Site icon BnBoi.Com

সুকুমার রায় এর প্রবন্ধ

Sukumar_Ray

অতিকায় জাহাজ

শৌখিন ধনীদের জন্য আর বড়ো-বড়ো ব্যবসায়ীদের জন্য যে সমস্ত জাহাজ অতলান্তিক মহাসাগরের খেয়া পারাপার করে, তেমন বড়ো জাহাজ পৃথিবীর আর কোথাও নাই। কি করে খুব তাড়াতাড়ি সাগর পার করা যায় আর আরামে পার করা যায়, আর একসঙ্গে অনেক লোককে বিনা কষ্টে পার করা যায়, তার জন্য বড় বড় জাহাজ কোম্পানিদের মধ্যে রেষারেষি চলে। এক-একটা জাহাজ নয়, যেন এক-একটা শহর, রাজারাজড়ার থাকবার মতো শহর। তারই খুব বড়ো দু-একটির নমুনা দেওয়া হয়েছে।
জাহাজের সাঁতার-ঘরটি দেখা যাক। মধ্যেকার চৌবাচ্চাটি হচ্ছে ২২ গজ লম্বা আর ১৮ গজ চওড়া। এ ছাড়া নানারকম স্নানের ঘর, তুর্কী হামাম, ফোয়ারা-স্নান প্রভৃতির আলাদা বন্দোবস্ত আছে। ১২ তলা জাহাজ, তার মাঝিমাল্লা যাত্রী সব নিয়ে লোকসংখ্যা ৫০০০ হবে। পাঁচটি জাহাজ লম্বালম্বি সার বেঁধে দাঁড়ালে, এক মাইল পথ জুড়ে বসবে। একটি জাহাজের এক সপ্তাহের খোরাক হল ২২টা ট্রেন বোঝাই কয়লা– এক-একটা ট্রেনে সাড়ে আট হাজার মণ। জাহাজের মানুষগুলোর খোরাকের হিসাবও বড়ো কম নয়। এক-এক যাত্রায় পশুমাংস ৭০০ মণ, পাখির মাংস ১৫০ মণ, মাছ ১২৫ মণ, ডিম ৪৮,০০০, আলু ১,৬০০ মণ, তরিতরকারি ৪০০ মণ, টিনের সবজি ৬,০০০ টিন আর কফি ও চা ৯০ মণ লাগে। তাছাড়া ফল দুধ কোকো চকোলেট ইত্যাদিও সেইরকম পরিমাণে।
জাহাজের মধ্যে বড়ো বড়ো খানাঘর চা-ঘর ইত্যাদি তো আছেই, তা ছাড়া নানারকম হোটেল সরাই-এর অভাব নেই। ধোপা, নাপিত, ফুলের দোকান, ছবির দোকান, মিঠাই-এর দোকান, প্রকাণ্ড থিয়েটার ও নাচঘর এসবও জাহাজের মধ্যেই পাবে। উঠবার জন্য লিফ্ট বা চলতিঘর। ইচ্ছা করলে আর টাকা থাকলে, সেখানে আল্‌গা বাড়ি ভাড়ার মতো করে থাকা যায়– একবারের (অর্থাৎ ৫ দিনের) বাড়িভাড়া ধর ১৫,০০০ টাকা। এক-একটি জাহাজ করতে খরচ হয় প্রায় দু-তিন কোটি টাকা।

 উঁচু বাড়ি

লোকে বলে—’মনুমেন্টের মতো উঁচু!’ সেরকম উঁচু বাড়ি দেখলে আমরা বলি ‘ইস্‌! বড্ড উঁচু বাড়ি।’ কিন্তু একটিবার আমেরিকায় ঘুরে এস, তারপরে সেই বাড়িই তোমার চোখে নিতান্তই ছোট ঠেকবে। মনুমেন্টের মাথায় অমন আরও দু-চারটা মনুমেন্ট চাপাও, তবে আমেরিকার লোকে বলবে ‘হ্যাঁ, কতকটা উঁচু বটে!’ নিউ ইয়র্কের একটি বাড়ি পঞ্চান্ন তলা—সাড়ে সাতশ ফুট উঁচু! একটা সাধারণ তিনতলা বাড়ি প্রায় ৪০ ফুট উঁচু—এইরকম উনিশটা বাড়ি একটার মাথায় আরেকটা চাপালে তবে ৭৫০ ফুট উঁচু হয়! আমেরিকার এক একটা সহরে বিশতলা ত্রিশতলা চল্লিশতলা বাড়ির ছড়াছড়ি!—ভাবতে গেলে আমাদের মাথা ঘুলিয়ে যায়।
এক একটি বাড়ি যেন এক একটি সহর। তার মধ্যে কত অফিস কত দোকান কত হোটেল গির্জা ইস্কুল থিয়েটার বায়স্কোপ ডাকঘর সভাসমিতি! বাড়ির এক-এক জায়গায় সারি সারি খাঁচার মতো ঘর— তাতে চড়ে লোকে উঠছে নামছে, বিশ পঁচিশ তলা সিঁড়ি ভেঙে কষ্ট করে উঠতে হয় না। বাড়ির মধ্যে ত্রিশ হাজার লোক—সকলেই ব্যস্ত, চারিদিকে ছুটাছুটি অথচ কোন গোলমাল নেই। বন্দোবস্ত এমন সুন্দর যে কিছু একটা দরকার হলে তার জন্যে হাঁ করে বসে থাকতে হয় না বা বিশ মাইল দূরে ছুটতে হয় না। বাড়িতেই সবরকম দোকান—ঘরে বসে টেলিফোন কর, যা চাও দু মিনিটের মধ্যে ঘরে এসে হাজির!
বাড়িতে ঢুকলে দেখবে শুধু যে মাথার উপরে এতখানি দালান তা নয়—মাটির নিচেও দশ বিশ তলা। সেখানে সূর্যের আলো যাবার উপায় নেই—সারাদিন আলো জ্বেলে কাজ চলে। ওইসব নিচের তলাগুলোতে নানারকম কলকারখানা—ইলেকট্রিক কোম্পানির বড় বড় চাকাওয়ালা কল, বাড়ি গরম রাখবার জন্য বড় বড় ‘বয়লার’—বড় বড় ছাপাখানা তাতে সকাল সন্ধ্যা খবরের কাগজ ছাপা হয়। কোন কোন রাস্তার দুধারে এইরকম দশ বিশ তলা বাড়ির সার চলেছে—তার ছায়ায় রাস্তা যেন অন্ধকার—সেখানে সূর্যের মুখ দেখা যায় না—আকাশ দেখতে হলে ঘাড় বাঁকিয়ে উপরে তাকাতে হয়। কিন্তু যারা একেবারে উপরে ত্রিশ বা চল্লিশতলায় থাকে তাদের আলো বাতাসের কোন অভাব হয় না। রাস্তার ধূলা সহরের কুয়াশা অত উঁচুতে পৌঁছয় না—কাজেই সেখানকার হাওয়া অতি পরিষ্কার।
বাড়িগুলো দেখতে যেমন আশ্চর্য, এগুলি তৈরি করার কায়দাও তেমনি অদ্ভুত। বাড়ি তুলবার আগে প্রায় ১০০/১৫০ হাত গর্ত কেটে ভিৎ খুঁড়তে হয়। যেখানে বাড়ি হবে, তার চারদিকে খুব মজবুত আর খুব উঁচু ‘কপিকল’ বসায়। সেই কলে বড় বড় লোহার থাম চাপিয়ে থামগুলাকে হিসাবমত ঠিক ঠিক জায়গায় বসান হয়। তারপর থামের গায় লোহার কড়ি বরগা বসিয়ে সেগুলোকে পেরেক স্ক্রু দিয়ে এঁটে দেয়। এমনি করে সমস্ত বাড়িটার একটা কঙ্কাল আগে খাড়া করা হয়। তারপর ঢালাই করা পাথুরে মাটির দেওয়াল দিয়ে কঙ্কালটিকে ভরাট করে তাতে দরজা জানালা বসালে পর তখন সেটা বাড়ির মতো দেখতে হয়। যারা এইসকল কাজ করে তাদের যে অনেকখানি সাহস দরকার তা বুঝতেই পার। মাটি থেকে ৪০০ হাত উপরে লোহার বরগার উপর দিয়ে হাঁটাহাটি করা—তার উপরে বসে কাজ কর্ম করা, কখন বা উপর নিচ ওঠা নামা—এসব যেমন তেমন লোকের কাজ নয়।

