জীবনানন্দের স্মৃতিচারণা করে শামসুদ্দীন সেদিন আরও বলেছিলেন :
‘তারপর তাঁকে প্রথম দেখি যখন আমরা আই. এ ক্লাসের ছাত্র। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন তিনি। শ্যাম রঙের স্বাস্থ্যবান মানুষ। চল্লিশোত্তর বয়স তখন। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি, পাম্প-সু। কাঁধে পাট করে রাখা একখানা চাদর, হাতে একটি কি দুটি বই। মুখ তাঁর সর্বদা ভারি, গম্ভীর, চোখে আশ্চর্য সারল্য এবং তীক্ষ্ণতা। লম্বা লম্বা পা ফেলে চলতেন। আমি আর আমার আর এক বন্ধু নির্মল চট্টোপাধ্যায় তাঁকে অবাক হয়ে দেখতাম। কখনো ক্লাসের অবকাশে মাঠের ধারে শুয়ে শুয়ে পড়তাম তার কবিতা। তখনও পর্যন্ত তাঁর শেষতম কাব্যগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি। কিছুদিন পরে “কবিতা ভবন” থেকে “এক পয়সায় একটি” কবিতা সিরিজে প্রকাশিত হলো তাঁর বনলতা সেন। আমাদের মধ্যে সেদিন রীতিমতো সাড়া পড়ে গিয়েছিল। নতুন বয়সের অনভিজ্ঞ মনের কাছে ধূসর পাণ্ডুলিপি যে সাড়া জাগাতে পারেনি, বনলতা সেন দ্বারা তা সম্ভব হয়েছিল। “বনলতা সেন” কবিতাটি আমরা যত্রতত্র মুখে মুখে আবৃত্তি করে বেড়াতাম। কলেজের এক অনুষ্ঠানেও আবৃত্তি করলাম একদিন।
একসময় জীবনানন্দের সঙ্গে শামসুদ্দীনের ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়।
দুই
জীবনানন্দ দাশকে তাঁর প্রথম জীবনে খুব কাছে থেকে দেখেছেন এমন মানুষের সংখ্যা দুই বাংলাতেই কম। তাঁর জীবনের একটি বড় সময় কেটেছে তার জন্মস্থান বরিশালে। ব্রজমোহন কলেজে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। কলকাতার খ্যাতিমানদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না বললেই চলে। তিরিশ ও চল্লিশের দশকে তার ছাত্ররা বরিশালে তাঁকে কাছে থেকে দেখেছেন বটে, তবে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযোগ পাননি। সে জন্য দায়ী তাঁর লাজুক স্বভাব। লোকজনের সঙ্গে মেলামেশায় তাঁর আগ্রহের অভাব। অথচ তিনি কোনো অহংকারী মানুষ ছিলেন না। শামসুদ্দীন আবুল কালাম ছিলেন তাঁর সাক্ষাৎ ছাত্র। জীবনানন্দকে তিনি গভীর শ্রদ্ধা করতেন। তিনি তাঁর সেই স্মৃতিচারণামূলক লেখায় বলেছিলেন :
‘একদিন বাড়িতে গেলাম তার। কলেজে তাঁর প্রখর গাম্ভীর্যের জন্য কাছে এগোতো না কেউ। সবারই ধারণা ছিল তিনি ভীষণ রাশভারী প্রকৃতির লোক। আমরাও অবকাশ পেতাম না কথা বলার। তাঁর বাড়ি একটা মেয়েস্কুলের কম্পাউন্ডের মধ্যে। খুব সম্ভবত সে ইস্কুলটা তাঁর পিতারই প্রতিষ্ঠিত ছিল। বাংলো ধরনের বাড়ির উপরে শণের চাল। বেড়া আধেক ইট আর আধেক বাঁশের। কিন্তু ভিতরে সাহিত্য পাঠকের কাছে আশ্চর্য এক জগৎ। বই, বই আর বই। বাংলার, বাংলার বাইরের, অসংখ্য পত্রিকা। সবই সযত্নে গুছিয়ে রাখা দেখে মনে হয় বার বার পড়া। একধারে একটা ছোটো টেবিল। হয়তো তাঁর লেখার। অন্দরে ছিলেন তাঁর স্ত্রী এবং বালিকা কন্যা মঞ্জু দাশ। তাঁরাও কবিরই মতো স্বল্পভাষী– নির্জনতাপ্রিয়। সেইকালে, মঞ্জু দাশের বোধ হয় বয়স দশ কি বারো, বঙ্গশী পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিলো।’
