সেদিন আমি বড়ই উপকৃত হয়েছিলুম। ঈশ্বরবিশ্বাসে যেসব বাতিল যুক্তি আছে সেগুলো থেকে মুক্ত হয়ে আমি ঈশ্বর সন্ধানে সত্য যুক্তি ও নিজস্ব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের কথা চিন্তা করলুম। কিন্তু আমার কথা থাক।
পাঠক, আপনি মোটেই ভাববেন না, বনবিহারীর প্রধান সংগ্রাম ছিল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে। তাঁর সংগ্রাম ছিল জড়তা, কুসংস্কার, ধর্মের নামে পাপাচার, সামাজিক অনাচার, তথাকথিত অপরাধীজনের প্রতি অসহিষ্ণুতা, যাজক সম্প্রদায়ের শোষণ, চিন্তা না করে বাঁধা পথে চলার বদঅভ্যাস, মহরমের তাজিয়ার সামনে কুমড়ো-গড়াগড়ি, যৌনসম্পর্কের ওপর তথাকথিত শালীনতার পর্দা টেনে আড়ালে আড়ালে কুমারী ও বিধবার সর্বনাশ, অশিক্ষিত ব্রাহ্মণের অকারণ দম্ভ, অব্রাহ্মণের অহেতুক দাস্যমনোবৃত্তি, তথাকথিত সত্যরক্ষার্থে সত্য গোপন, স্বার্থান্বেষণে বিদেশির পদলেহন ও অন্ধানুকরণ, কিন্তু যেখানে সে মহৎ সেটা প্রচলিত ধর্মের দোহাই দিয়ে বর্জন, বসরের পর বৎসর, প্রতি বৎসর রুগণা অর্ধমৃতা স্ত্রীকে গর্ভদান করে তার কাতর রোদন অনুনয়-বিনয় পদদলিত করে তাকে অবশ্যম্ভাবী অকালমৃত্যুর দিকে বিতাড়ন এবং সঙ্গে সঙ্গে সমাজে, ধর্মসভায় সচ্চরিত্র সজ্জন খ্যাতি অর্জন (বলা বাহুল্য চিকিৎসক হিসেবে ঠিক এই ট্র্যাজেডি তার সামনে এসেছে বহু, বহুবার), গণিকালয় থেকে একাধিকবার বিবিধ মারাত্মক ব্যাধি আহরণ করে নিরপরাধ অর্ধাঙ্গিনীর শিরায় শিরায় সেই বিষ সংক্রামণ, একবার একটিমাত্র ভুল করার জন্য অনুতপ্তা রমণীকে ব্ল্যাকমেল করে তাকে পুনঃপুন ব্যভিচার করাতে বাধ্যকরণ–
হে ভগবান! এ যে অফুরন্ত ফর্দ! কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বনবিহারীর সিকি পরিমাণ প্রকাশিত– অপ্রকাশিতের হিসাব নিচ্ছিনে এবং অধিকাংশ লেখাই যে তিনি ছিঁড়ে ফেলতেন সে-ও বাদ দিচ্ছি– গদ্য পদ্য ব্যঙ্গচিত্র সগ্রহ করে কেউ যদি তার জিহাদের লক্ষ্য বিষয়গুলো সংকলন করেন তবে এ-স্থলে আমার প্রদত্ত নির্ঘণ্টের চেয়ে বহুগুণে বৃহত্তর ও কঠোরতর হবে।
কী নিদারুণ ব্যঙ্গ, বিতৃষ্ণা ও ঘৃণার সঙ্গে তিনি অন্যায় আচরণ, ভণ্ড কাপুরুষতাকে আক্রমণ করতেন সে তার গুণগ্রাহী পাঠকমাত্রই জানেন। ভাষার শাণিত তরবারি তার হাতে বিদ্যুত্বহ্নি বিচ্ছুরণ করত এবং এই মরমিয়া মোলায়েম আ মরি বাঙলা ভাষাও যে কতখানি বহ্নিগর্ভা সে তত্ত্ব উদঘাটিত হত বনবিহারীর অদম্য, নিঃশঙ্ক আঘাতের পর আঘাত থেকে। প্রত্যেক শব্দ প্রত্যেকটি বর্ণ বিশুদ্ধ যুক্তির ওপর দণ্ডায়মান। শাস্ত্র ভাঙতে যখন যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তখন শাস্ত্রের দোহাইয়ের তো কথাই ওঠে না, তিনি বিজ্ঞানের দোহাইও দিতেন না। কোনওকিছুই অভ্রান্ত নয়, কোনও সত্যই শাশ্বত নয়; অতএব প্রত্যেকটি সমস্যা নতুন করে যাচাই করে দেখতে হবে, এবং এই সাধনা চলবে আমৃত্যু।