কাগজ

এমন সময় ছিল যখন মানুষ লিখিতে শিখিয়াছে, কিন্তু কাগজ বানাইতে শিখে নাই। কোন কোন দেশে তখন পাথরে খোদাই করিয়া লিখিবার রীতি ছিল। কেহবা নরম মাটিতে লিখিয়া সেই মাটি পরে পোড়াইয়া ইঁটের টালি বানাইয়া লইত। সেই ইঁটেতেই তাহাদের কাগজের কাজ চলিয়া যাইত। কিন্তু এইরূপ ইঁটের টালি নিয়া লেখাপড়া করা যে বিশেষ অসুবিধার কথা তাহা সহজেই বুঝিতে পার। মনে কর কোন ছাত্র পাঠশালায় যাইতেছে। অমনি তাহার সঙ্গে সঙ্গে তিন ঝুড়ি ইঁটের পুঁথি চলিল—আর লিখিবার জন্য এক তাল কাদা। সামান্য কয়েকখানা চিঠি পাঠাইতে হইলেই প্রাণান্ত পরিশ্রম—মাটি আনরে, জল আনরে, ঠাসিয়া কাদা কররে, চৌকস কররে, টালি বানাওরে, তবে তাহাতে অক্ষর লেখরে, পোড়াওরে, ঠাণ্ডা কররে, মুটে ডাকরে—হাঙ্গামের আর অন্ত নাই।
ইহার চাইতে আমাদের দেশে যে গাছের পাতায় লেখার রীতি অনেকদিন চলিয়া আসিয়াছে সেটা অনেক সহজ এবং সুবিধাজনক। ৬০০০ বছর আগে ইজিপ্টে ‘পেপিরাস’ গাছের কচি ছাল পিটিয়া থ্যাৎলাইয়া কাগজের মতো একরকম জিনিস তৈয়ার করিত। এই পেপিরাস কথা হইতেই ইংরাজি পেপার (Paper) শব্দটা আসিয়াছে। কিন্তু এই পেপিরাস জিনিসটাকেও ঠিক কাগজ বলা যায় না। কাগজ তৈয়ারির উপায় প্রথম বাহির হইয়াছিল চীনদেশে; কিন্তু চীনারা এই বিদ্যা আর কাহাকেও শিখাইত না। প্রায় বার শত বৎসর হইল কতকগুলি চীনা করিকর আরবীদের সঙ্গে যুদ্ধে ধরা পড়ে। তাহাদের কাছে আরবের কারিকরেরা কাগজ বানাইতে শিখিয়া লইল, এবং সেইসময় হইতেই এই বিদ্যা চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে। আরব হইতে ইজিপ্ট, ইজিপ্ট হইতে আফ্রিকার অন্যান্য যায়গায় হয়।
তারপর স্পেন, জার্মানি, ইংলন্ডে সকল জায়গায়ই ক্রমে ক্রমে কাগজের কারখানা দেখা দিল। সে সময়ে ছেঁড়া নেকড়া দিয়া সমস্ত কাগজ তৈয়ারি হইত এবং সেটা আগাগোড়াই হাতে হইত। পরিস্কার নেকড়াকে ভিজাইয়া একটা দাঁতাল জিনিস দিয়া ঠেঙান হইত; তাহাতে জল মিশাইয়া আরও অনেকক্ষণ পিটিলে কতকটা পাৎলা মণ্ডের মতো একটা জিনিস হয়। এই নেকড়ার মণ্ডকে চালনিতে চালিয়া নানারকমে ছাঁকিয়া ঝাঁকাইয়া, লুচির মতো বেলিয়া তবে কাগজ তৈয়ারি হইত। সে সময়ে লোক কাগজটাকে খুব একটা সৌখীন জিনিস বলিয়াই মনে করিত, কিন্তু ক্রমে কাগজের দাম কমিয়া আসিল, কাগজ বানাইবার নানারকম কল বাহির হইল আর কাগজের কাট্‌তি এত বাড়িয়া গেল যে কাগজওয়ালারা দেখিল এক ছেঁড়া নেকড়াই জোগাড় করা সম্ভব নয়। তখন চারিদিকে খোঁজ পড়িয়া গেল, আর কি জিনিস হইতে কাগজ করা যাইতে পারে। প্রথমত স্পেন দেশের এস্পার্টো ঘাসে খুব কাগজ হইত, তারপর ক্রমে দেখা গেল তাহাতেও কুলায় না। সেই হইতে কাগজ বানাইবার জন্য কত জিনিস লইয়া যে পরীক্ষা হইয়াছে তাহা বলা যায় না। আখের ছিব্‌ড়া, কলার খোসা, পাট, খড়, ঘাস, বাঁশ, কাঠ—সুতার মতো আঁশওয়ালা, আখের মতো ছিব্‌ড়াওয়ালা যতরকম জিনিস আছে তার কোনটিই বাকী নাই। মোটের উপর বলা যাইতে পারে কাঠ, এস্পার্টো ঘাস আর পুরাতন নেকড়া ও কাগজ হইতেই আজকাল কাগজ প্রস্তুত হয়।
বোলতা যে চাক বানায় তাহার মধ্যে একটা জিনিস থাকে সেটা ঠিক কাগজের মতো। বোলতারা গাছের শাঁস খায় এবং সেই শাঁসকে চিবাইয়া হজম করিয়া এক কাগজ বাহির করে। আজকাল কাগজের কলেও সেইরূপে কাঠ ঘাস প্রভৃতি জিনিস হইতে নানারকম কাগজ তৈয়ারি হয়। অবশ্য কাগজওয়ালাদের ঐসব জিনিস বোলতার চিবাইতে হয় না; এ সব কজই কলে হয়।
যে কাঠ হইতে কাগজ প্রস্তুত হয় সে কাঠ আসে আমেরিকা ও নরওয়ের জঙ্গল হইতে। জঙ্গলওয়ালারা বড় বড় গাছের গুঁড়ি কাটিয়া কলের মুখে ফেলিয়া দেয়—আর কলের আর এক মাথায় কাঠ কুচি হইয়া বাহির হয়। সেই কুঁচিকে গুঁড়াইয়া, সিদ্ধ করিয়া পরিষ্কার করিতে হয়, তারপর সেই ক্ষীরের মতো নরম কাঠকে চাপ দিয়া পাতলা পাতলা পাটালি বানান হয়—এবং সেই পাটালি কাগজওয়ালাদের কাছে চালান দেওয়া হয়।
কাগজওয়ালারা এই পাটালিকে আবার জলে ঘুঁটিয়া মন্ড তৈয়ারি করেন, সেই মণ্ডকে সিদ্ধ করিয়া ঝোলের মতো করেন। এই ঝোল লোহার নলে করিয়া কাগজের কলের মধ্যে ঢালিয়া দেওয়া হয়। কল একদিকে কাঠ, ঘাস বা নেকড়ার ঝোল খাইতে থাকে আর একদিকে ৪/৫ মাইল লম্বা কাগজের থান বাহির করিতে থাকে। সমস্ত দিন রাত কল চলিলে বারো হাত চওড়া আড়াই মাইল লম্বা একখানা কাগজের থান বাহির হয়। তাহার পরে গরম জলের চৌবাচ্চার মধ্যে সেই মণ্ড গুলিয়া ঝোল তৈয়ারি হয়।
ঝোলটা যখন কলের মধ্যে চালান হয় তখন সেটা একটা লম্বা চলন্ত ছাঁকনির উপর পড়ে। ছাঁক্‌নিটা চলিতে থাকে আর মাঝে মাঝে কেমন একটা ঝাঁকানি দেয়, তাহাতে জল ঝরিয়া যায় এবং ঝোল ক্রমে চাপ বাঁধিয়া আসে। এমনিভাবে চলিতে চলিতে ঝোলটা কলের আরেক মাথায় আসিয়া পড়ে—সেখানে লুচি বেলিবার বেলুনের মতো অনেকগুলা রোলার খাটান থাকে। ছাঁক্‌নিটা এইখানে আসিয়া ঝোলটাকে একটা রোলারের গায়ে ছিটকাইয়া দেয়। কিন্তু সে ঝোল আর এখন ঝোল নাই; এখন তাহার চেহারা অনেকটা ভিজা ব্লটিং কাগজের মতো। এতক্ষণে তাহাকে ঠিক কাগজ বলা চলে।
রোলারের গায়ে কাগজ লাগিবামাত্র রোলার তাহাকে টানিতে থাকে। তারপর সেই টানে কগজও অনেকগুলি রোলারের মধ্যে ঘুরপাক খাইতে থাকে। এমনি করিয়া কাগজটাকে ক্রমাগত চাপ দিতে হয়, লুচির মতো বেলিতে হয়, ঘষিতে ও পালিশ করিতে হয়, তাহাতেই কাগজ ক্রমে পাতলা ও মোলায়েম হইয়া আসে।
অবশ্য এই সমস্ত কাজই কলে আপনা-আপনি হইতে থাকে। দু-একজন লোক থাকে তারা কেবল দেখে সমস্ত কল ঠিকভাবে চলিতেছে কিনা। চব্বিশ ঘণ্টা সমান হিসাবে কাজ চলে; কলের এক মাথায় অনবরত ঝোল আসিয়া পড়িতেছে—সেই ঝোলশুদ্ধ ছাঁক্‌নি কেবলই ছুটিতেছে, ছাঁক্‌নি হইতে জমাটবাঁধা কাগজ ক্রমাগতই রোলারের উপর লাফাইয়া পড়িতেছে, রোলারেরও বিশ্রাম নাই, সেও কাগজ টানিতেছে আর ঠেলিয়া বাহির করিতেছে। দুই চার মাইল কাগজ জমিলেই এক একটা ‘লাটাই’ ভরিয়া উঠে, তখন ‘লাটাই’ বদলাইয়া আবার নূতন “লাটাই” গলাইয়া দিতে হয়।

 গরিলা

গরিলা থাকে আফ্রিকার জঙ্গলে। গাছের ডালপালার ছায়ায় সে জঙ্গল দিনদুপুরেও অন্ধকার হয়ে থাকে; সেখানে ভাল করে বাতাস চলে না, জীবজন্তুর সাড়াশব্দ নাই। পাখির গান হয়ত ক্বচিৎ কখন শোনা যায়। তারই মধ্যে গাছের ডালে বা গাছের তলায় লতাপাতার মাচা বেঁধে গরিলা ফলমূল খেয়ে দিন কাটায়। সে দেশের লোকে পারতপক্ষে সে জঙ্গলে ঢোকে না— কারণ গরিলার মেজাজের ত ঠিক নেই, সে যদি একবার ক্ষেপে দাঁড়ায়, তবে বাঘ ভালুক হাতি তার কাছে কেউই লাগে না। বড় বড় শিকারী, সিংহ বা গন্ডার ধরা যাদের ব্যবসা, তারা পর্যন্ত গরিলার নাম শুনলে এগোতে চায় না।
পৃথিবীর প্রায় সবরকম জানোয়ারকেই মানুষে ধরে খাঁচায় পুরে চিড়িয়াখানায় আটকাতে পেরেছে— কিন্তু এ পর্যন্ত কোন বড় গরিলাকে মানুষে ধরতে পারেনি। মাঝে মাঝে দুটো একটা গরিলার ছানা ধরা পড়েছে কিন্তু তার কোনটাই বেশি দিন বাঁচেনি।
একবার এক সাহেব একটা গরিলার ছানা পুষবার চেষ্টা করেছিলেন, সেটার বয়স ছিল দু-তিন বৎসর মাত্র। তিনি বলেন, তার চালচলন, মেজাজ দুষ্টুমি বুদ্ধি ঠিক মানুষের খোকার মতো। তাকে যখন ধরে খাঁচায় বন্ধ করে রাখা হত, তখন সে মুখ বেজার করে পিছন ফিরে বসে থাকত। যে জিনিস সে খেতে চায় না সেই জিনিস যদি তাকে খাওয়াতে যাও, তবে সে চিৎকার করে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে অনর্থ বাধিয়ে বসবে। একদিন তাকে জোর করে ওষুধ খাওয়াবার জন্য চারজন লোকের দরকার হয়েছিল। তাকে যখন জাহাজে করে আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আনান হয়, তখন প্রায়ই জাহাজের উপর ছেড়ে দেওয়া হত কিন্তু সে কোনদিন কারো অনিষ্ট করেনি। তবে জাহাজের খাবার ঘরের পাশে যে একটা আলমারি ছিল, যার মধ্যে চিনি থাকত আর নানারকম মিষ্টি আচার ইত্যাদি রাখা হত সেই আলমারিটার উপর তার ভারি লোভ ছিল। কিন্তু সে জানত যে ওটাতে হাত দেওয়া তার নিষেধ, কারণ দু-একবার ধরা পড়ে সে বেশ শাস্তি পেয়েছিল। তারপর থেকে যখন তার মিষ্টি খেতে ইচ্ছা হত তখন সে কখনও সোজাসুজি আলমারির দিকে যেত না; প্রথমটা যেত ঠিক তার উল্টোদিকে, যেন কেউ কোনরকম সন্দেহ না করে! তারপর একটু আড়ালে গিয়েই এক দৌড়ে বারান্দা ঘুরে একেবারে আলমারির কাছে উপস্থিত!
একবার একটা গরিলার ছানাকে চিড়িয়াখানায় রাখা হয়েছিল। চিড়িয়াখানায় নানারকম অদ্ভুত জন্তু দেখতে তার খুব মজা লাগত— কোন কোনটার খাঁচার কাছে দাঁড়িয়ে খুব মন দিয়ে তাদের চালচলন দেখত। একটা শিম্পাঞ্জির বাচ্চা ছিল, সে নানারকম কসরৎ জানত— সে যখন ডিগবাজি খেয়ে বা হুটোপাটি করে নানারকম তামাসা দেখাত, গরিলাটা ভারি খুশি হয়ে তার কাছে এসে বসত।
গরিলার চেহারাটা মোটেও শান্তশিষ্ট গোছের নয়— মানুষের মতো লম্বা, চওড়ায় তার দ্বিগুণ, গায়ের জোরে তার দশটার মতো— তার উপর সে যখন রাগের চোটে চিৎকার করে নিজের বুকে কিল মারতে মারতে এগোতে থাকে তকন তার সেই শব্দ আর মুখভঙ্গী আর রকমসকম দেখে খুব সাহসী লোক পর্যন্ত ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ দেখলেই গরিলা তেড়ে এসে মারতে আসে না— বরং সে অনেকসময়ে মানুষকে এড়িয়েই চলতে চায়। কিন্তু তুমি একেবারে তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হও ত সে কি করে বুঝতে পারে যে তোমার কোন দুষ্ট মতলব নাই? বিশেষত লোকে যখন লাঠিসোটা নিয়ে হৈ হৈ করে জঙ্গলে হাজির হয়, তাতে যদি গরিলা খুশী না হয়, তবেই কি তাকে হিংস্র বলতে হবে?