জীবনানন্দের কাছে গিয়ে শামসুদ্দীন ও তাঁর বন্ধুদের তাঁর সম্পর্কে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। তিনি চুপচাপ থাকতে পছন্দ করলেও কথা বলার মানুষ পেলে গল্পসল্প করতেন। তাঁর মধ্যে শিশুসুলভ সারল্য ছিল। শামসুদ্দীনের ভাষায় :
‘সেদিন তার বাড়িতে না গেলে “জীবনানন্দবাবু অসামাজিক মানুষ” এই ধারণা করেই চিরদিন দূরে দূরে থেকে যেতাম। সে ধারণা অচিরেই ভেঙে গেলো। অমন রাশভারী চেহারার ভিতরে একটি সহজ সরল শিশুর মন খুঁজে পেয়ে আমরা চমৎকৃত হয়ে গেলাম।’
তিরিশের দশকে ছাত্রজীবন থেকেই শামসুদ্দীন কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ– ‘কতকী’ লিখতেন। তাঁর চলাফেরা ছিল বাম প্রগতিশীল কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে। সমাজের নিচতলার মানুষের প্রতি ছিল তাঁর সহানুভূতি। জীবনানন্দের দ্বারা প্রথম দিকে অনেকটা প্রভাবিত ছিলেন। তিনি জানান :
‘এই সময় কলেজে একদিন তার সঙ্গে কথা বলছি, এমন সময় প্রগতিশীল [এক] ছাত্র-কবি হঠাৎ কথার মাঝখানেই তাঁকে প্রশ্ন করলে : “আপনি জনগণের জন্য লেখেন না কেন?” তার সাহস দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।
‘জীবনানন্দ বাবু এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কয়েকবার তার এবং আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আস্তে প্রশ্ন করলেন : “তুমি এই প্রগতিশীল সাহিত্য-আন্দোলনের মধ্যে আছো বুঝি?”
‘সে বললে : “হ্যাঁ। অবশ্যই। আমরা এই সমাজ-ব্যবস্থাকে বদলাতে চাই; কায়েম করতে চাই শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থা। যেখানে কবি ও সাহিত্যিকেরাও আমাদের সঙ্গে আসবেন তাদের বুর্জোয়া, পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণি ত্যাগ করে– মার্কসবাদ যে নতুন পথ দেখিয়েছে–।”
‘কথার মাঝখানেই জীবনানন্দ বাবু হঠাৎ প্রশ্ন করলেন : “তুমি কার্ল মার্কস পড়েছো? ডস ক্যাপিটাল?”
‘ছাত্র “কবি”টি থতমত খেয়ে বললে : না।
‘জীবনানন্দ বাবু একটু কাল তার দিকে তাকিয়ে থেকে হাসি গোপনের বহু চেষ্টা করেও অকস্মাৎ উচ্চহাস্যে ফেটে পড়লেন। হঠাৎ সে হাসি। এমন আচম্বিতে [সে হাসি] বেরিয়ে আসা যে, অবাক হয়ে দেখতে হয় তাঁকে। সঙ্গে হাসা যায় না।
‘ছাত্রটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পালিয়ে বাঁচলো।’
নজরুল ইসলামের অট্টহাসি নিয়ে অজস্র লেখালেখি হয়েছে। মাইলখানেক দূর থেকে তা শোনা যেত। তাঁর হাসির কারণে পাড়া-প্রতিবেশীর ঘুম হারাম হয়েছে। অনেকে অভিযোগ করেছেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। নজরুলের হাসি ছিল প্রাণমাতানো এবং তাঁর শ্রোতাদের মতে উপভোগ্য। তাঁর সমসাময়িক আরও দুই কবিও ছিলেন অট্টহাসিতে অভ্যস্ত। তাঁরা হলেন জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসু। বসু ছিলেন ছোটোখাটো হালকা পাতলা মানুষ, নজরুলের মতো সিংহের শক্তি তাঁর ছিল না, কিন্তু তাঁর হাসিও আধা কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যেত। রিপন কলেজ বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আছেন কি না, তা তাঁর সহকর্মী ও ছাত্ররা জানতে পারতেন তার হাসির শব্দ থেকে। এ কথা জানান খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত।