বিদ্যাসাগর উত্তরে কী লিখেছিলেন, আদৌ উত্তর দিয়েছিলেন কি না সেটা বহু অনুসন্ধান করেও আমি খুঁজে পাইনি। কিন্তু তিনি যে বঙ্কিমের উপদেশ গ্রহণ করেননি, সেকথা কারও অবিদিত নেই। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, শাস্ত্রের সাহায্যে হয়তো-বা কিছু কার্যোদ্ধার হবে, যুক্তিতর্ক দিয়ে কিছুই হবে না। বিদ্যাসাগর আপন দেশবাসীকে বিলক্ষণ চিনতেন।
অতএব প্রাগুক্ত রামমোহনাদি সকলেই লুথার জাতীয় সমাজ ও ধর্মসংস্কারক। যে বাইবেল পোপ মানেন, খ্রিস্টান মাত্রই মানে সেই বাইবেল দিয়েই তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন যে, প্রত্যেক মানুষেরই বিধিদত্ত অধিকার আছে– আপন বুদ্ধি অনুযায়ী বাইবেল থেকে বাণী গ্রহণ করে আপন জীবন চালনা করার; চিরন্তন, অভ্রান্ত কোনও পোপকে স্বীকার করার প্রয়োজন নেই। তলস্তয়, গাঁধী এই সম্প্রদায়ের।
ভলতেয়ার এ পথ স্বীকার করেননি। তিনি নির্ভর করেছিলেন যুক্তি (রিজন), শুভবুদ্ধি (মোটামুটি কমনসেন্স), মানবতা ও ইতিহাসের শিক্ষার ওপর। তাঁর কমনসেন্স ও ইতিহাসের ওপর বরাত মানার একটা উদাহরণ দিই। দক্ষিণ ভারতের হিন্দুরা ধর্মান্ধ হয়ে যে প্রথম খ্রিস্টান মিশনারি সিন টমাসকে আক্রমণ করে হত্যা করেছিল বা পশ্চাদ্ধাবিত হলে পর তিনি গুহাগহ্বরে বিলীন হয়ে যান, সেই কিংবদন্তি অস্বীকার করে আলোচনা করতে গিয়ে ব্যঙ্গের সুরে ভলতেয়ার বলছেন, যে হিন্দুর পরধর্মে সহিষ্ণুতা সম্বন্ধে আমরা বহুকাল ধরে বহু পর্যটকের কাছ থেকে শুনে আসছি, সেইটে হঠাৎ অবিশ্বাস করতে কাণ্ডজ্ঞানে (কমনসেনসে) বাধে। এদেশের বনবিহারী ভলতেয়ার কিন্তু তিনি ভলতেয়ারের শিষ্য নন।
তবে জনসাধারণ বনবিহারীকে চেনে না কেন? তার সর্বপ্রধান কারণ, বনবিহারী নিজেকে কখনও সংস্কারক, যুগান্তকারী মহাপুরুষরূপে দেখেননি। হয়তো তিনি ভাবতেন, উচ্চাসনে দণ্ডায়মান হয়ে অনলবর্ষী ভাষণের সাহায্যে জনসাধারণকে উত্তেজিত করে, কিংবা ভাবালুতার বন্যায় দেশকে ভাসিয়ে দিয়ে কোনও দীর্ঘস্থায়ী সুদৃঢ় পরিবর্তন আনা যায় না। কিংবা হয়তো স্বভাবসিদ্ধ আন্তরিক বিনয়বশত (সামান্য পরিচয়ের নসিকে লোক ভাবত, তাঁর মতো দম্ভী গর্বী ত্রিসংসারে বিরল– বিশেষত লোকটা যখন স্বয়ং ঈশ্বরকে তার যুগযুগাধিকৃত স্বর্গীয় সিংহাসন থেকে সরাতে চায়!) তিনি পেডেস্টেলে আরোহণ করতে চাইতেন না, কিংবা হয়তো তিনি নৈরাশ্যবাদী ছিলেন। তা সে যা-হোক, আমরা যে তার মতো কিংবা তার চেয়েও শক্তিশালী লোকের জন্য এখনও প্রস্তুত হইনি সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।
কিন্তু কেন?