গরিলার লড়াই

যতরকম বনমানুষ আছে তার মধ্যে, বুদ্ধিতে না হোক, শরীরের বলে গরিলাই সেরা। হাত-পায়ের মাংসপেশীর বাঁধন থেকে তার দাঁড়াবার ধরন আর ভ্রূকুটিভঙ্গি পর্যন্ত সবই যেন খাঁ খাঁ করে তেড়ে বলছে, “খবরদার! কাছে এস না।”
মানুষের মধ্যে এত বড় পালোয়ান কেউ নেই যে এক মিনিটের জন্যেও একটা গরিলার রোখ সামলাতে পারে। কিন্তু গরিলায় গরিলায় যদি লাগে, তাহলে সেটা দেখতে কেমন হয়? বড় বড় পালোয়ান কুস্তিগীরের লড়াই দেখতে কত মানুষ পয়সা দিয়ে টিকিট কেনে; সে লড়াই যতই ভীষন হয়, হুড়াহুড়ি ধস্তাধস্তি যতই বেশি হয়, মানুষের ততই উৎসাহ বাড়ে। কিন্তু গরিলাদের মধ্যেও কি সেরকম লড়াই বা রেষারেষি লাগে? লাগে বৈকি! এমন গরিলা পাওয়া গিয়েছে যার দাঁত ভাঙা বা কানটা ছেঁড়া, অথবা গায়ে মাথায় অন্য গরিলার দাঁতের চিহ্ন রয়েছে। লড়াইয়ের সময় কোন মানুষ উপস্থিত থেকে তা দেখেছে, আজ পর্যন্ত এরকম শোনা যায়নি- কিন্তু মাঝে মাঝে এরকম লড়াই যে হয়, নানারকম গর্জন আর হুংকার আর বুক চাপড়াবার গুম্‌ গুম্‌ শব্দে অনেক সময় তার পরিচয় পাওয়া যায়। গরিলা যখন ক্ষেপে, তখন রাগে সে খাড়া হয়ে দাঁড়ায় আর আপনার বুকে দমাদম্‌ কিল মারতে থাকে। তার চোখ দুটো তখন আগুনের মতো জ্বলজ্বল করে, তার কপালের লোম ফুলে ফুলে খাড়া হয়ে ওঠে আর সেই সঙ্গে নাকে ফস্‌ ফস্‌ আর দাঁতের কড়মড় শব্দ চলতে থাকে। তার উপর সে যখন হুংকার ছাড়ে, তখন অতিবড় সাহসী জন্তুও পালাবার পথ খুঁজতে থাকে। লোকে বলে, সে হুংকার নাকি সিংহের ডাকের চাইতেও ভয়ানক।
মনে কর, জঙ্গলের মধ্যে কোন গরিলাসুন্দরীর বিয়ের জন্য দুই মহাবীর পাত্র এসেছেন। দুজনেই তাকে ভালোবাসে, দুজনেই তাকে চায়, কেউ দাবি ছাড়তে রাজী নয়। এমন অবস্থায় পশুপাখির মধ্যে সর্বত্রই যা হয়ে থাকে, আর পুরাণের বড় বড় স্বয়ংবর সভাতেও যেমন হয়ে এসেছে, এখানেও ঠিক তাই হওয়াই স্বাভাবিক। তখন দুই বীর আপন আপন তেজ দেখিয়ে লড়াই করতে লেগে যায়। সে ভীষণ লড়াই যে একটা দেখবার মতো ব্যাপার তাতে আর সন্দেহ কি? গরিলার চড় আর গরিলার ঘুঁষি যার একটি মারলে মানুষের ভুঁড়ি ফেঁসে যায়, মাথার খুলি দু’ফাঁক হয়ে যায়, সে কেবল গরিলার গায়েই সয়। সেই চট্‌পট্‌ দুম্‌দুম্‌ কিল চড়ের সঙ্গে খাম্‌চা খাম্‌চি আর কাম্‌ড়া-কাম্‌ড়িও নিশ্চয়ই চলে। এইরকমে যতক্ষণ না লড়াইয়ের মীমাংসা হয়, অর্থাৎ এক পক্ষ হার মেনে চম্পট না দেয়, ততক্ষণ হয়ত গরিলাসুন্দরীর চোখের সামনেই এই ভীষণ কাণ্ড চলতে থাকে। সে বেচারা হয়ত চুপ করে তামাসা দেখে, কিংবা দুজনের মধ্যে কাউকে তার বেশি পছন্দ হয়, তবে তার পক্ষ হয়ে লড়াইয়ে এক্টু-আধটু যোগ দেওয়াও তার কিছু আশ্চর্য নয়।

জাহাজ ডুবি

সমুদ্রে চলিতে চলিতে প্রতি বৎসরই কত জাহাজ ডুবিয়া মরে। কেহ মরে ঝড় তুফানে, কেহ মরে ঢেউয়ের ঝাপটায়, কেহ মরে পাহাড়ের গুঁতায়, আর কেহ মরে অন্য জাহাজের ধাক্কা লাগিয়া– যুদ্ধের কথা না হয় ছাড়িয়াই দিলাম। এইরকম কত উপায়ে জাহাজ ডুবিতেছে তাহার ঠিকানাই নাই। এইসকল জাহাজের মধ্যে কত সময় কত লাখ লাখ টাকার জিনিস থাকে, সেগুলি সমুদ্রের তলায় পড়িয়া নষ্ট হইবে– ইহা কি মানুষের সহ্য হয়? বিলাতে বড় বড় ব্যবসাদার কোম্পানি আছে, তাহারা ডোবা-জাহাজ হইতে মাল উদ্ধার করে। এই কাজকে Salvage বলে! ইহাতে তাহারা এক-একসময় অনেক টাকা লাভ করিয়া থাকে। গভীর সমুদ্রে জাহাজ ডুবিলে তাহাকে আর বাঁচাইবার উপায় থাকে না; কিন্তু জল যদি খুব বেশি না হয় তবে অনেক সময় একেবারে জাহাজকে-জাহাজ উঠাইয়া ফেলা যায়।
জাহাজ উঠাইবার নানারকম উপায় আছে। এক উপায়, তাহার সঙ্গে বাতাস-পোরা বড় বড় বাক্স বাঁধিয়া তাহাকে হালকা করিয়া ভাসাইয়া তোলা। আর এক উপায়, তাহার চারিদিকে দেয়াল ঘিরিয়া সেই দেয়ালের ভিতরকার সমুদ্রকে ‘পাম্প’ দিয়া শুকাইয়া ফেলা। রুশ-জাপান যুদ্ধের সময় জাপানীরা যখন পোর্ট আর্থার দখল করে তখন সেখানকার বন্দরে রুশেরা কতগুলা জাহাজ ডুবাইয়া দিয়াছিল। জাপানীরা দেয়াল তুলিয়া সমস্ত বন্দরের মুখ আঁটিয়া দেয়; তার পর বড়ো বড়ো কল দিয়া বন্দরের জল সেঁচিয়া ফেলিতেই জাহাজগুলা বাহির হইয়া পড়িল। জাপানীরা সেই জাহাজ আবার মেরামত করাইয়া কাজে লাগাইয়াছে।
একবার স্পেন হইতে কিছু দূরে একটি জাহাজ জখম হইয়া ডুবিতে আরম্ভ করে। জাহাজের কাপ্তান দেখিল স্পেন পর্যন্ত পৌঁছিবার আগেই জাহাজ ডুবিয়া যাইবে। জাহাজের নীচেকার খোলে হাজার মণ লবণ বোঝাই রহিয়াছে– সকলে মিলিয়া সারাদিন লবণ ফেলিলেও তাহার কিছুই কমতি হইবে না। তাই তিনি হুকুম দিলেন, “জাহাজ ছাড়িতে হইবে, নৌকা নামাও।” এমন সময় এক সালভেজ কোম্পানির জাহাজ আসিয়া হাজির– তাহারা আসিয়াই ব্যাপার দেখিয়া জাহাজ ডুবিবার আগেই তাহা কিনিতে চাহিল। লবণ-জাহাজের কাপ্তান বলিল, “মাঝ সমুদ্রে জাহাজ ডুবিলে কিনিয়া লাভ কি?” সালভেজ কাপ্তান বলিল, “জাহাজ ডুবিতে দিব না।” শুনিয়া লবণের কাপ্তান হাসিয়া বলিল, “আমি ত জাহাজ ছাড়িয়াই দিব — তুমি কিনিতে চাও আমার আপত্তি কি?” জাহাজ কিনিয়াই নূতন কাপ্তান তাহাতে জল বোঝাই করিতে লাগিল– পুরাতন নাবিকেরা বলিল, “আহা কর কি? একেই জাহাজ ডুবিতেছে, আবার জল চাপাইতেছ? তুমি পাগল নাকি?” কাপ্তান কোন কথা না বলিয়া লবণের মধ্যে ক্রমাগতই জল ঢালিতে লাগিল। তারপর সমস্ত লবণ জলে গুলিয়া সেই লবণ-গোলা জলে পাম্প বসাইয়া হুড়্হুড় করিয়া জল সেঁচিয়া ফেলিল। জাহাজ হালকা হইয়া ভাসিয়া উঠিল। পুরাতন কাপ্তান ব্যাপার দেখিয়া আহাম্মক বনিয়া মাথা চুলকাইতে লাগিল।

