- বইয়ের নামঃ উত্তর-চলচ্চিন্তা
- লেখকের নামঃ রাজশেখর বসু
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অশ্লীল ও অনিষ্টকর
অশ্লীল ও অনিষ্টকর (১৮৮০/১৯৫৮)
আমরা সিনেমার কবলে পড়েছি। শহরের দেওয়াল অভিনেত্রীদের ছবিতে ছেয়ে গেছে, সমস্ত খবরের কাগজে সিনেমার বড় বড় বিজ্ঞাপন আর বিবরণ ছাপা হচ্ছে। মোটা মোটা মাসিক পত্রিকায় বিখ্যাত লেখকদের গল্পের ফাঁকে ফাঁকে সিনেমা-সুন্দরীদের ছবি গিজগিজ করছে। পূজার মণ্ডপে হিন্দী ফিল্ম সংগীত নিনাদিত হচ্ছে। তারকাদের লীলাভূমি বোম্বাই এখন সিনেমাক্রান্ত ছেলেমেয়ের মক্কা-বারাণসী।,
সম্প্রতি আমাদের হুঁশ হয়েছে সিনেমা শুধু চিত্ত-বিনোদন করে না, অনেক ক্ষেত্রে চিত্তবিক্ষোভও করে। আপত্তিজনক ছবি আর বিজ্ঞাপন নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। পুলিসের কর্তারা নাকি বলেছেন তাদের হাত-পা বাঁধা, সেনসর বোর্ড যা পাস করেন তার উপর কথা চলে না। শুধু এদেশে নয়, বিলাতেও অশ্লীল ছবির বিরুদ্ধে আপত্তি উঠেছে। গত নভেম্বরের World Digest পত্রিকায় Sidney Moseleyর একটি প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে–
By film, by television, by picture in the Press, we stir sexual emotions which are already astir in the normal human being. Do you wonder then, that some men, unable to resist the effect of the glamorous presentations of sex which are continually thrust before them, go berserk and that all sorts of tragedies result? When you tempt men with drink or doxies the result is inevitable.
এর চাইতে কড়া সমালোচনা বোধ হয় এদেশে কেউ করেন নি। পাশ্চাত্ত্য দেশে কি রকম ছবি দেখানো হয় বা বিজ্ঞাপিত হয় তা ঠিক জানি না, তবে তার যেসব পোস্টার এখানে দেখা যায়, তা থেকে অনুমান করতে পারি যে ভারতীয় ছবির তুলনায় তা ঢের বেশী প্রগতিশীল। এদেশের লোকমত এখনও পাশ্চাত্তের মতন উদার আর নির্লজ্জ হয় নি। আমাদের আদর্শ কি হওয়া উচিত তাও স্থির করা সহজ নয়, কারণ অশ্লীলতার কোনও বহুসম্মত মানদণ্ড নেই। লোকমত কালে কালে বদলায়, দেশে দেশেও বিভিন্ন। স্ত্রী পুরুষ অল্পবয়স্ক আর পূর্ণবয়স্কের পক্ষে কি অবদ্য বা অনবদ্য তারও বিচার এক পদ্ধতিতে করা যায় না।
প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে কিছু অশ্লীলতা আছে। তার দোষ ক্ষালনের জন্য Horace Heyman Wilson বহুকাল পূর্বে লিখেছেন
These men wrote for men only; they never think of a woman as a reader. What is natural, cannot be vicious; what everyone knows, surely everyone may express; and that mind which is only safe in ignorance or which is only defended by decorum, possesses but a very feeble and impotent security.