ঈশ্বর-বিশ্বাসকে যে তিনি গোড়াতেই আক্রমণ করেছিলেন তার অর্থ এই নয় যে, তিনি এই বিশ্বাস by itself, per se অন্যান্য সংস্কারের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক বলে মনে করতেন। তার ধারণা জন্মেছিল এবং সেটা বিস্তর অনুসন্ধান ও গবেষণা করার পর, যে- এই বাঙলা দেশে যতপ্রকারের সামাজিক, অর্থনৈতিক অন্যায় অবিচার হচ্ছে, যা কিছু নারীর ন্যায্য অধিকার ও পরিপূর্ণ বিকাশের অন্তরায় হচ্ছে আর ধর্মের নামে অনাচার শোষণের তো কথাই নেই– এ সবকিছু হচ্ছে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে।
যেসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বনবিহারী লড়াই দিতেন তাদের বিরুদ্ধে কি অন্য বাঙালি লড়েনি? নিশ্চয়ই লড়েছে। বর্ণবৈষম্য, আহারে-বিহারে স্ব স্ব সংকীর্ণ গণ্ডি নির্মাণ, ধর্মের নামে অধর্মচর্চা শাস্ত্রাধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করে তাদের কুসংস্কারে নিমজ্জিত রাখা, বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তাকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত করা, ধর্মত্যাগীকে পুনরায় স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করার পথ চিরতরে রুদ্ধ করে দেওয়া ইত্যাকার বহু বহু সংস্কার আচার দূর করার জন্য চৈতন্য সংগ্রাম দেন ও সর্বজনীন বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ এঁরা এবং আরও অনেকে মূঢ়তা, কুসংস্কার ও একাধিক পাপাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। এঁদের তুলনায় বনবিহারীকে চেনে কে?
কারণ বনবিহারী অন্য পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।
প্রাগুক্ত সকলেই দেশ-দশকে পাপচিন্তা-পাপাচার থেকে মুক্ত করার জন্য শাস্ত্রের অর্থাৎ ধর্মের শরণ নিয়েছেন। বনবিহারী মানবিকতার শরণ নেন। প্রচলিত ধর্মও তাঁর শত্রু। একমাত্র ধর্মের moral, ethical যেটুকু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধোপে টেকে সেইটুকু গ্রহণ করা যেতে পারে।
বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে একখানা চিঠিতে যা লেখেন তার নির্যাস ছিল এই, শাস্ত্র মেনে হিন্দু তার সামাজিক জীবনযাপন করে না। সে মানে লোকাঁচার, দেশাচার। বিদ্যাসাগর যদি সর্বশাস্ত্র দিয়েও দ্ব্যর্থহীন নিরঙ্কুশ সপ্রমাণ করেন যে, বিধবা-বিবাহ শাস্ত্রসম্মত, শাস্ত্ৰসিদ্ধ তবু হিন্দু সে-মীমাংসা গ্রাহ্য না করে আপন লোকাঁচার দেশাচার আগেরই মতো মেনে নিয়ে বিধবার বিয়ে দেবে না। অতএব বিদ্যাসাগরের উচিত যুক্তি ন্যায় ও মানবিকতার (এই ধরনেরই কিছু, আমার সঠিক মনে নেই, তবে মোদ্দা– Reason-এর ওপর নির্ভর করা, শাস্ত্রের ওপর না করে) ওপর নির্ভর করা।