ডুবুরি জাহাজ

প্রায় চল্লিশ বৎসর আগে একজন ফরাসি লেখক একটা গল্প লিখিয়াছিলেন, তাহাতে এক অদ্ভুত জাহাজের কথা ছিল। সে জাহাজকে মাছের মতো জলের উপর বা নিচ দিয়া যেমন ইচ্ছা চালান যাইত। সে সময়ে লোকের কাছে গল্পটা অসম্ভব গোছের শুনাইয়াছিল এবং অনেকে গল্পলেখকের ‘আজগুবি কল্পনার’ খুব প্রসংশা করিরাছিলেন। কিন্তু এখন আর এরূপ গল্পে লোকের আশ্চর্য হইবার কথা নয়,— কারণ, বাস্তবিকই ঐরকম জাহাজ এখন অনেকগুলি তৈয়ার হইয়াছে। শুধু ইংলন্ডেই এখন অন্তত পঁচাশিটা এইরূপ জাহাজ আছে।
জাহাজ যতক্ষণ জলের উপর থাকে ততক্ষণ তাহার পিঠে নানারকম মাস্তুল, দড়ি, কলকব্জা ইত্যাদি দেখা যায় কিন্তু জাহাজ ডুব মারিবার আগে এ সমস্ত গুটাইয়া লওয়া হয়। তখন কেবল দুটি চোঙা আর একটি টুপির মতো ঢাকনি জাহাজের উপরে থাকে। ঢাকনিটার গায়ে পুরু কাঁচের সারসি দেওয়া থাকে, তাহার ভিতর দিয়া জাহাজের কাপ্তান বাহিরের সমস্ত দেখিতে পান। জাহাজটা যতক্ষণ আধ-ডোবা অবস্থায় থাকে ততক্ষণ এইভাবে দেখার কাজ চলিতে পারে, কিন্তু আর কয়েক হাত ডুবিলেই সে পথ বন্ধ। তখন ঐ চোঙা দুটিই চোখের কাজ করে—চোঙার আগায় আয়না ও কাচ শুদ্ধ একটি যন্ত্র বসান থাকে, যন্ত্রটা ঘুরিয়া ঘুরিয়া চারিদিকে তাকাইতে থাকে—আর জাহাজের কাপ্তান নিচে বসিয়া সেই আয়নার সাহায্যে বাহিরের সমস্ত অবস্থা দেখিতে পান। দশ হাতের নিচে গেলে এই ‘দিকবীক্ষণ’ যন্ত্রও ডুবিয়া যায়, তখন কেবল আন্দাজে আর কম্পাস্‌ দেখিয়া জাহাজ চালাইতে হয়।
জাহাজের মধ্যে একটা লোহার চৌবাচ্চা থাকে—চৌবাচ্চাটা খালি থাকিলে জাহাজ জলের উপর ভাসে কিন্তু চৌবাচ্চাটার মধ্যে জল ভরিলে জাহাজ ভারি হইয়া ক্রমে ডুবিয়া যায়। এইরকমে জল বাড়াইয়া বা কমাইয়া জাহাজকে অল্প বা বেশি ডুবান যায়। তাড়াতাড়ি জল ভরিবার বা খালি করিবার জন্য জাহাজের মধ্যে বড় বড় ‘পাম্প’-কল রাখা হয়—তাহার সাহায্যে এক মিনিটের মধ্যে জাহাজকে পঞ্চাশ হাত জলের নিচে ডুবাইয়া দেওয়া যায়। জাহাজের দুই পাশে ও পিছনে মাছের ডানা ও লেজের মতো হাল বসান থাকে, সেইগুলিকে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া জাহাজের মুখ ডাইনে বাঁয়ে উপরে নিচে যেমন ইচ্ছা ফিরান যায়। পিছন দিকে দুইটা পাখার মতো ইস্ক্রুপ ঘুরিতে থাকে তাহাই জল কাটিয়া জাহাজকে চালায়। জাহাজের ভিতরে বড় বড় লোহার বোতলে চাপ দিয়া বাতাস ভরিয়া রাখা হয়। তাহাতে জাহাজের বাতাস অনেকক্ষণ পরিষ্কার রাখিবার সুবিধা হয় এবং অন্যান্য কাজও চালান যায়। ক্রমাগত চব্বিশ ঘণ্টা জলের নিচে থাকিলেও জাহাজের লোকেরা কোনরকম অসুবিধা বোধ করে না। জাহাজের এরূপ বন্দোবস্ত করা যায় যাহাতে একটা জাহাজ কোথাও না থামিয়া চার হাজার মাইল স্বচ্ছন্দে চলিয়া যাইতে পারে।
মনে কর আমরা এইরূপ একটা জাহাজের মধ্যে ঢুকিয়াছি—ঢুকিয়াই সকলের আগে চোখে পড়ে—জাহাজের এক মাথা হইতে আর এক মাথা পর্যন্ত কেবল চাকা আর লোহা আর কলকব্জা। চেয়ার টেবিল আসবাবপত্র নাই বলিলেই চলে। সমস্ত জাহাজটা যেন একটা প্রকাণ্ড বৈদ্যুতিক কারখানা; সেই বিদ্যুতে জাহাজ চলে এবং জাহাজের বাতি জ্বালা রান্না করা পর্যন্ত সমস্ত কাজ হয়। জাহাজের কাপ্তান কোথায়? ঐ যে তিনি জাহাজের ‘টুপি’র নিচে বসিয়া দিকবীক্ষণ যন্ত্র দিয়া চারিদিক দেখিতেছেন।
কাপ্তান উপর হইতে হুকুম করিতেছেন আর অন্য একটি কর্মচারী নাবিকদিগের দ্বারা সেই হুকুম তামিল করাইতেছেন। প্রত্যেক লোক তাহার নিজের নিজের জায়গায় প্রস্তুত হইয়া আছে—কখন কি হুকুম আসে! কাপ্তান বলিলেন, ‘জাহাজ ডাইনে ফিরাও’, অমনি একটা চাকা ঘুরাইবা মাত্র জাহাজ ডাইনে ফিরিয়া গেল। ‘থাম! টর্পিডোওয়ালা, প্রস্তুত হও।’ টর্পিডো কেন? শত্রুপক্ষের জাহাজ দেখা গিয়াছে। টর্পিডো বড় সাংঘাতিক অস্ত্র। একবার বিপক্ষের জাহাজে ভালমত টর্পিডো দাগিতে পারিলে আর দ্বিতীয়বার মারিবার দরকার হয় না। একটা প্রকাণ্ড ছুঁচোবাজির মতো তার চেহারা—তার ভিতরে বারুদ আর অদ্ভুত কল-কারখানা। ডুবুরি জাহাজের সামনেই টর্পিডোর কলখানা—সেই কলের চাবি টিপিলেই টর্পিডো ঘণ্টায় ৪০০ মাইল বেগে ছুটিয়া বাহির হয় এবং বিপক্ষের জাহাজে বা অন্য কোন শক্ত জিনিসে ঠেকিয়া বাধা পাইবামাত্র ভয়ানক শব্দে ফাটিয়া ও জাহাজ ফাটাইয়া এক তুমুল কাণ্ড বাধাইয়া দেয়। বড় ডুবুরি জাহাজে ৩/৪টি পর্যন্ত টর্পিডো কল থাকে। ‘টর্পিডোওয়ালা প্রস্তুত হও!’ হুকুম আসিবামাত্র তাহারা প্রস্তুত! সকলেই জানিয়াছে বিপক্ষের জাহাজ আসিতেছে—কাহারও মুখে টুঁ শব্দটি নাই। জাহাজের মধ্যে কেবল কলের বন্‌ বন্‌ শব্দ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নাই।
হুকুম আসিল ‘৪০ হাত নামাও’—বলিতে বলিতে জাহাজ ডুবিতে লাগিল। একটা কলের কাঁটা আস্তে আস্তে সরিয়া যাইতে লাগিল—২০ হাত, ২৫ হাত, ৩০ হাত। ৪০-এর দাগে কাঁটা নামিল। এখন আর বাহিরের কিছুই দেখা যায় না। কাপ্তান এখন ঘড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকাইয়া আছেন। বিপক্ষের জাহাজটি ঠিক কোনদিকে এবং কতদূরে তিনি খুব ভাল করিয়া তাহার হিসাব লাইয়াছেন—তাঁহার জাহাজ কিরকম জোরে চলিতেছে তাহাও তিনি জানেন—সুতরাং তিনি ঠিক বলিতে পারেন কোন্‌ মুহূর্তে দুই জাহাজ কতখানি তফাৎ থাকিবে। নিঃশব্দে জলের নিচে জাহাজ চলিতেছে—শত্রুজাহাজ কিন্তু তাহার কিছুই জানে না। ‘জাহাজ উঠিতে দাও’—আবার কলের কাঁটা নড়িয়া উঠিল—’ত্রিশ হাত, বিশ হাত, দশ হাত—বাস!’—’সম্মুখের টর্পিডো হুঁশিয়ার হও!’ এতক্ষণে দিকবীক্ষণ যন্ত্র ভাসিয়া উঠিয়াছে—আবার সব দেখা যাইতেছে। আধ মাইল দূরে শত্রুর জাহাজ—প্রকাণ্ড যুদ্ধজাহাজ। প্রায় ২০টা ডুবুরি জাহাজের সমান। কাপ্তান একমনে হিসাব করিতেছেন জাহাজটা আরেকটু সামনে সরুক, আরেকটু, আরেকটু—বাস! ‘ছাড়’! একটা ভয়ানক ধাক্কা লাগিল—ডুবুরি জাহাজ কাঁপিতে কাঁপিতে প্রায় কাৎ হইয়া গেল—হালের নাবিক তাড়াতাড়ি তাহাকে সামলাইয়া লইল। কিন্তু বিপক্ষের জাহাজে যে টর্পিডো লাগিল সে আর তাহা সামলাইতে পারিল না। জাহাজের গায়ে বিশ হাত গর্ত—জাহাজটা মাতালের মতো টলিতে টলিতে গব্‌ গব্‌ করিয়া জল খাইতে লাগিল, তারপর মাথা নিচু করিয়া ডিগবাজী খাইয়া দেখিতে দেখিতে এত বড় জাহাজটা ডুবিয়া গেল।
ডুবুরি কিন্তু সেখানে দাঁড়াইয়া থাকে নাই—সে একেবারে ডুব মারিয়া প্রাণপণে ছুটিয়াছে। যতক্ষণ সে তাহার ‘চোখ’টুকু মাত্র বাহির করিয়া চোরের মতো আসিতেছিল শত্রুরা তাহাকে দেখিতে পারে নাই কিন্তু টর্পিডো ছাড়িবামাত্র জল তোলপাড় হইয়া উঠিল—আর সকলেই বুঝিতে পারিল ‘ঐ ডুবুরি’। বিপক্ষের কামান হইতে একটি গোলা যদি ডুবুরির ঘাড়ে পড়ে তবে আর তার রক্ষা নাই। শুধু যে যুদ্ধের সময়েই দুবুরি জাহাজের বিপদের ভয় থাকে তাহা নয়। জলের পথে চলা-ফিরা করিতে গিয়া তাহার যে কত সময় কতরকম দুর্ঘটনা ঘটে ভাবিলেও ভয় হয়। জলের নিচ হইতে উঠিতে গিয়া হয়ত কোন জাহাজের সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়া গেল। হয়ত কোনখানে এতটুকু ফাঁক, কোথায় কলের কব্জা এতটুকু বেঠিক বসিয়াছে—আর অমনি জাহাজ বিগড়াইয়া একেবারে পাথরের মতো ডুবিয়া গেল—শত চেষ্টায়ও আর তাহাকে উঠান গেল না। এরকম কতবার ঘটিয়াছে এবং কত লোক তাহাতে মারা গিয়াছে! জাহাজ ডুবিয়া গেল; ডুবুরি নামাইয়া দেখা গেল ভিতরে মানুষ বাঁচিয়া আছে, ঠক্‌ ঠক্‌ শব্দ করিলে তাহারা ভিতর হইতে সাড়া দেয়, অথচ তাহাদের বাঁচাইবার কোন উপায় নাই। যাহাতে এরকম দুর্ঘটনা না হয়, তাহার জন্য প্রতি বৎসর কত নূতন নূতন বন্দোবস্ত করা হইতেছে এবং জাহাজ ডুবিলেও যাহাতে ভিতরের লোকেরা পালাইয়া আসিতে পারে তাহারও ব্যবস্থা হইতেছে।

 ডুবুরী

জলের তলায় ডুব দিয়ে যাদের কাজ করতে হয় তাদের বলে ডুবুরী। লোকে যে-সকল দামী মুক্তা দিয়ে গহনা বানায় সেই মুক্তাগুলি জন্মায় সমুদ্রের নিচে এক জাতীয় ঝিনুকের মধ্যে। ঝিনুক থেকে একরকম রস বেরিয়ে খোলার মধ্যে ফোড়ার মতো হয়ে জমে থাকে—তাকে আমরা বলি ‘মুক্তা’। সবচেয়ে বড় আর ভাল যেসব মুক্তা, সেগুলি জন্মায় একরকম পোকার উৎপাতে। সেই পোকার কেমন বদ অভ্যাস, সে সুবিধা পেলেই ঝিনুকের খোলার মধ্যে ঢুকে ঝিনুক বেচারাকে অস্থির করে তোলে। ঝিনুকও তখন বেশ করে রস ঢেলে দিয়ে তাকে জীয়ন্ত কবর দিয়ে রাখে। সেই পোকার কবরগুলিকে ডুবুরীরা সমুদ্রের তলা থেকে কুড়িয়ে আনে, আর সৌখিন লোকে হাজার হাজার টাকা দিয়ে সেগুলি কিনে যত্ন করে তুলে রাখে।
যেসব মুক্তা অল্প জলে থাকে ডুবুরীরা কেবল সেইগুলিকেই আনতে পারে—কারণ বড়জোর দেড়শ হাতের বেশি এ-পর্যন্ত কোন ডুবুরীই নামতে পারেনি। এমন অনেক ডুবুরী আছে যারা শুধু একটা পাথর-বাঁধা দড়ি নিয়ে দম বন্ধ করে প্রায় দেড় মিনিট কি দু-মিনিট ৩০/৪০ হাত জলের নিচে থাকতে পারে। কিন্তু আজকালকার ডুবুরীরা একরকম অদ্ভুত পোশাক পরে জলে নামে। ডুবুরীর পিঠে একটা দড়ি বাঁধা থাকে, তাই টেনে ডুবুরী উপরের লোকদের ইশারা করে আর তারা তাকে উঠায় নামায়। ডুবুরীর মাথায় একটা লোহার মুখোশ—তাতে পুরু কাচের জানালা বসান, তাই দিয়ে সে দেখতে পায়— আর টুপির আগায় একটা নল তা দিয়ে উপর থেকে বাতাস আসে, তবে সে নিশ্বাস ফেলতে পারে। পোশাকটি এমন যে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কোনখান দিয়ে এক ফোঁটাও জল ঢুকতে পারে না। ডুবুরীদের পায়ে প্রকাণ্ড ভারি সীসার জুতো আর পিঠেও সীসার বোঝা। জলের নিচে কাজ করার বিপদ অনেকরকম! প্রথম ভয় এই যে যদি পোশাকের মধ্যে কোনরকমে জল ঢুকতে পারে তবে ডুবুরীকে পিষে থ্যাঁৎলা করে ফেলবে। পোশাকটিকে সমস্তক্ষণ বাতাস দিয়ে ফুটবলের মতো পাম্প করে রাখতে হয়—তাহলেই ডুবুরী আর জলের চাপ টের পায় না। ঐ জোরে পাম্প-করা বাতাস যখন পোশাকের মধ্যে ঢোকে তখন ডুবুরীর গায়ের সমস্ত রক্ত আর রস বোতলে-পোরা সোডা ওয়াটারের মতো সেই বাতাস শুষে নেয়। এ অবস্থায় যদি তাকে হঠাৎ উপরে টেনে তোল, তবে সোডার বোতল খুললে যা হয় তার শরীরের মধ্যে তেমনি একটা কাণ্ড চলতে থাকে। এইরকমে কত লোক মারা গেছে। সেইজন্য তুলবার সময়ে খুব সাবধানে আস্তে আস্তে দড়ি টানতে হয় আর মাঝে মাঝে থামাতে হয়। যদি পোশাকটি ভাল করে এঁটে পরা না হয়, আর সীসার বোঝাটি কোনরকম খুলে যায় তবে ডুবুরী তৎক্ষণাৎ বিদ্যুতের মতো ছিট্‌কিয়ে উপরে ভেসে উঠবে; তাতেও তার হাড়গোড় চুরমার হয়ে যেতে পারে। এসব ছাড়া হাঙর বা অন্য জলজন্তুর ভয় ত আছেই। ডুবুরীরা হাঙরের চাইতেও ভয় করে ‘অক্টোপাস’কে। পিটার স্নেল একজন নামজাদা ডুবুরী ছিল। সে একবার জলে নামতেই একটা প্রকাণ্ড অক্টোপাস শুঁড়ের মতো আত পা বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। ভয়ে স্নেল পাগলের মতো ছুরি চালাতে চালাতে তার দড়ি ধরে প্রাণপণে টানতে লাগল। অনেক টানাটানির পর যখন তাকে প্রায় আধমরা অবস্থায় উপরে তোলা হল, তখনও জানোয়ারটার কয়েকটা কাটা পা তার গায়ে লেগে ছিল। তার ওজন প্রায় আধ মণ।
আর একটা জিনিস আছে যাকে ডুবুরী দিয়ে কুড়িয়ে এনে লোকে ব্যবসা করে। তাকে আমরা বলি ‘স্পঞ্জ’ (sponge)—সেই যে ফুটোওয়ালা নরম জিনিস যাতে জল শুষে নেয় আবার চাপ দিলে জল বেরিয়ে আসে। স্পঞ্জ জিনিসটা একরকম অদ্ভুত জলজন্তুর খোলস বা কঙ্কাল বা বাসা—যা ইচ্ছা বলতে পার। সমুদ্রের তলায় স্পঞ্জের দল সার বেঁধে মাটি আঁকড়িয়ে পড়ে থাকে, ডুবুরীরা তাকে সেখান থেকে ছিনিয়ে আনে।
রাউল নামে একজন লোক স্পঞ্জ তুলবার জন্য একরকম ডুবুরী গাড়ি তৈরি করেছেন। দুজন ডুবুরী তার মধ্যে স্বচ্ছন্দে বসতে পারে। স্পঞ্জ দেখবার জন্য গাড়ির সামনে একটা উজ্জ্বল আলো থাকে। গাড়ির নিচে চাকা আর পিছনে দুটা দাঁড়, তাতেই তার চলা-ফিরা চলে। আর সামনে ডাণ্ডার আগায় একটা হাঁ-করা মতন জিনিস আছে—ঐটা দিয়ে স্পঞ্জ আঁকড়ে আনে।
আজকাল ডুবুরীর পোশাকের নানারকম উন্নতি হয়েছে—কোনটার পিঠে বাতাসের বন্দোবস্ত, তার আলাদা নল লাগে না; কোনটার মধ্যে টেলিফোনের কল, উপরের সঙ্গে কথাবার্তা চলে—আর কোনটার এমন সুবিধা আছে যে ডুবুরী ইচ্ছা করলে কারও সাহায্য ছাড়াই উপরে উঠতে পারে।

