই আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের যেসব বিরুদ্ধ সমালোচনা বেরিয়েছে, তার মধ্যে বনবিহারীর সমালোচনাই সর্বোকৃষ্ট। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথের অন্য সমালোচকদের প্রতি তিনি ছিলেন হাড়ে হাড়ে চটা। বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলতেন, রসসৃষ্টির পথে যত সব অবান্তর বস্তু নিয়ে বর্বস্য শক্তিক্ষয়! রবীন্দ্রনাথ নাকি নগ্ন যৌনের অশ্লীল ছবি আঁকেন– তা তিনি আঁকেননি। আর যদি আঁকেনই বা, তাতেই-বা কী? এসব তো সম্পূর্ণ অবান্তর- রসসৃষ্টি হলেই হল! রবীন্দ্রনাথের রূপক নাকি অস্পষ্ট! তা হলে চশমা নাও– ওঁকে দোষ দিচ্ছ কেন?
তার পর বুঝিয়ে বলতেন, দে আর অল বার্কিং আপ দি রং ট্রি–অর্থাৎ বেড়ালটা উঠেছে একটা গাছে, আর কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে অন্য গাছের গোড়ায়।
সত্যেন দত্তকে আজকের দিনে তোক আর স্মরণে আনেন না; অথচ তিনি যখন সবে আসরে নেমেছেন, সেই সময় থেকেই বনবিহারী তার প্রশংসা গেয়েছেন। সেই সত্যেন দত্তই যখন এই শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে মাঝে মাঝে অনুপ্রাস ও ছন্দের ম্যাজিকের (জাগলারি) কেরদানি দেখাতেন, তখন বনবিহারী অতিষ্ঠ হয়ে বেপরোয়াতে অপ্রিয় সমালোচনা করেন। আমরা তখন তাকে বলি, এগুলো নিছক এক্সপেরিমেন্ট জাতীয় জিনিস; আপনি অত সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন? আরেক টিপ নস্য নিয়ে– এইটাই ছিল তাঁর একমাত্র বদঅভ্যাস, আর ওই করে করে করেছিলেন তাঁর কণ্ঠস্বরের সর্বনাশ বললেন, তা হলে ছাপানো কেন? যে প্রচেষ্টা রসের পর্যায়ে ওঠেনি সেটা প্রকাশ করে বিড়ম্বিত হওয়ার কী প্রয়োজন?
দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র, রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারি দিনেন্দ্রনাথও বলতেন,
শতং বদ
মা লিখো
শতং লিখো
মা ছাপো।
***
আরও বহু স্মৃতি বার বার মনে উদয় হচ্ছে। একদা দুরারোগ্য রোগের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাবার পথ তিনি আমাকে দেখিয়ে দেন। রিটায়ার করার বহু পরে তিনি একবার কলকাতায় এসে কী করে খবর পান আমি অসুস্থ। বিশ বছর ধরে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ নেই। তিনি খবর পাঠালেন। সব শুনে বললেন, এ রোগ সারে না– তবু তুমি পরেশ চক্রবর্তীর কাছে যাও। আমি বহু ছেলে পড়িয়েছি– সব ব্ল্যাঙ্কো। ওই একটি ছেলের আক্কেলবুদ্ধি ছিল। বিলেত থেকে ও নিয়ে এসেছে এ টু জেড বিস্তর ডিগ্রি। আমি তার কাছে গেলে সে ডাক্তার বলেন, শুরু এই প্রথম আমাকে একটি রোগী পাঠালেন। কী বলেছেন উনি? এ রোগ সারে না? না, সারে। তিনি আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে দিয়েছিলেন। এক্সপেরিমেন্ট করে করে নয়। প্রথম ওষুধ দিয়েই। কিন্তু সে আরেক কাহিনী। এবং সবচেয়ে সন্তাপের কথা, এই কৃতবিদ্য চিকিৎসক অল্প বয়সে গত হন।