মথুর। কি ভয়ানক কথা! তাহলে মাছ খাওয়া মানে পিতৃমাংস ভক্ষণ? আচ্ছা দেড় টাকা সেরের চুনো পুঁটিও কি আমাদের পূর্বপুরুষ?
অঘোর। চুনো পুঁটি কই মাগুর ইলিশ রুই কাতলা সবাই। তবে চিংড়ির কথা আলাদা, ওরা হল মাকড়সা আর কাকড়াবিছার সগোত্র।
মথুর। মহাভারত! তা হলে খাব কি?
অঘোর। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি বলছে, হাতি ঘোড়া থেকে পোকা মাকড় পর্যন্ত সব প্রাণীই মানুষের ভক্ষ্য। প্রবৃত্তি বলছে, বাছা বাছা গুটিকতক প্রাণীই খেতে ইচ্ছা করে। অন্তরাত্মা বলছে, নিরামিষেই যখন কাজ চলে তখন জীব-হিংসার দরকার কি।
ফণী। সব গাঁজা। আমিষ ত্যাগ করলে মানুষের অধঃপতন হবে, নিরামিষ খাদ্যে এসেনশ্যাল আমিনো-অ্যাসিডের অভাব আছে।
অঘোর। খাদ্যবিজ্ঞানী আর রসায়নী হয়তো সে অভাব পূরণ করতে পারবেন। সয়াবীন, চীনাবাদাম, তিল, ঈস্ট, খুদে পানা ইত্যাদি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চলছে।
মথুর। তা হলে এখন করা যায় কি?
অঘোর। দেখ মথুর, প্রবৃত্তিই বলবতী। যাতে তোমার রুচি হয়, যা তোমার পেটে সয়, তাই খাবে। ভবিষ্যতে হয়তো মাছ মাংসের অনুকল্প উপাদেয় সুষম নিরামিষ খাদ্য আবিষ্কৃত হবে, কিন্তু তা তোমার আমার ভোগে লাগবে না। মল্লিক মশায়ের বয়স কম, উনি হয়তো চেখে দেখবার সুযোগ পাবেন। এখন ওঠা যাক, অনেক বেলা হয়েছে।
[* প্রায় কোনও প্রচ্ছন্নতা না রেখে নিজেকে এতটা project বোধহয় আর কখনও করেন নি। বয়স আটাত্তর, ৬০/৬৫ বৎসর অর্থাৎ ১২/১৩ বৎসর বয়স থেকে নিরামিষাশী ও সব বিষয় চরম বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর rational মতবাদ। ফোটোগ্রাফ না হলেও অঘোর দত্ত নিখুঁত আত্মপ্রতিকৃতি। আর হয়তো ছেলেবেলায় এমন কিছু পড়েছিলাম…–আমার শৈশবে একবার বলেছিলেন–রাজর্ষি; ওটাও আমার নিরামিষ খাওয়ার একটা কারণ। আবার–মোটেই ভেজিটেরিয়ন নই, রোজ খাঁটী গোরস খাচ্ছি–এও বলেছেন। স:।]
গল্পের বাজার
গল্পের বাজার (১৮৭৯/১৯৫৭)
অন্য জন্তুর সঙ্গে মানুষের অনেক তফাত আছে। আমরা খাড়া হয়ে হাঁটি, আঙুল দিয়ে কলম ধরি, দাড়ি কামাই, নেশা করি। নেশা মানে শুধু মদ গাঁজা আফিম নয়, পান তামাক চা-ও নয়, জীবনধারণের জন্য যা অনাবশ্যক অথচ অভ্যাস করলে যাতে সহজেই প্রবল আসক্তি আসে, তারই নাম নেশা। ব্যসন শব্দেরও এই অর্থ। মৃগয়া দূত দিবানিদ্রা পরনিন্দা নৃত্য গীত ক্রীড়া বৃথাভ্রমণ বেশ্যা মদ, এই দশটি শাস্ত্রোক্ত কামজ ব্যসন। সদর্থেও ব্যসন শব্দের প্রয়োগ আছে। মহাত্মাদের একটি লক্ষণ বলা হয়েছে–ব্যসনং শুতৌ, অর্থাৎ বেদবিদ্যায় আসক্তি। শখ আসক্তি ব্যসন আর নেশা, নির্দোষ বা সদোষ যাই হক, মোটামুটি একই শ্রেণীতে পড়ে।