অর্থাৎ যে বিষয়ের আলোচনা নারীর পক্ষে অশোভন, তা পুরুষের পক্ষে বিহিত হতে পারে। যা স্বাভাবিক, তা মন্দ হতে পারে না। যা সকলেই জানে, তা সকলেই প্রকাশ করতে পারে। যে মনকে অজ্ঞতা দিয়ে ঢেকে রাখতে হয়, সে মন অত্যন্ত দুর্বল, তার আত্মরক্ষার শক্তি নেই।
ভক্ত বৈষ্ণবের দৃষ্টিতে গীতগোবিন্দ উপাদেয় গ্রন্থ, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতি অনেক মনীষী তার বিলাস বর্ণনায় কুরুচি পেয়েছেন। ভারতচন্দ্রের রচনায় এবং প্রাচীন বাঙলা কাব্যে যে আদিরস আছে, তা আধুনিক শিক্ষিত পাঠকের দৃষ্টিতে অশ্লীল, কিন্তু সেকালে কেউ তার দোষ ধরত না। পাঁচালি তরজা কবির লড়াই প্রভৃতির অশ্লীলতা ইতর ভদ্র সকলে উপভোগ করত। প্রাচীন পাশ্চাত্ত্য লেখকদের অনেকে নিরঙ্কুশ ছিলেন। শেক্সপীয়রের Venus and Adonisএর তুলনায় কালিদাস জয়দেব ভারতচন্দ্র প্রভৃতির আদিরসাত্মক রচনা যেন শিশুপাঠ্য। Don Quixote গ্রন্থে একটি সরাইএর বর্ণনায় যে কুৎসিত বীভৎসতা আছে তা প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থে পাওয়া যায় না।
বিলাতে ভিক্টোরীয় যুগের ভদ্ৰশ্রেণী কিছু prude বা শুচিবায়ুগ্রস্ত ছিলেন, সাহিত্যে আর প্রকাশ্য সামাজিক আচরণে তার প্রভাব পড়েছিল। ইংরেজের শিষ্য বাঙালী লেখকেরা সেই ভিক্টোরীয় শুচিতা আদর্শরূপে মেনে নিয়েছিলেন। আধুনিক ইংরেজী সাহিত্য থেকে লজ্জা প্রায় অন্তর্হিত হয়েছে, বাঙলা সাহিত্যও কিছু অসংবৃত হয়েছে, কিন্তু ইংরেজীর তুলনায় পিছিয়ে আছে। খ্যাতনামা জনপ্রিয় ইংরেজ লেখকদের রচিত লোকসাহিত্যে এমন বর্ণনা দেখা যায়, যা আধুনিক বাঙলা গ্রন্থে থাকলে লেখক আর প্রকাশককে আদালতে দণ্ড পেতে হবে।
উপরে উইলসনের যে অভিমত দিয়েছি তা যুক্তিসম্মত হলেও সকল সমাজে গ্রহণীয় হবার সম্ভাবনা নেই। অশ্লীলতার মোটামুটি লক্ষণ–যা কামের উদ্দীপক অথবা উদ্দীপক না হলেও যা প্রচলিত রুচিতে কুৎসিত বা অশালীন গণ্য হয়। সামাজিক প্রথার সঙ্গে শালীনতার নিবিড় সম্বন্ধ আছে। ভিক্টোরীয় যুগে ভদ্র নারীর decollete সজ্জা (অর্ধমুক্ত বক্ষ) ফ্যাশনসম্মত ছিল (এখনও আছে) কিন্তু অনাবৃত ankle বা পায়ের গোছ, অশ্লীল গণ্য হত এবং পুরুষের লুব্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করত। এখন ankle প্রদর্শন রুচিসম্মত হয়েছে, পুরুষের লোভও প্রায় লোপ পেয়েছে। আমাদের দেশে নারীচরণের নিম্নভাগ কোনও কালেই কামোদ্দীপক গণ্য হয় নি। প্রাচীন ভারতীয় কবিরা পুরুষের দেহসৌষ্ঠব বর্ণনায় যেমন ব্যুঢ়োরস্ক বৃষস্কন্ধ শালপ্রাংশু মহাভুজ লিখেছেন তেমনি