পাতালপুরী

পাতাল দেশটা কোথায় তাহা আমি জানি না। অনেকে বলেন আমেরিকার নামই পাতাল। সে যাহাই হউক, মোটের উপর পাতাল বলিতে আমরা বুঝি যে, আমাদের নিচে একটা কোন জায়গা—আমরা এই যে মাটির উপর দাঁড়াইয়া আছি, তার উপরে যেন স্বর্গ আর নিচে যেন পাতাল!
এখানে যে জায়গার কথা বলিতেছি সেটাকে পাতালপুরী বলা হইল এইজন্য যে সেটা মাটির নিচে। মাটির নিচে ঘরবাড়ি, মাটির নিচে রেলগাড়ি, মাটির নিচে হোটেল সরাই গির্জা—সমস্ত সহরটাই মাটির নিচে। সহরটা কিসের তৈয়ারি জান? নুনের! আসলে সেটা একটা নুনের খনি। অস্ট্রিয়ার কাছে—মাটির নিচে এই অদ্ভুত সহর। হাজার হাজার বৎসর লোকে এই খনিতে খুঁড়িয়া খুঁড়িয়া লবণ তুলিয়াছে। এখনও প্রতি বৎসর এই খনি হইতে প্রায় বিশ লক্ষ মণ লবণ বাহির হয়—কিন্তু তবু লবণ ফুরাইবার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। মাটির নিচে পঁচিশ মাইল চওড়া ৫০০ মাইল লম্বা লবণের মাঠ। খুঁড়িয়া দেখা গিয়াছে এক হাজার ফুটের নিচেও লবণ।
খনির মধ্যে খানিকটা জায়গায় বড় সুরঙ্গ কাটিয়া পথঘাট কর হইয়াছে তাহার মাঝে মাঝে এক-একটা বড় ঘরের মতো। খনিটা ঠিক যেন একটা সাততালা পুরী, তার নিচের চারতালায় কুলিরা কাজ করে, উপরের তিনতালায় লবণ ফুরাইয়া আসিয়াছে—সেখানে এখন লোকে তামাসা দেখিতে আসে।
খনির মুখে ঢুকিলেই লবণের সিঁড়ি; সেই সিঁড়ি বাহিয়া লোকে নিচে নামে—কিংবা যদি ইচ্ছা হয় নিচে নামিবার যে কল আছে সেখানে পয়সা দিলেই কল চড়িয়া নিচে নামা যায়। প্রথমতালায় অর্থাৎ উপরের তালায়, একটা প্রকাণ্ড সভাঘর। চারিদিকে লবণের দেয়াল, লবণের থাম, লবণের কারিকুরি, তার মধ্যে লবণের ঝাড়লণ্ঠন। এই ঘর দেড়শত বৎসর আগে তৈয়ারি হইয়াছিল। কত বড় বড় লোকে, রাজা-রাজড়া পর্যন্ত, এই সভায় বসিয়া আমোদ-আহ্লাদ করিয়া গিয়াছেন। সভার এক মাথায় একটা সিংহাসন। একখানা আস্ত লবণের টুকরা হইতে এই সিংহাসন কাটা হইয়াছে। ঘরের মধ্যে যখন আলো জ্বালান হয়, তখন সমস্ত ঘরটি স্ফটিকের মতো জ্বলিতে থাকে। লাল নীল সাদা কতরকম রঙের খেলায় চোখে ধাঁধা লাগাইয়া দেয়। লবণ জিনিসটা যে কতদূর সুন্দর হইতে পারে শুধু খানিকটা নুনের গুঁড়া বা কর্‌কচের টুকরা দেখিয়া তাহার ধারণাই করা যায় না।
সভাঘরের খুব কাছেই সেন্ট আন্টনির মন্দির। মন্দিরের মধ্যে আলো বেশি নাই, লবণের থামগুলি আধা-আলো আধা-ছায়ায় আর স্ফটিকের মতো ঝক্‌ঝক্‌ করে না; এক-এক জায়গায় সাদা মার্বেল পাথরের মতো দেখায়। মন্দিরের ভিতরটায় জাঁকজমক বেশি নাই। চারিদিক নিস্তব্ধ—সভাঘরের হৈ চৈ গোলমাল এখানে একেবারেই পৌঁছয় না।
এখান হইতে দ্বিতীয় তালায় নামিবার জন্য আবার সিঁড়ি—সিঁড়িটা একটা প্রকাণ্ড ঘরের মধ্যে নামিয়াছে। ঘরের ছাদটা একটা গম্বুজের মতো। চারিদিকে বড় বড় কাঠের ঠেকা দেওয়া হইয়াছে তা না হইলে ছাদ ভাঙিয়া পড়িতে পারে। ঘরটা এত উঁচু যে তাহার মধ্যে আমাদের গড়ের মাঠের মনুমেন্টটিকে অনায়াসে খাড়া করিয়া বসান যায়। ঘরের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড লবণের ঝাড়লণ্ঠন, তাহার মধ্যে তিনশত মোমবাতি জ্বালান হয়—কিন্তু তাতেও এত বড় ঘরের অন্ধকার দূর হয় না।
দেড় শত বৎসর আগে এই ঘরেই খনির আড্ডা ছিল। লবণ খুঁড়িতে খুঁড়িতে খনিতে বড় বড় ফাঁক হইয়া যায়। এই ঘরটিও সেইরকম একটি ফাঁক মাত্র। লোকে উপর হইতে লবণ তুলিতে আরম্ভ করে—ক্রমে যতই লবণ ফুরাইয়া আসিতে থাকে তাহারা একতালা দোতালা করিয়া ততই নিচে নামিতে থাকে।
তৃতীয় তালায় নামিয়া কতগুলি ছোটখাট ঘর ও নানা লোকের কীর্তিস্তম্ভ দেখিয়া লবণের পোল পার হইতে হয়। তার পরেই হোটেল রেলওয়ে স্টেশন ইত্যাদি। সেগুলিও দেখিবার মতো জিনিস। মাটির সাত শত ফিট নিচে একটা লোনা হ্রদ আছে, এমন লোনা জল বোধহয় আর কোথাও নাই। অন্ধকার গুহা, তার মধ্যে ঠাণ্ডা কালো জল—কোথাও একটু কিছু শব্দ হইলে চারিদিকে গম্‌গম্‌ করিয়া প্রতিধ্বনি হইতে থাকে। সে জলের উপর লোকে যখন নৌকা চালায় তখন জলের ছপ্‌ছপ্‌ শব্দ চারিদিক হইতে অন্ধকারে ফিস্‌ফিস্‌ করিতে থাকে—যেন পাতালপুরীর হাজার ভূতে কানে কানে কথা বলে।

 পার্লামেন্টের ঘড়ি

বিলাতের যে শাসন-সভা, যেখানে সে দেশের খরচপত্র আইনকানুন ব্যবসাবাণিজ্য প্রভৃতি নানা ব্যাপারের আলোচনা ও ব্যবস্থা করা হয়—তার নাম পার্লামেন্ট। পার্লামেন্টের বাড়ির দুই মাথায় দুই চূড়া— তারই একটার গায়ে মাটি হইতে প্রায় ১২৫ হাত উঁচুতে পার্লামেন্টের ঘড়ি বসান। ঘড়িটা এত বড় যে রাস্তার লোকে এক মাইল দূর হইতে সেই ঘড়ি দেখিয়া অনায়াসে সময় ঠিক করিতে পারে।
রাস্তা হইতেই প্রকাণ্ড ঘড়িটা চোখে পড়ে, কিন্তু বাস্তবিক ঘড়িটা যে কত বড় তাহা বুঝিতে হইলে একটিবার তাহার ভিতরে ঢোকা দরকার। একটি লোহার প্যাঁচান সিঁড়ি ঘুরিয়া ঘড়ির কামরায় ঢুকিতে হয়। ঘড়ির চারিদিকে চারিটি মুখ, এক একটি মুখে এক একটি ঘর, তাতে দোতালা বাড়ির মতো উঁচু ঘষা কাচের জানালা। জানালার বাহিরে ঘড়ির কাঁটা—এক একটা সাড়ে সাত হাত লম্বা। রাত্রে সেই ঘরগুলির মধ্যে জানালার পিছনে অনেকগুলি বড় বড় গ্যাসের পাতি জ্বলাইয়া রাখে, তাহাতে ঘড়ির সমস্ত মুখটা আলো হইয়া উঠে। কিন্তু এই ঘরের মধ্যে ঘড়ির কল-কব্জা কিছুই দেখা যায় না। ঘড়ির যে ঘণ্টা বাজে তাহাও এখান হইতে দেখিবার যো নাই—সে সমস্ত ভিতরের আর-একটা ঘরের মধ্যে। ঘণ্টাটি একটি দেখিবার জিনিস। গম্বুজের মতো প্রকাণ্ড কাঁসার ঘণ্টা, তার ওজন সাড়ে তিনশত মণেরও বেশি। প্রথম যখন ঘণ্টাটি তৈয়ারি হইয়াছিল তখন কিছুকাল ব্যবহারের পর সেটা ফাটিয়া যায়; তখন সেটাকে আবার ঢালাই করিয়া নূতন করিয়া গড়া হইল। কিছুদিন পরে নূতন ঘণ্টাতেও ফাটল দেখা দিল। তারপর বছর তিনেক ঘণ্টা বাজান বন্ধ ছিল; পরে হাতুড়িটা বদলাইয়া একটা হালকা, অর্থাৎ সাড়ে পাঁচ মণ ওজনের হাতুড়ি দেওয়ায় আর ফাটল বাড়িতে পারে নাই। এই বড় ঘণ্টাটি ছাড়া আরও চারিটি ছোট ছোট ঘণ্টা আছে, সেগুলি পনের মিনিট অন্তর টুং টাং করিয়া বাজে। ‘ছোট’ বলিলাম বটে কিন্তু এগুলির এক একটির ওজন ৩০ হইতে ১০০ মণ। ঘড়ির পেন্ডুলামটি প্রায় সাড়ে আট হাত লম্বা, দোলকটির ওজন প্রায় ৪ মণ।
ঘড়িতে দম দেওয়া এক প্রকাণ্ড ব্যাপার। প্রতি সোম বুধ ও শুক্রবার দুইজন লোককে ক্রমাগত কয় ঘণ্টা পরিশ্রম করিয়া এই কাজটি করিতে হয়। ছোট ছোট ঘণ্টাগুলি যতক্ষণ বাজিতে থাকে, সেই ফাঁকে তাহারা একটু বিশ্রাম করিয়া নেয়, আবার মিনিট পনের চাবি ঘুরায়—এইরকম করিয়া সারাটা বিকাল ধরিয়া দম দেওয়া হয়। এই সমস্ত কলকারখানার উপরে, একেবারে চূড়ার আগায় একটা প্রকাণ্ড বাতি। এই বাতি যখন দপ্‌ করিয়া জ্বলিয়া উঠে তখন লোকে বুঝিতে পারে, পার্লামেন্টের সভা বসিয়াছে। চূড়ার কাছে উঠিলে আর একটা আশ্চর্য জিনিস দেখা যায়—ঘড়ির কল-কব্জার অনেক নিচে একটা জায়গায় দিনরাত একটা প্রকাণ্ড চুল্লি জ্বলিতেছে। চুল্লির আঁচে ঘড়ির ভিতরটা সকল সময় সমানভাবে গরম থাকে; কোথাও এলোমেলো ঠাণ্ডা লাগিয়া কলকব্জা বিগড়াইতে পারে না।
এত বড় ঘড়ি, ইহার জন্য খরচও হইয়াছে কম নয়। ঘড়ির চারটি মুখের জানালায় লেখা কাঁটা ইত্যাদি শুদ্ধ প্রায় আশি হাজার টাকা লাগিয়াছে। ঘণ্টাগুলির দাম প্রায় লক্ষ টাকা—কলকব্জায় প্রায় ষাট হাজার টাকা। সমস্ত ঘড়িটার দাম প্রায় সওয়া তিন লক্ষ টাকা।

