স্বাধীনতার পরে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মযহারুল ইসলাম এমন মাত্রায় বাঙালি হতে চান যে তিনি ‘আসোলামু আলাইকুম’, ‘জনাব প্রভৃতিকে সাম্প্রদায়িক বিষয় মনে করে তা বাদ দিতে চান। তাঁর প্রস্তাব হয় : ‘জনাব’ এর বদলে লিখবেন ‘সুজন’। সুজন অমুক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে কোনো চিঠি দেওয়ার পরে বিষয়টি কারও চোখে পড়ে। উচ্চপর্যায় থেকে ধমকের পরে এই অপতৎপরতা বন্ধ হয়।
১১. মুসলিম জাতীয়তাবাদী কবি
১৯৪৭-এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের সময় নতুন রাষ্ট্র ‘পাকিস্তান’ ছিল একটি বাস্তবতা, যেমন ২৪ বছর পর ১৯৭১-এ বাংলাদেশের অভ্যুদয় একটি বাস্তবতা। উপমহাদেশের দুই প্রান্তে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা মুসলমানদের স্বশাসিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষার ফসল পাকিস্তান। ১৯৪০ সালের মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব যদি অসংশোধিতভাবে বাস্তবায়িত হতো, তাহলে পশ্চিমে পাকিস্তান নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও এদিকে পূর্ব বাংলা নামেই একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হতো– পূর্ব পাকিস্তান বা পাকিস্তান নয়। ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে সিদ্ধান্ত হয়, দুই ডানাবিশিষ্ট একটি রাষ্ট্র, যার নাম হবে পাকিস্তান। বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাতেও সম্মতি জানায় পরিস্থিতির কারণে। মওলানা ভাসানী, আবুল হাশিম মৃদু আপত্তি করেছিলেন, কিন্তু তা গৃহীত হয়নি।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণা সব বাঙালি মুসলমানের কাছে এক রকম ছিল না। খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে যা পাকিস্তান, মওলানা ভাসানীর কাছে পাকিস্তান হওয়ার কথা ছিল একেবারেই অন্য জিনিস। মওলানা আকরম খাঁ বা আবুল কালাম শামসুদ্দিন বা প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর কাছে যা পাকিস্তান, কবি ফররুখ আহমদ বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কাছে পাকিস্তান তা নয়– তাদের ধারণায় পাকিস্তান অন্য রকম। এ সম্পর্কে প্রাবন্ধিক আবদুল হকের বক্তব্য এ রকম :
‘তখন [১৯৪৫-৪৬] পাকিস্তান আন্দোলনের সময়। এ আন্দোলনকে মুসলিম সমাজের একেক শ্রেণি একেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখত : শ্রেণিস্বার্থের দিক থেকে। এই শ্রেণিস্বার্থ পরে যেমন সুস্পষ্ট রূপ পেয়েছিল, তখন তেমন পায়নি। তখন ছাত্র ও অছাত্র যুব সম্প্রদায় প্রায় সমগ্রভাবেই পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করত, স্বপ্ন ও সংকল্প নিয়ে। পাকিস্তান পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হবে না– এই ছিল স্বপ্ন; একে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হতে দেওয়া হবে না –এই ছিল সংকল্প। সমগ্র যুব সম্প্রদায়ের না, সচেতন অংশের। সমাজতান্ত্রিক ভাবধারা তখন দ্রুত মুসলিম যুবসমাজে প্রসার লাভ করছে।… কিছু তরুণ নেতা ও নব্য বুদ্ধিজীবীর প্রচারণার ফলে সেই সময়ে এ রকম একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে, সমাজতান্ত্রিক আদর্শ এবং ইসলামী রাষ্ট্ৰাদর্শের মধ্যে সাদৃশ্যই বেশি, বিরোধ সামান্য। সেই সঙ্গে এই চেতনাও বেশ খানিকটা ছিল যে, মুসলিম লীগ নেতৃত্বের বড় অংশই প্রতিক্রিয়াশীল এবং ধনতন্ত্রের সমর্থক, অথ বা সমর্থক হবেন। ধনতন্ত্র পাকিস্তানের মৌলিক লক্ষ্যের বিরোধী এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক কর্মীদের মতো লেখকদেরও কর্তব্য আছে, এ বিষয়ে ফররুখ আহমদ এবং আমি একমত ছিলাম। ভারতীয় সমাজে যে সামাজিক এবং মানবিক বৈষম্য আছে তা পাকিস্তানে সম্ভব হবে না, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে পাকিস্তান। অধিকতর অগ্রসর রাষ্ট্র হবে, হওয়া উচিত, এই ছিল আমাদের ধারণা।
[‘সায়দুল হক, ফররুখ আহমদ’]
আবদুল হকের এই বক্তব্য শতভাগ সত্য। চল্লিশের দশকে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে, ফররুখ আহমদের সঙ্গে আবদুল হকের বন্ধুত্ব ছিল। ফররুখ রিপন কলেজে বুদ্ধদেব বসুর ছাত্র ছিলেন। তাঁর কবিত্বশক্তি সম্পর্কে বুদ্ধদেবের কোনো সংশয় ছিল না। তাঁর কবিতা পত্রিকায় ফররুখের কবিতা তিনি প্রকাশ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে আবদুল হক লিখেছেন, তার পরিচিতদের সকলেই জানেন, তিনি খুব মজলিসী এবং সদালাপী ছিলেন, তবে যেখানে মতের মিল হতো সেখানে।
ফররুখ অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। অন্যায়কে নীরবে মেনে নিতেন না। আবদুল হক লিখেছেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মুহূর্তে ১৯৪৭ সালে ফররুখ মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা এবং আজাদ ও মোহাম্মদীর মালিক-সম্পাদক মওলানা আকরম খাঁর বিরুদ্ধে এক প্রতারণার মামলা দায়ের করেছিলেন। ফররুখের রচিত ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান নামক একটি কবিতা মওলানা আজাদ তাঁর নিজের নামে ছাপেন। তার প্রতিবাদে ফররুখ মওলানার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন (অথবা তার ব্যবস্থা করেছিলেন); মামলার তদবির উপলক্ষে তিনি একদিন আমাকে সঙ্গে নিয়ে এক ব্যারিস্টারের কাছে গিয়েছিলেন বলে আবদুল হক লিখেছেন।
পূর্ব বাংলার মানুষ দীর্ঘকাল শিকার হয়েছিল শোষণ, অবহেলা ও বৈষম্যের। প্রগতিশীল তরুণেরা মনে করতেন, পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হবে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং সেখানে থাকবে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও সেখানে কোনো রকম অবিচার ও বৈষম্যের শিকার হবে না। অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল তরুণদের এ রকম একটি প্রত্যয় ছিল। ফররুখের বিশ্বাস ছিল ‘ইসলামি সমাজবাদে’। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময়ের ফররুখ সম্পর্কে আবদুল হক লিখেছেন: