বনবিহারী তাঁর বাল্যবয়সের অধিকাংশটা কাটান তাঁর মাতামহের সঙ্গে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি তাঁর নাম ভুলে গিয়েছি কিন্তু সেটা বের করা কঠিন হবে না। এই মাতামহটি ছিলেন গত শতাব্দীর ধনুর্ধর, অপরাজিত দার্শনিক এবং নৈয়ায়িক। যে দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উভয় দর্শনে ছিলেন সে যুগের চূড়ামণি, তিনি ছিলেন তাঁর নিত্যালাপী সখা। যে দ্বিজেন্দ্রনাথের গৃহে বঙ্কিমাদি মনীষীগণ আসতেন তত্ত্বালোচনার জন্য সেই দ্বিজেন্দ্রনাথ গিয়েছেন দিনের পর দিন এই নৈয়ায়িকের অপরিসর পথের ক্ষুদ্রতর গৃহে। দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন এমনই আপন-ভোলা সাদা দিলের মানুষ যে তর্কে বিরক্তির সঞ্চার হলে তার কণ্ঠ তপ্ততর ও উচ্চতর হতে আরম্ভ করত– বনবিহারীর মাতামহ এ তত্ত্ব জানতেন বলে সেটা আদৌ গায়ে না মেখে পূর্বের চেয়ে ক্ষীণতর কণ্ঠে মোক্ষমতর যুক্তি পেশ করতেন। খাওয়ার বেলা গড়িয়ে যায়–দ্বিজেন্দ্রনাথ সে সম্বন্ধে বেহুঁশ। শেষটা বেলা প্রায় তিনটায় উত্তেজিত হয়ে আসন ত্যাগ করে বলতেন, ঝকমারি, ঝকমারি, এসব লোকের সঙ্গে তর্ক করা; আমি চললুম এবং এই আমার শেষ আসা। বনবিহারীর মাতামহ ক্ষীণকণ্ঠে বলতেন, গিন্নি পুঁইচচ্চড়ি বেঁধেছিল। অট্টহাস্য করে দ্বিজেন্দ্রনাথ টেনে টেনে বলতেন, সেটা আগে বললেই হত, আগে কইলেই হত। তার পর বারান্দায় প্রতীক্ষমাণ তাঁর গার্জেনকে বলতেন (মহর্ষিদেব এই আপন-ভোলা যুবরাজের জন্য একটি তদারকদার নিযুক্ত করে রেখেছিলেন), যাও, বাড়ি থেকে দাঁত নিয়ে এসোগে। শুধু খাবার সময়ই তিনি বাঁধানো দাঁত ব্যবহার করতেন। আমার ভাবতে বড় কৌতুক বোধ হয় যে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠতম দৌহিত্র বাড়ির কোর্মা-কালিয়া ছেড়ে অনাড়ম্বর নৈয়ায়িকের অপরিসর বারান্দায় পিঁড়িতে বসে পুইচচ্চড়ি চিবোতে চিবোতে উচ্চকণ্ঠে পাড়া সচকিত করে তার অকৃপণ প্রশস্তি গেয়ে চলেছেন।
পরদিন নাউ-চিঙড়ি! নাউ–লাউ না!