আগের তুলনায় এখন আমাদের নেশার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সেকালের তরজা, কবিগান, মেড়ার লড়াই, বাচখেলা, বাইনাচ ইত্যাদির চাইতে এখনকার রেডিও সিনেমা থিয়েটার জলসা ফুটবল-ক্রিকেট ম্যাচ ইত্যাদির বৈচিত্র্য আর আকর্ষণ বেশী। এ সবের চাইতেও ব্যাপক নেশার জিনিস গল্পের বই। আজকাল সাহিত্য বললে অধিকাংশ লোক কথাসাহিত্যই বোঝে। অনেক লোক আছে যারা কোনও রকম নেশা না করে অর্থাৎ পান তামাক সিগারেট চা পর্যন্ত না খেয়ে স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করে। তেমনি এমন লোকও আছে যাদের গল্প পড়বার আগ্রহ কিছুমাত্র নেই। তবু বলা যেতে পারে, শিক্ষিত আর অল্পশিক্ষিত আবালবৃদ্ধবনিতা অসংখ্য লোকে গল্পের বই পড়ে এবং অনেকের পক্ষে তা প্রবল আসক্তি বা নেশার বস্তু।
বঙ্কিমচন্দ্র লেখকদের উপদেশ দিয়েছেন–টাকার জন্য লিখিবে না। কিন্তু ছাপাখানার মালিককে তিনি বলেন নি টাকার জন্য ছাপিবে না। তার আমলে লেখক আর পাঠক দুইই কম ছিল, সুতরাং লেখককে নিঃস্বার্থ জনশিক্ষক মনে করা চলত। কিন্তু একালে চা আর সিগারেটের মতন গল্পের বই অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে, পাঠকরাও দাম দিতে প্রস্তুত, সুতরাং মুদ্রাকর দপ্তরী আর প্রকাশকের দাবি মেনে নিয়ে শুধু লেখককে বঞ্চিত করার কারণ নেই। জনসাধারণের গল্পপ্রীতি বেড়ে যাওয়ার ফলে বাঙালী একটি সম্মানিত নূতন জীবিকার সন্ধান পেয়েছে। গল্পকার শুধু লেখক নন, কবি আর চিত্রকরের তুল্য কলাবিৎ, ইন্দ্রজালিকের সঙ্গেও তার সাদৃশ্য আছে। কাল্পনিক ঘটনার বিবৃতির দ্বারা তিনি পাঠককে সম্মোহিত ও রসাবিষ্ট করেন। গল্পগ্রন্থের আদর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থের চাইতে ঢের বেশী, টেক্সটবুকের নীচেই তার কাটতি।
ষাট-সত্তর বৎসর আগে যখন বাঙলা গল্পের খুব অভাব ছিল, তখন লোকে অবসরকালে কি পড়ত, তাদের রুচি কিরকম ছিল, এই সব খবর আধুনিক লেখক আর পাঠকদের অনেকেই জানেন না। বাঙলা বা ইংরেজী গল্পগ্রন্থের জ্ঞান আমার অতি অল্প, সেকালের সাহিত্যসেবীদের সঙ্গেও আমার যোগ ছিল না। তথাপি তখনকার পাঠকদের অবস্থা সম্বন্ধে আমার যতটুকু জানা আছে তা বলছি।
তখন গল্পখোর বাঙালীর প্রধান সম্বল ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের এগারোটি উপন্যাস, রমেশচন্দ্রের ছটি, তারকনাথের স্বর্ণলতা, স্বর্ণকুমারী দেবীর কয়েকটি গল্প, রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি আর বউঠাকুরাণীর হাট, এবং আরব্য উপন্যাস। আরও কতকগুলি ভাল মাঝারি মন্দ গল্পের বই প্রচলিত ছিল, কিন্তু তার অধিকাংশই এখন লোপ পেয়েছে, নাম পর্যন্ত লোকে ভুলে গেছে। রবীন্দ্রনাথ তখন সবে ছোটগল্প লিখতে আরম্ভ করেছেন, কিন্তু অল্প পাঠকই তার খবর রাখত। শরৎচন্দ্র আর প্রভাতকুমার তখনও কলম ধরেন নি। সেই গল্পাল্পতার যুগে পাঠকের স্পৃহা কি করে মিটত? তখন কৃত্তিবাস কাশীরাম আর ভারতচন্দ্রের রচনা লোকে সাগ্রহে পড়ত, দীনবন্ধু, গিরিশচন্দ্র আর রাজকৃষ্ণ রায়ের নাটক খুব জনপ্রিয় ছিল, মধুসূদন হেমচন্দ্ৰ নবীনচন্দ্র এবং অনেক নিকৃষ্ট কবির রচনাও লোকে পড়ত, কিন্তু রবীন্দ্রকাব্য বহুপ্রচারিত হয় নি, সাধারণ পাঠকের পক্ষে তা একটু দুরূহ ছিল। এখনকার মতন তখনও অধিকাংশ পাঠক কবিতার চাইতে গল্পেরই বেশী ভক্ত ছিল, কিন্তু যথেষ্ট গল্পের বই না থাকায় কবিতার পাঠক এখনকার তুলনায় সেকালে বেশী ছিল।