বেবুন

যেসব বানরের মুখ কুকুরের মতো লম্বাটে, যারা চার পায়ে চলে, যাদের ল্যাজ বেঁটে আর গালের মধ্যে থলি আর পিছনের দিকটায় কাঁচা মাংসের ঢিপি, তাদের নাম বেবুন। বেবুনের আসল বাড়ি আফ্রিকায়, কেউ কেউ এশিয়াতেও থাকেন। বেবুন বংশের অনেক শাখা— হলদে বেবুন, লালমুখো বেবুন, ঝুঁটিওয়ালা কালো বেবুন, চিত্রমুখ স্নগ-বেবুন বা ম্যানড্রিল, চাকমা বেবুন, ড্রিল বেবুন ইত্যাদি। কিন্তু সকলেরই মুখের ভঙ্গী চালচলন ও স্বভাব প্রায় একইরকম। উঁচু উঁচু ধারাল দাঁত, বদ্‌খত মেজাজ আর তার চাইতেও বদ্‌খত চেহারা। সমস্ত জানোয়ারের মধ্যে বিদঘুটে চেহারা যদি কারও থাকে তবে সে ঐ ম্যানড্রিলের। টকটকে লাল নাক, খাঁজকাটা নীল গাল, ভেংচিকাটা ভ্রূকুটি মুখ, সব মিলে অপূর্ব চেহারাখানা হয়!
আফ্রিকার পাহাড়ে জঙ্গলে বেবুনেরা দল বেঁধে লুকিয়ে থাকে। ‘বল, বুদ্ধি, ভরসা’ এই তিন জিনিসের জোরে সে নীচের জমিতে নেমে এসে চাষার ক্ষেতের উপর অত্যাচার করে ফল শস্য খেয়ে পালায়। তাদের দল বাঁধবার কায়দা, আর পথঘাট পাহারা দেবার ব্যবস্থা এমন চমৎকার, আর এমন হঠাৎ এসে লুটপাট করে তারা ফস্‌ করে পালায় যে, চাষারা তাদের সঙ্গে কিছুতেই পেরে ওঠে না। পালাবার সময় বেবুনেরা কখনও দলের কাউকে ফেলে যায় না— যদি একজন বিপদের পড়ে অমনি পালের গোদারা তাকে সাহায্য করবার জন্য তেড়ে আসে। একবার একটা বাচ্চা বেবুনকে কতগুলো কুকুরে ঘেরাও করে ফেলেছিল, কিন্তু একটা ধাড়ি বেবুন এসে সেই কুকুরের দলের মধ্যে ঢুকে, এমনি দু-তিন ভেংচি দিয়ে তাদের মুখের সামনে থেকেই সেই বাচ্চাটাকে কেড়ে নিয়ে গেল যে, কুকুরগুলো ভয়ে কিছুই করতে সাহস পেল না— দূরে শিকারীরা পর্যন্ত তার তেজ দেখে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
বিপদে পড়লে বেবুনেরা পিছনের পায়ে ভর করে খাড়া হয়ে বসে— শ্ত্রুকে হাতের কাছে পেলেই নখ দিয়ে খাম্‌চে টেনে মুখের কাছে নিয়ে এসে, তার পরেই প্রচণ্ড এক কামড়। কামড়ের জোরে হাড়গোড় পর্যন্ত অনায়াসেই গুঁড়িয়ে দিতে পারে। নখ দাঁতই হচ্ছে বেবুনের প্রধান অস্ত্র— কিন্তু দরকার হলে তারা পাথর ছুঁড়তেও জানে। বড় বড় পাথর গড়িয়ে শত্রুর মাথায় ফেলতে তারা খুব ওস্তাদ।

 রাবণের চিতা

লোকে বলে রাবণের চিতায় যে আগুন দেওয়া হয়েছিল সে আগুন নাকি এখনও নিভান হয়নি—এখনও তা জ্বলছে। কোথায় গেলে সে আগুন দেখা যায় তা আমি জানি না—কিন্তু এমন আগুন দেখা গেছে যা বছরের পর বছর ক্রমাগতই জ্বলছে; মানুষ তাতে জল ঢেলে মাটি চাপা দিয়ে নানারকমে চেষ্টা করেও তাকে নিভাতে পারেনি।
খনি থেকে কয়লা এনে সেই কয়লা দিয়ে লোকে আগুন জ্বালায়। কিন্তু তা না করে যদি একেবারে খনির মধ্যেই আগুন ধরিয়ে খনিকে খনি জ্বালিয়ে দেওয়া যায় তবে কিরকম হয়? বাস্তবিকই এমন সব কয়লার খনি আছে যার আশেপাশে বারো মাসই আগুন জ্বলে। সেসব খনির লোকেরা সব সময়ে ভয়ে ভয়ে থাকে—কখন সে আগুন খনির মধ্যে এসে পড়ে। কোনদিকে যদি খনির দেয়াল একটু গরম হয় কিংবা খনির কাছে কোন জায়গা যদি বসে-যাবার মতো হয়, তবেই হৈচৈ লেগে যায়—’আগুন আসছে, আগুন আসছে’। খনির একদল লোক আছে তাদের কাজ কেবল আগুন তাড়ান। যেদিক দিয়ে আগুন আসছে বোধ হয়, তারা সেইদিকে ইঁট পাথরের দেয়াল তুলে আগুনের পথ বন্ধ করে দেয়। আগুন তখন বাধ্য হয়ে আর কোন দিক ঠেলে তার পথ করে নেয়। কেমন করে কোথা হতে আগুন আসে তা সব সময়ে বলা যায় না। মাটির নিচে হয়ত বিশ পঁচিশ মাইল জায়গা জুড়ে কয়লার স্তর রয়েছে—কোথাও ১০০ হাত, কোথাও হয়ত পাঁচ হাত মাত্র পুরু। তারই কোনখানে যদি কোন গতিকে আগুন ধরে আর তার আশেপাশে পাহাড়ের ফাটলে যদি বাতাস যথেষ্ট থাকে—তবে সে আগুন একেবারে ‘রাবণের চিতা’ হয়ে দাঁড়ায়।
খোলা বাতাসে কয়লা যেমন ধূ ধূ করে জ্বলে যায়, মাটির নিচে তেমন হয় না—সেখানে আগুন যেন শামুকের মতো আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে থাকে। যেদিকে তার পথ খোলা, যেদিকে একটু কয়লা আর বাতাস—আগুন একদিনে হোক এক বছরে হোক সেদিকটা দখল করবেই। অনেক দিন আগে একবার ইংলন্ডের একটা গির্জা হঠাৎ বসে যেতে আরম্ভ করল—তার দেয়াল মেঝে সব দেখতে দেখতে হাঁ করে উঠল। এঞ্জিনিয়ার এসে মাটি খুঁড়ে দেখেন ১২ হাত নিচেই কয়লার স্তর আর তাতে আগুন লেগেছে—কয়লা যতই পুড়ে যাচ্ছে, উপরের মাটিও ততই ধ্বসে পড়ছে। তখন পরামর্শ করে সকলে গির্জার মেঝেটা খুঁড়ে প্রকাণ্ড একটা ফুটো করলেন। সেই ফুটোর মধ্যে প্রায় এক পুকুর জল ঢেলে দেওয়া হল—তারপর মাটি খুঁড়ে লোহার শিক বসিয়ে তার নিচে দেয়ালের গায়ে দেয়াল তুলে সবাই ভাবল, ‘এবারে আগুন জব্দ হয়েছে।’ কিন্তু সাতাশ বৎসর পরে আবার সেই আগুন কয়লা পুড়িয়ে পুড়িয়ে তিন দিক ঘুরে গির্জার পিছনে এসে হাজির।
অনেকদিন আগে লিভারপুলের কাছে টড্‌ নদীর ধারে এক কয়লার খনি ছিল। হঠাৎ কেমন করে সেই খনির এক কোণে আগুন লেগে যায়। খনিশুদ্ধ লোক প্রাণপণ চেষ্টা করেও যখন সে আগুন নিভান গেল না, তখন খনির কর্তারা খাল কাটিয়ে টড্‌ নদীকে খনির মধ্যে ছেড়ে দিলেন। তাতে তখনকার মতো আগুন চাপা পড়ল বটে কিন্তু জলের স্রোত খনির এমন দুরবস্থা করল যে কর্তারা ভয় পেয়ে গেলেন। তারপর যখন কিছুদিন না যেতেই আগুন আবার আর একদিকে এসে উঁকি মারল তখন সকলেই বললেন আগুন নিভাবার চেষ্টা বৃথা—ওকে কোনরকমে ঠেকিয়ে রাখ। যেদিকে আগুন আসবার ভয় সেদিকের কয়লা সরিয়ে ফেল, বড় বড় খাল কেটে দেয়াল তুলে, পথ বন্ধ কর। তাহলেই আগুন আর ছড়াতে পারবে না—ক’দিন বাদে আপনি নিভে যাবে। এইরকমে ছাব্বিশ বছর আগুনের সঙ্গে যুদ্ধ চলল। একদল লোক কেবল ওই কাজেই দিন রাত লেগে রইল; যারা ছোট ছিল তারা প্রায় বুড়ো হয়ে এল; খনির পাশে দেয়ালের পর দেয়াল উঠল, আগুনের উপর নিচে চারদিকে ঘেরাও হয়ে গেল—কিন্তু আগুন কি থামতে চায়! দেয়াল ভেঙে, পাথর ফাটিয়ে আগুনের শিখা বারবার দেখা দিতে লাগল; আগুন বেড়েই চলল।
একদিকে যেমন আগুন, আর একদিকে জল! পাহাড়ের ফাটল দিয়ে টড্‌ নদীর জল এসে খনির মধ্যে দিনরাত পড়ত—সেই জল পাম্পকল দিয়ে ক্রমাগত বাইরে ফেলে দিতে হয়। একদিন টড্‌ নদীতে জোয়ার লেগে উপরের মাটি ধসে গিয়ে কবেকার পুরান এক সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে খনির ভিতরে হু হু করে জল ঢুকল। ভাগ্যিস তখন খনির মধ্যে লোক ছিল না, গোলমাল শুনে তারা সকলে খনির মুখের কাছে দৌড়ে এল। ব্যাপারটা কি বুঝতে কারও বাকী রইল না; সকলেই বলতে লাগল এই জল যদি আগুনে গিয়ে পড়ে, তবে কি হবে? আগুনে জলে যখন দেখা হল তখন কয়েক মিনিট ধরে একটা ভয়ানক গর্জন আর যুদ্ধ চলল—ফুটন্ত জল ফোয়ারার মতো দুশ হাত উঁচু হয়ে এমন জোরে ছুটে বেরুল যে তার ধাক্কায় খনির মুখের কলকব্জা সব কোথায় উড়ে গেল। তারপর দেখতে দেখতে সব চুপচাপ! আগুন ঠাণ্ডা হল আর সঙ্গে সঙ্গে খনির দফাও ঠাণ্ডা।
গিরিধির কাছে একটা কয়লার স্তরে আজ ক-বছর হল আগুন ধরেছে। গরমে মাটি ফাটিয়ে পাহাড় তাতিয়ে সে আগুন এখনও জ্বলছে!