এ ধরনের একাধিক বিচিত্র বিষয় আমি ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি প্রাগুক্ত বিনোদবিহারী মহাশয়ের কাছ থেকে।
দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর সুচিন্তিত প্রবন্ধরাজিতে মাত্র দুজন দার্শনিক পণ্ডিতের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে সপ্রশংস চিত্তে উল্লেখ করেছেন যারা দার্শনিক ও তত্ত্ববিদের গুরুভার কর্তব্য আপন আপন স্বন্ধে অনায়াসে তুলে নিতে পারেন; এদের একজন পুইচচ্চড়ি-রসিক দার্শনিক বনবিহারীর মাতামহ। এবং তার সম্বন্ধে বলি, সে যুগে পিরিলি ঠাকুররা অন্যান্য ব্রাহ্মণদের কাছে অপাঙক্তেয় ছিলেন।
বিশ্বস্তসূত্রে অবগত আছি, বনবিহারী বাল্য বয়সে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন। মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবস্থায়ও সূর্যোদয় থেকে প্রারম্ভ পূজা-অর্চনা শেষ করতে করতে কোনও কোনও দিন ক্লাসের সময় পেরিয়ে যেত। এটাতে আমার সামান্য বিস্ময় লাগে, কারণ আমি যে কয়টি প্রাচীনপন্থী নৈয়ায়িককে চিনি তাঁদের সকলেই পূজা-অর্চনা সম্বন্ধে ঈষৎ উদাসীন ছিলেন। আমার আপন গুরু পথে যেতে যেতে বারোয়ারি সরস্বতী প্রতিমা দেখে। নাসিকা কুঞ্চিত করে বলেছিলেন, ন দেবায়, ন ধর্মায়। অর্থাৎ হিন্দুশাস্ত্রে (অবশ্য তিনি স্মৃতি জানতেন অত্যল্পই এবং সে জন্য তার কণামাত্র ক্ষোভও ছিল না) এরকম পুজোর কোনও ব্যবস্থা নেই, বৌদ্ধধর্মে (ন ধর্মায়-এর ধর্ম এস্থলে ধর্মং শরণং গচ্ছামি থেকে নেওয়া) তো থাকার কথাই নয়। সঙ্গে সঙ্গে হয়তো সরস্বতীর যে কুখ্যাতি (হয়তো অমূলক) আছে সেটা তার স্মরণে আসত। তা সে যাক। কারণ আমার ধর্মের সুফিদের ও খ্রিস্টান মিস্টিকদের ভিতরও ক্রিয়াকর্মের প্রতি কিঞ্চিৎ অনাসক্তি লুক্কায়িত রয়েছে।
অকস্মাৎ একদিন বনবিহারী নাস্তিকরূপে সমাজে আত্মপ্রকাশ করলেন ও শুধু শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকর্ম (রিচুয়েল) নয়, শঙ্করাচার্যের নিষ্ঠুণ ব্ৰহ্ম থেকে হাঁচি টিকটিকির বিরুদ্ধে তীব্র কর্কশ কণ্ঠে মারমুখো জিহাদ ঘোষণা করলেন। খ্রিস্টান মিশনারি পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাসের দৃঢ়তা, উদ্দীপনা এবং যুদ্ধংদেহি মনোভাব দেখলে বিস্ময়ের সঙ্গে পরাজয় স্বীকার করত। এই যে সামান্য আমি, আমার বয়স তখন কত হবে? ষোলগোছ– আমাকে পর্যন্ত প্রথম দর্শনের পাঁচ মিনিটের ভিতর, কলার অভাবে কুর্তার গলার মুরি ধরে শুধোলেন, তুমি ঈশ্বর মানো?
আমি ভীত কণ্ঠে বললুম, আজ্ঞে আমার বিশ্বাস দৃঢ় নয়, অবিশ্বাসও দৃঢ় নয়। আমি তখন জানতুম না, এই উত্তরই চার দশক পরে কলকাতার মডার্ন মহিলাদের ভিতর ফ্যাশন হয়ে দাঁড়াবে।
তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বিশ্বাস দৃঢ়ই হোক, আর শিথিলই হোক, সেইটে কিসের উপর স্থাপিত আমাকে বুঝিয়ে বল।
কী যুক্তি দেব আমি? যেটাই পেশ করি, সেটাই বুমেরাঙের মতো ফিরে আসে ফের আমারই গলায়। ইতোমধ্যে আমার জন্য উত্তম মমলেট, ঘোলের শরবত এসেছে–দুপুর অবধি তর্ক চালালে অবশ্যই পুঁইচচ্চড়ি আসত!
আমি রণেভঙ্গ দিতে চাইলেও তিনি ছাড়েন না। আমি যে ধর্মের অধর্ম পথে চলেছি সেইটে তিনি সপ্রমাণ করতে চান, সর্বদৃষ্টিকোণ থেকে, সর্বদৃষ্টিবিন্দু থেকে। এবং আমার সবচেয়ে বিস্ময় বোধ হল যে, আমি যে কজন ইউরোপীয় নাস্তিক দার্শনিকের নাম জানতুম– অবশ্য অত্যন্ত ভাসা-ভাসাভাবে তাঁদের কাছ থেকে বনবিহারী ঈশ্বরম্ন ধর্মগ্ন যুক্তি আহরণ করলেন না। বিস্তর তর্কজাল বিস্তৃত করার পর, মাঝে মাঝে তিনি সেগুলো সাম্-আপ করতেন, এ-দেশি পরিভাষায় সূত্ররূপে প্রকাশ করতেন সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করে! এই প্রথম আমার গোচরে এল যে, আর্যাবর্তের মতো ধর্মাবর্তের দেশেও অসংখ্য নাস্তিক প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে বহুযুগ পূর্বেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে গিয়েছেন।