বনবিহারী তো এমন কিছু নতুন কথা বলেননি যা ভারতে কেউ কখনও বলেনি। স্থির হয়ে একটু ভাবলেই ধরা পড়বে ভারতবর্ষের চিন্তা-জগৎ (ধর্ম-শাস্ত্ৰ-নীতি-আচার-ঐতিহ্য-কলা জ্ঞানবিজ্ঞান) কী দিয়ে গড়া।
১। সনাতন হিন্দুধর্ম ২। বৌদ্ধধর্ম ৩। জৈনধর্ম ৪। দর্শনের মধ্যে নিরীশ্বর সাংখ্য ৫। চার্বাক প্রভৃতি লোকায়ত মতবাদ।
প্রথমটি বাদ দিলে বাকি চারটি চিন্তাধারাতেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বার বার সাবধান-বাণী প্রচারিত হয়েছে, তোমার সুখ-শান্তি, তোমার পরমাগতি সম্পূর্ণ তোমারই হাতে; দৃশ্য এবং অদৃশ্য কোনও লোকেই এমন কোনও অলৌকিক শক্তি নেই যে তোমাকে কোনওপ্রকারে কণামাত্র সাহায্য করতে পারে। এই চিন্তাধারা আদৌ অর্বাচীন নয়। বৈদিক যুগে দেবদেবীদের উদ্দেশে যখন যাগযজ্ঞহোমপশুবলি সর্বত্র স্বীকৃত, ঋষিকবিগণ যখন তাঁদের উদ্দেশে সবিস্ময়ে অপৌরুষেয় মন্ত্র উচ্চারণ করছেন, তখন তার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পাচ্ছি আরেকটি দ্বিধাজড়িত কণ্ঠ, আরেক সত্যান্বেষী প্রশ্ন জিগ্যেস করছেন– ধন্য হোক সে প্রশ্ন, ধন্য হোক তার জন্মলগ্ন– তা হলে কোন দেবতাকে আমি স্বীকার করব? এই প্রশ্ন থেকেই আরম্ভ হল, চরম সত্যের আলটিমেট রিয়েলিটির অনুসন্ধান। এই প্রশ্নের দুটি উত্তর পাওয়া যাচ্ছে পরবর্তী আরণ্যক-উপনিষদের যুগে বেদান্তের মূল সূত্র সবকিছুই ব্ৰহ্ম, এই তিন ভুবন আনন্দময় ব্রহ্ম থেকে উদ্ভূত। দ্বিতীয় সম্পূর্ণ বিপরীত উত্তর জন্ম নেয় ওই সময়েই, হয়তো তার পূর্বেই, সবল কণ্ঠে ধ্বনিত হয় লোকায়ত মতবাদে এবং তারও পরে তীর্থঙ্করদের কণ্ঠে, বুদ্ধদেবের কণ্ঠে– দেবদেবীতে পরিপূর্ণ অনাস্থা প্রকাশ করে মানুষকে সৃষ্টির কেন্দ্ররূপে স্বীকার করা। এরই চরম বিকৃতরূপ– চার্বাকের মতবাদ, যে মতবাদ নৈতিক দায়িত্বে পর্যন্ত বিশ্বাস করে না।
বৌদ্ধধর্ম এ-দেশ থেকে লোপ পেয়েছে, কিন্তু সে মতবাদ সম্পূর্ণ বহিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তর্কযুদ্ধে পরাজিত কোনও এক সাংখ্যতীর্থ বোধহয় বৌদ্ধবৈরী শঙ্করাচার্য সম্বন্ধে বক্রোক্তি করেছিলেন, বৌদ্ধদর্শনের সঙ্গে সে এতখানি সন্ধি করেছে যে, সে মতবাদ আত্মসাৎ করতে তার বাধেনি, তাকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ বলব না, তবে কী বলব?
আর নিরীশ্বর জৈনরা তো, এখনও ভারতবর্ষে বাস করেন।
নিরীশ্বর সাংখ্যের চর্চা করেন এখনও বহু পণ্ডিত : যাঁদের মতে ঈশ্বর প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ।
নৈয়ায়িকরা কোন পন্থায়?
এবং এদেশের সহজিয়ারা সৃষ্টিকেন্দ্র করেছেন মানুষকে : সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।
পূর্বেই বলেছি, বনবিহারী ভলতেয়ারের শিষ্য নন। তিনি ভলতেয়ারের শিষ্য এ-কথা তাঁর সামনে বললে তিনি নিশ্চয়ই তেড়ে আসতেন। অবশ্যই বলতেন, ভলতেয়ার যদি দেখেন যে তার মতবাদ আমার মতবাদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তবে তিনি গর্ব অনুভব করতে পারেন; আমার তাতে কী? আবার তাঁকে যদি বলা হত, তিনি ঐতিহ্যগত বৌদ্ধ-জৈন-সাংখ্য দর্শন প্রচার করছেন তবে তিনি নিশ্চয়ই আরও মারমুখো হতেন। নিশ্চয়ই বলতেন, চুলোয় যাক্ (জাহান্নমে যাক, নিশ্চয়ই বলতেন না, কারণ যে জায়গা নেই, সেখানে কোনও মতবাদকে পাঠিয়ে বনবিহারী অবশ্যই সন্তুষ্ট হতেন না!) তোমার সাংখ্য জৈন মতবাদ; পিছন পানে তাকাও কেন? নিজের বুদ্ধি, নিজের যুক্তি, নিজের রেশনালিটির ওপর নির্ভর করতে পার না? কপিল-জীনের ঠ্যাকনা ছাড়া বুঝি দাঁড়ানো যায় না? তুমি আছ, আমি আছি– ব্যস। আমরা বের করে নেব ন্যায় আচরণ কী? আর রাগ কোরও না, আমি আমারটা বহুপূর্বেই একাই বের করে নিয়েছি।