 লুপ্ত সহর

‘লুপ্ত সহর’ লিখিলাম বটে—কিন্তু আসলে সে সহর এখনও একেবারে লোপ পায় নাই। সহরের পথঘাট, দোকানপাট এমনকি ঘরের আসবাব পর্যন্ত অনেক জায়গায় ঠিক রহিয়াছে অথচ সে সহর আর এখন সহর নাই—সেখানে লোক থাকে না, কোন কাজ চলে না—মাঝে মাঝে নানা দেশ হইতে লোক আসে কিন্তু সেও কেবল ‘তামাসা’ দেখিবার জন্য।
পম্পেয়াই—আড়াই হাজার বৎসরের পুরাতন সহর, ইটালির পাগলা পাহাড় ভিসুভিয়াস তাহাতে ছাই চাপা দিয়া আগুন ঢালিয়া একেবারে সহরকে সহর বুজাইয়া দিয়াছিল। প্রায় আঠার শত বৎসর এমনিভাবে সহর চাপা পড়িয়াছিল—সেখানে যে সহর ছিল সেই কথাই লোকে ভুলিয়া গিয়াছিল—কারণ বাহির হইতে সহরের চিহ্নমাত্র দেখা যাইত না। চাষারা নিশ্চিন্তে চাষ করিত, লোকে স্বচ্ছন্দে চলা-ফিরা করিত, কাহারও মনে হয় নাই যে এই মাটি খুঁড়িলেই প্রকাণ্ড সহর বাহির হইয়া পড়িবে। তারপর, সে প্রায় একশত বৎসরের কথা, সেই মাটির নিচ হইতে মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব জিনিস বাহির হাইতে লাগিল। বাড়ির টুকরা, পাথরের বেদী, বাঁধান রাস্তা এইসকল দেখিয়া তখন লোকের মনে পড়িল দু হাজার বৎসর আগে এইখানে প্রকাণ্ড সহর ছিল।
পম্পেয়াই বড় যেমন-তেমন সহর ছিলা না—সেকালের ইতিহাসে লেখে, তিন লক্ষ লোক সে সহরে বাস করিত। জায়গাটা সমুদ্রের ধারে আর খুব স্বাস্থ্যকর, তাই বড় বড় রোমান ধনীরা অনেকে সেখানে থাকিতেন। খুব জমকালো সহর বলিয়া সে সময় পম্পেয়াই-এর খুব নাম ছিল। ভিসুভিয়াসের যে কোনরকম দুষ্ট মতলব আছে তাহা কেহ জানিত না তাই একেবারে পাহাড়ের গা ঘেঁষিয়া সহর বসান হইয়াছিল।
সহর ধ্বংস হয় ৭৯ খৃষ্টাব্দে। তখন রোমান ধনীরা তাঁহাদের সুন্দর সহরকে সুন্দর করিয়া সাজাইয়া আরামে আলস্যে দিন কাটাইতেছেন—পম্পেয়াই সহর বাবুয়ানায় মত্ত। কোন বিপদের চিহ্ন নাই, তখন বলিতে গেলে পৃথিবীময় রোমান রাজ্য—রোমের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, রোমানদের সঙ্গে শত্রুতা করে কার সাধ্য! লোকে নিশ্চিন্ত আছে কোথাও ভয় নাই! মাঝে মাঝে একটু আধটু ভূমিকম্প হইত, পাহাড়ের ভিতরে গুর গুর শব্দ শোনা যাইত, কিন্তু তাহাতেও লোকের বিশেষ কোন ভয় নাই। কিছুদিন দেখিয়া শুনিয়া সকলেরই সেসব অভ্যাস হইয়া গেল। তারপর একদিন হঠাৎ পাহাড়ের চূড়া ভাঙিয়া কালো ধোঁয়া দম্‌কা হাওয়ার মতো চারিদিকে ছুটিয়া বাহির হইল। সেই ধোঁয়ায় পঞ্চাশ মাইল পথ এমন অন্ধকার হইয়া গেল যে মাটি আর আকাশ তফাৎ করা যায় না। তারপরে খানিকক্ষণ গরম ধূলার তুফান চলিল। ইহার মধ্যে যাহারা সহর ছাড়িয়া পলাইয়াছিল তাহাদের অনেকে বাঁচিতে পারিয়াছিল। কিন্তু সহরের মধ্যে একজন লোকও বাঁচে নাই। ঝড়ের সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ চমকাইতে লাগিল, ক্রমাগত ভয়ানক বাজ পড়িতে লাগিল। ভূমিকম্প আরম্ভ হইল, বাড়িঘর ঠক্‌ঠক্‌ করিয়া কাঁপিতে লাগিল, ভিসুভিয়াস সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো ফুলিয়া ফুলিয়া শেষটায় ভয়ানক শব্দে ফাটিয়া গেল। পাহাড়ের ভিতর হইতে লক্ষ লক্ষ মণ জ্বলন্ত পাথর ছিটকাইয়া চারিদিকে আগুন বৃষ্টি করিতে লাগিল। ইহার পরেও হয়ত অনেক লোক বাঁচিতে পারিত কিন্তু এখানেই বিপদের শেষ হইল না। ভিসুভিয়াসের ভিতরকার পাথর গরমে গলিয়া ভাঙা পাহাড়ের ফাটল দিয়া সহরের উপর গড়াইয়া পড়িল, সমস্ত সহরটা যেন টগ্‌বগ্‌ করিয়া ফুটিয়া উঠিল। অনেকে আগুনের ভয়ে সমুদ্রের দিকে পলাইয়াছিল কিন্তু সেখানেও রক্ষা নাই। এই প্রলয় কাণ্ডের মধ্যে সমুদ্র কি স্থির থাকিতে পারে? সে প্রথমটা তীর হইতে পিছাইয়া গেল। দেখিয়া বোধ হইল যেন সমুদ্র আগুনের ভয়ে হটিয়া যাইতেছে। সমুদ্রের জন্তুগুলি শুকনা ডাঙায় পড়িয়া কত যে মারা গেল তাহার ঠিক নাই। কিন্তু সমুদ্র যাইবে কোথায়? একটু পরেই ভূমিকম্পের একটা ধাক্কার সঙ্গে সে আবার আসিয়া পড়িল, এবং নৌকা ঘরবাড়ি পথঘাট যাহা ছিল সমস্ত ভাঙিয়া ভাসাইয়া প্রমাণ করিয়া দিল যে, ‘আমিও বড় কম নই।’ জল, মাটি, আকাশ—এই তিনের রেষারেষির মধ্যে পড়িয়া দেখিতে দেখিতে দেশটার চেহারা বদলাইয়া গেল। ভিসুভিয়াসের উপরটা আগে ছাদের মতো সমান ছিল—সেই জায়গাটা বাটর মতো গর্ত হইয়া গেল—সেই বাটির মধ্যে আবার একটা নূতন ছুঁচাল চূড়া বাহির হইল। আর পম্পেয়াই?—পম্পেয়াই যেখানে ছিল সেখানে প্রায় ত্রিশ হাত উঁচু পাথর মাটি আর ছাই!
সেই পম্পেয়াই আবার এতদিন পরে মানুষে কত যত্নে খুঁড়িয়া খুঁড়িয়া বাহির করিতেছে। দু হাজার বৎসর আগে মানুষেরা কি খাইত, তাহাদের ঘর বাড়ির বন্দোবস্ত কিরকম ছিল, তাহাদের হাট বাজার সরাইখানা সভাঘর মন্দির কিরূপ ছিল এখন আমরা চোখের সামনে দেখিতে পাই। ভিসুভিয়াস একদিকে যেমন সহরটাকে নষ্ট করিয়াছে আর একদিকে আবার সেই ভাঙা সহরকে ছাই চাপা দিয়া এতকাল আশ্চর্যরকম রক্ষা করিয়াছে। খুঁড়িতে খুঁড়িতে কত মানুষের মৃতদেহ পাওয়া যায়—সেগুলি সমস্তই জমিয়া পাথর হইয়া রহিয়াছে। কোন জায়গায় দু-একটি, কোথাও অনেকগুলি লোক একত্র মরিয়া আছে। কোথাও মা অন্ধকারে তাঁহার শিশুকে খুঁজিতে গিয়া মারা পড়িয়াছেন। কাহারও হাতে টাকার থলি, কাহারও হাতে গহনার বাক্স।
চারিদিকে ভয়ের ছবি; লোকে ব্যস্ত হইয়া চারিদিকে পলাইয়াছে—অন্ধকারে পথ হারাইয়া দিক্‌বিদিক ভুলিয়া পাগলের মতো ছুটিয়াছে। এই গোলমাল ব্যস্ততার ঠিক মধ্যেই এক রোমান প্রহরী ফটকে পাহারা দিতেছিল। আশ্চর্য তাহার সাহস, সে তাহার জায়গা ছাড়িয়া এক পা-ও নড়ে নাই, পালাইবার চেষ্টাও করে নাই। ফটকে থাকিতে হইবে এই তাহার কর্তব্য—সুতরাং ‘যো হুকুম!’ সে ফটকের সামনে খাড়া থাকিয়াই মারা গেল এবং এইরূপ অবস্থাতেই অস্ত্রশস্ত্র বর্মশুদ্ধ তাহার দেহ পাওয়া গিয়াছে। কর্তব্য-নিষ্ঠার এরূপ আশ্চর্য পরিচয় জগতে খুব কমই পাওয়া যায়।
এখন সেই সহরের মধ্য দিয়া হাঁটিয়া যাইতে কেমন অদ্ভুত লাগে। অনেক জায়গায় দু হাজার বৎসর আগে যে জিনিসটি যেখানে ছিল একনও ঠিক তেমনি আছে—এক জায়গায় একটা টেবিলে খাওয়া-দাওয়া চলিতেছিল হঠাৎ লোকে খাওয়া ফেলিয়া পালাইয়াছে—সেই টেবিল সে খাওয়া তেমনি রহিয়াছে—রুটিটা জমিয়া পাথরের মতো হইয়া গিয়াছে—ছিপি-আঁটা মাটির বোতলে মদ ছিল, সেই মদ পর্যন্ত ঠিক রহিয়াছে! এক জায়গায় হাঁড়িতে কি যেন জ্বাল হইতেছিল—সেই হাঁড়ি এখনও চুল্লির উপর সেইভাবে বসান রহিয়াছে। কোন জায়গায় বাড়ির ইঁট পুড়িয়া ঝামা হইয়া গিয়াছে; আবার কোথাও সাদা টালি, লালা কালো নানারকম পাথরের কাজ, সমস্তই পরিষ্কার রহিয়াছে। একটা দেয়ালের গায়ে বিজ্ঞাপন লেখা আছে-
“আসেলিনাস্‌ ও স্মাইরিনে বলিতেছেন—ফস্‌কাস্‌কে তোমাদের অলডারম্যান পদে নিযুক্ত কর।” ফস্‌কাস্‌ বেচারা এই সম্মান পাইয়াছিল কিনা তাহা জানিবার আর কোন উপায় নাই।

 শিকারী গাছ

উপযুক্তরকম জল মাটি বাতাস আর সূর্যের আলো পাইলেই গাছেরা বেশ খুশী থাকে, আর তাহাতেই তাহাদের রীতিমত শরীর পুষ্টি হয় আমরা ত বরাবর এইরকমই দেখই এবং শুনি। তাহারা যে আবার পোকা মাকড় খাইতে চায়, শিকার ধরিবার জন্য নানারকম অদ্ভুত ফাঁদ খাটাইয়া রাখে এবং বাগে পাইলে পাখিটা ইঁদুরটা পর্যন্ত হজম করিয়া ফেলে, এ কথাটা চট্‌ করিয়া বিশ্বাস করা শক্ত। কিন্তু অনুসন্ধান করিয়া দেখা গিয়াছে যে পৃথিবীর নানা জায়গায় নানা জাতীয় গাছ এই শিকারী বিদ্যা শিখিয়াছে। তাহারা যে সখ করিয়া পোকা খাওয়া অভ্যাস করিয়াছে তাহা নয়, ঠেলায় পড়িয়াই ঐরূপ করিতে বাধ্য হইয়াছে। অনেক শিকারী গাছের বাস এমন স্যাঁতসেতে জায়গায় এবং সেই সকল জায়গা গাছের পক্ষে এত অস্বাস্থ্যকর যে সেখানে তাহারা তাহাদের শরীর রক্ষার উপযোগী মাল-মসলা ভাল করিয়া জোগাড় করিতে পারে না। এরূপ অবস্থায়, দু একটা পোকা, মাছি বা ফড়িং যদি তাহারা খাইতে না পারিত তবে তাহাদের বাঁচিয়া থাকাই মুস্কিল হইত।
আগেই বলিয়াছি, শিকারী গাছ নানারকমের আছে। ইহাদের শিকার ধরিবার জায়গাও নানারকম। কোন কোন গাছের পাতায় মাছি বা পোকা বসিলে পাতাগুলি আস্তে আস্তে গুটাইয়া যায়। মাছি বেচারা কিছুই জানে না, নিশ্চিন্ত মনে পাতার রস খাইতেছিল, হঠাৎ দেখে চারিদিকে ঘেরা, তাহার মধ্যে সে বন্দী! পাতার গায়ে লোমের মতো সরু সরু কাঁটা, তাহারই মুখে আঠার মতো রস লাগান থাকে; সেই রসে আটকাইয়া শিকারের পালাইবার আরও অসুবিধা হয়। শুধু তাহাই নহে, পাতা গুটাইয়া গেলে পরে সেই সকল কাঁটার মুখ হইতে একরকম তীব্র হজমি রস বাহির হয়, তখন পোকাটা যতই ছট্‌ফট্‌ করে, ততই আরও বেশি করিয়া রস বাহির হয়। তাহাতেই শিকার মরিয়া শেষে হজম হইয়া যায়। তারপর আপনা হইতেই আবার পাতা খুলিয়া যায়। জলের মধ্যে একরকম গাছ থাকে, তাহার সাদা ফুল; জলের ধারে একধরনের খুব রংচঙে গাছ থাকে, তাহার পাতাগুলির চেহারা কতকটা কদম ফুল গোছের। আর একরকমের গাছ থাকে, তাহাতে ঠিক যেন মোচার খোলের মতো পাতা সাজান। এই সবগুলি এক প্রকারের শিকারী গাছ এবং ইহাদের শিকার ধরিবার কায়দাও প্রায় একরকম। মনে কর একটা মস্ত পোকা ওই কদম ফুলের মতো গাছটিতে উঠিয়াছে। আর একটু পরেই গাছের পাতাগুলি গুটাইয়া মাঝখানে আসিয়া মিলিবে—একটি ফুটন্ত ফুল মুড়িয়া আবার কুঁড়ি হইয়া গেলে যেমন হয়, সেইরূপ! তখন পোকা বেচারার আর পালাইবার পথ থাকিবে না।
আর একরকমের অদ্ভুত গাছ আছে, এক একটা পাতার আগায় গোলাপী রঙের কি একটা জিনিস, তার চারদিকে কাঁটা। এই জিনিসগুলি Fly-trap (মাছি-মারা ফাঁদ)। এক একটা ফাঁদ যেন মাখখানে কব্জা দিয়া আটকান, বইয়ের মতো খোলে আবার বন্ধ হয়। কোন পোকা হয়ত পাতায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, কোন বিপদের চিহ্ন নাই; ঘুরিতে ঘুরিতে সে ওই ফাঁদের মধ্যে আসিয়া উপস্থিত। হয়ত দূরে থাকিয়া তাহার ঐ রংটা খুব পছন্দ হইয়াছিল—তাই সে দেখিতে আসিল ব্যাপারখানা কি। কিন্তু সে জানে না যে ফাঁদের গায়ে সরু সুতার মতো কি লাগান রহিয়াছে, তাহাতে ছুঁইলেই ফাঁদ বন্ধ হইয়া যায়! সে যেমন একটি সুতায় পা অথবা ডানা লাগাইয়াছে অমনি—খট্‌! ফাঁদ ছুটিয়া একেবারে বেমালুম বন্ধ হইয়া গেল। এখানে আর আঠার দরকার নাই, কারণ ফাঁদটি রীতিমত মজবুত এবং খুব চট্‌পট্‌ কাজ সারে। আর একরকম শিকারী গাছ আছে, তাহাদের শিকার ধরিবার জন্য থলি বা চোঙা থাকে। এই থলি বা চোঙার মধ্যে পোকা বেশ সহজেই ঢুকিতে পারে কিন্তু বাহির হওয়া তত সহজ নয়। ইহাদের ভিতর সরু সরু কাঁটা থাকে—সেগুলির মুখ সব নীচের দিকে, আর তার গায়ে মোমের মতো একরকম কি মাখান থাকে, তাহাতে পোকাগুলি বেশ সহজেই সুড়্‌ সুড়্‌ করিয়া পিছলাইয়া নামিতে পারে। কিন্তু উপরে উঠিবার সময় ত আর পিছলাইয়া উঠা যায় না—তা ছাড়া কাঁটার খোঁচাও যথেষ্ট খাইতে হয়। এইসকল থলির তলায় প্রায়ই জল জমিয়া থাকে, পোকা যখন বার বার পালাইবার চেষ্টা করিয়া হয়রান হইয়া পড়ে, তখন সে ওই জলের মধ্যে পড়িয়া মারা যায়। এইসকল গাছে পোকাকে ফাঁকি দিবার এতরকম উপায় থাকে যে ভাবিলে অবাক হইতে হয়। কোনটার মুখে ঢাকনি থাকে; সে ঢাকনির উপর হইতে চাপ দিলে খুলিয়া যায়! কিন্তু ভিতর হইতে ঠেলিলে খোলে না। প্রায় সবগুলিরই মুখের কাছে খুব সুন্দর রঙিন কাজ আর তার চারিদিকে মধু। সেই মধু খাইতে খাইতে পোকা ভিতরের দিকে ঢুকিতে থাকে—যত খায় তত মিষ্টি! শেষে এক জায়গায় গিয়া দেখে তাহার পরে আর মধু নাই—তখন সে ফিরিতে চায়! কিন্তু ফিরিতে আর পারে না। কোন কোন থলির ভিতরে খানিকটা জায়গা স্বচ্ছ মতন—ঠিক যেন সার্‌সি। পোকাগুলি মনে করে এই পলাইবার পথ—আর ক্রমাগত সে সারসির গায়ে উড়িয়া উড়িয়া হয়রান হইয়া পড়ে। কখন কখন এমনও হয় কোন ছোট পাখি বা ইঁদুর হয়ত জল খাইতে আসিয়া ফাঁদের মধ্যে পড়িয়া যায় এবং আর বাহির হইতে না পারিয়া প্রাণ হারায়!

সূক্ষ্ম হিসাব

একজন লোককে তাহার বয়স জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল। সে তৎক্ষণাৎ কাগজ পেন্সিল লইয়া হিসাব করিয়া বলিল, “আঠার বৎসর তিন মাস ষোল দিন চার ঘণ্টা—কত মিনিট ঠিক বলতে পারলাম না।” যিনি প্রশ্ন করিয়াছিলেন তিনি ত উত্তর শুনিয়া চটিয়াই লাল। বাস্তবিক, আমাদের সকল কাজের যদি এরকম চুলচেরা সূক্ষ্ম হিসাব রাখিতে হয়, তবে হিসাবের খবর লইতেই সমস্ত জীবনটা কাটিয়া যাইত।
মনে কর বাহিরে ভয়ানক ঝড় বহিতেছে। একজন বলিল, “উঃ, ভয়ানক জোরে হাওয়া দিচ্ছে।” যিনি সূক্ষ্ম হিসাব চান তিনি তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করিবেন, “ভয়ানক জোরটা কিরকম জোর? ঘণ্টায় কত মাইল বেগে চলছে? একদিকেই যাচ্ছে, না দিক বদলাচ্ছে? কিরকমভাবে বাড়ে কমে?” ইত্যাদি। যাঁহারা মেঘ বৃষ্টি বাতাস লইয়া আলোচনা করেন তাঁহারা এইরকম সব খবর সংগ্রহ করিবার জন্য নানারকম সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কল ব্যবহার করেন। বাহিরে খুব এক চোট বৃষ্টি হইয়া গেল। লোকে দেখিয়া বলিল, “বাস্‌রে, কি ঝমাঝম্‌ বৃষ্টি।” কিন্তু আমাদের সূক্ষ্ম হিসাবী পণ্ডিতরা হয়ত বলিবেন, “এই বৃষ্টিকে যদি সমানভাবে মাটির উপর ধরিয়া রাখ যাইত তবে ঠিক এক ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি জল দাঁড়াইত।”
শীত গ্রীষ্ম বুঝাইবার জন্য আমরা কতখানি ঠাণ্ডা বা কতখানি গরম তাহাও ভাষায় কতবার বলিতে চেষ্টা করি—যেমন, ‘শীতে হাড় জমে গেল; বড্ড শীত; বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে; একটু যেন গরম; বেশ গরম; ভয়ানক গ্রীষ্ম; উঃ, গরমে গা ঝলসে গেল’ ইত্যাদি। কিন্তু বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতের কাছে যাও, তিনি চট্‌ করিয়া বলিয়া দিবেন “আর এত ‘ডিগ্রী’ ঠাণ্ডা হইলেই বরফের মতো ঠাণ্ডা হাইবে” বা “আর এত ‘ডিগ্রী’ গরম বাড়িলে ফুটন্ত জলের মতো গরম হাইবে।” এক ঘটি ঠাণ্ডা জল রহিয়াছে, তুমি তাহাতে এক ফোঁটা গরম জল ফেলিয়া দাও,—কোন তফাৎ বুঝিতে পারিবে না। কিন্তু এমন যন্ত্র আছে যাহা দ্বারা পরীক্ষা করিয়া পণ্ডিতেরা তৎক্ষণাৎ বলিয়া দিতে পারিবেন, “এই জলটা একটু গরম হইল।” এখান হইতে পঞ্চাশ হাত দূরে একটা বাতি জ্বালিয়া রাখ আর এখানে বসিয়া যন্ত্রের মুখ তাহার দিকে ফিরাইয়া দাও। অমনি দেখিবে, কলের মধ্যে সূক্ষ্ম কাঁটা সেই গরমেই চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে।
একটি কাগজের ঠোঙায় খানিকটা চাল রহিয়াছে তুমি হয়ত দাঁড়িপাল্লা দিয়া মপিয়া বলিলে “আধসের চাল।” বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতের কাছে যাও, তিনি তাঁহার চমৎকার দাঁড়িপাল্লায় ওজন করিয়া বলিবেন, “না, ঠিক আধসের হয়নি। আরও প্রায় দেড়খানা চাল দিলে তবে ঠিক আধসের হবে।”
আমরা কথায় বলি ‘চুল চেরা’ হিসাব আর মনে করি চুলকে চিরিতে গেলে বুঝি হিসাবটা নিতান্তই সূক্ষ্মরকম হয়। কিন্তু যাঁহারা অনুবীক্ষণ লইয়া কাজ করেন তাঁহারা বলিবেন, “চুলটা ত একটা দস্তুরমত মোটা জিনিস। একটা চুলকে হাজার বার চিরলে তবে বলি—”হ্যাঁ, হিসাবটা কতকটা সূক্ষ্ম বটে।” অনুবীক্ষণের সাহায্যে পণ্ডিতেরা যে সকল সূক্ষ্ম জিনিসের খবর রাখেন, তাহাদের মধ্যে অনেকগুলি এতই সূক্ষ্ম যে তাদের একটার কাছে একটা ছোট পিঁপড়া যেন ছারপোকার পাশে হাতীর মতো দেখায়! এক ইঞ্চিকে একশ ভাগ, জাহার ভাগ, লক্ষ ভাগে চিরিয়াও পণ্ডিতদের হিসাবের পক্ষে যথেষ্ট সূক্ষ্ম হয় না। এক চৌবাচ্চা জলের মধ্যে একটা সরিষার মতো ছোট চিনির টুকরা ফেলিয়া দাও। তাহার এক চামচ জলের মধ্যে যতটুকু চিনি থাকে তাহার চাইতেও অল্প পরিমাণ জিনিস পরীক্ষা করিয়া পণ্ডিতেরা সেইসব জিনিস সম্মন্ধে অনেক আশ্চর্য খবর সংগ্রহ করিয়াছেন।
খুব তাড়াতাড়ি ‘কাট্‌’ বলিতে চেষ্টা করত। কতক্ষণ সময় লাগে? হিসাব করিয়া দেখা গিয়াছে কথাটা শেষ হইতে প্রায় এক সেকেন্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময় লাগে। একটা দ্রুত চলন্ত ট্রেন ততক্ষণে পাঁচ ছয় হাত চলিয়া যায়। কিন্তু বৈজ্ঞানিক হিসাবীর কাছে সময়ের এ-হিসাবটা খুবই মোটা। ট্রেনটা এক চুল পরিমাণ নড়িতে যতটুকু সময় লাগে সেইটুকু সময়ের মধ্যে যাহা ঘটিতেছে বৈজ্ঞানিক তাহার সন্ধানও রাখিয়া থাকেন। এইখানে হঠাৎ একটা আলো জ্বালিয়া দেখ, আলোক ছুটিয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িবে এবং তৎক্ষণাৎ লোকে দেখিবে ‘এই আলো জ্বলিল?’ ‘তৎক্ষণাৎ’ বলিলাম, কিন্তু বৈজ্ঞানিক বলিবেন “তৎক্ষণাৎ নয়, একটু পরে। ওই অনেক দূরে যারা রয়েছেন তাদের কাছে আলো পৌঁছিতে কিছু সময় চাই ত।” যদি জিজ্ঞাসা কর “কতখানি সময় লাগে” তিনি বলিবেন “ট্রেনটা যতক্ষণ এক ইঞ্চি যাবে, আলো ততক্ষণে কলকাতা থেকে ছুটে গিয়ে মধুপুরে হাজির হবে!”

Exit mobile version