সুন্দরীর রূপ বর্ণনায় পীনপয়োধরা ক্ষীণমধ্যা নিবিড়নিতম্ব করভোরু প্রভৃতি বিশেষণ দিয়েছেন। দেবীস্তোত্রেও এই সব লক্ষণ বর্জিত হয় নি। What is natural cannot be vicious-Wilsonএর সিদ্ধান্ত আমাদের প্রাচীন কবিরা বিলক্ষণ মানতেন। কিন্তু কালক্রমে এদেশে রুচির পরিবর্তন হয়েছে, নারীর রূপবর্ণনা এখন প্রাচীন রীতিতে করলে চলে না, একটু রেখে ঢেকে সংবৃতভাবে করতে হয়।
অনাত্মীয় পুরুষকে ভদ্র নারীর মুখ দেখানো নিরাপদ নয়, অর্থাৎ তা। অশ্লীল–এই ধারণা থেকে ঘোমটা বোরখা অবরোধ অসূর্যম্পশ্যতা ইত্যাদির উদ্ভব হয়েছে, কিন্তু তাতে অভীষ্ট ফল লাভ হয় নি। লোকে বহুকাল থেকে যা অনাবৃত দেখে তার সম্বন্ধে দুষ্ট বা morbid কৌতূহল হয় না, যা আবৃত তার প্রতিই আকৃষ্ট হয়। ৬০। ৭০ বৎসর আগে অতি অল্প বাঙালী মেয়ে স্কুল-কলেজে যেত। তাদের সম্বন্ধে অল্পবয়স্ক পুরুষদের দুষ্ট কৌতূহল ছিল। কিশোরী আর যুবতী নূতন ধরনে শাড়ি পরে জুতো পায়ে দিয়ে হাতে বই নিয়ে খুটখুট করে চলেছে–এই অভিনব দৃশ্যে অনেকের চিত্তবিকার হত, সেজন্য মেয়েদের পায়ে হেঁটে যাওয়া নিরাপদ গণ্য হত না। এখনকার পুরুষেরা পথচারিণীদের সহজভাবে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছে। কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ সর্বকালে সর্বদেশেই আছে, তাই মাঝে মাঝে মেয়েদের অপমান সইতে হয়। শিস, অশ্লীল গান বা ঠাট্টা, অঙ্গভঙ্গী ইত্যাদি ধর্ষণেরই অনুকল্প।
অনিষ্টকর না হলেও অনেক বিষয় শিষ্ট রুচির বিরোধী বা কুৎসিত গণ্য হতে পারে। ভাতার শব্দ ভর্তার অপভ্রংশ মাত্র, অর্থে গৌরব আছে, কামগন্ধ নেই। তথাপি শিষ্টজনের রুচিতে অশ্লীল। এই রকম অনেক শব্দ আছে, যার সংস্কৃত রূপ বা ডাক্তারী নাম শিষ্ট কিন্তু বাঙলা গ্রাম্য রূপ অশ্লীল গণ্য হয়। অনেক সময় অল্পবয়স্করা (এবং অনেক বৃদ্ধও) নিজেদের মধ্যে অশ্লীল আলাপ করে। বোধ হয় তাতে তারা নিষেধ লঙ্ঘনের আনন্দ পায়। যারা এরকম করে, তাদের দুশ্চরিত্র মনে করার কারণ নেই। মাতা ভগিনী কন্যা সম্পর্কিত কুৎসিত গালি যাদের মধ্যে চলিত আছে তারা অসভ্য হলেও দুবৃত্ত না হতে পারে। অশ্লীল বিষয়ের প্রভাবও সকলের উপর সমান নয়। এমন লোক আছে যারা সুন্দরী নারীর চিত্র বা প্রতিমূর্তি দেখলেই বিকারগ্রস্ত হয়। আবার এমন লোকও আছে যারা অত্যন্ত অশ্লীল দৃশ্য দেখে বা বর্ণনা শুনেও নির্বিকার থাকে।
সামাজিক সংস্কার অনুসারে অতি সামান্য ইতরবিশেষে শ্লীল বিষয়ও অশ্লীল হয়ে পড়ে। কোথায় পড়েছি মনে নেই–এক পাশ্চাত্ত্য চিত্রকর একটি নগ্ন স্ত্রীমূর্তির sketch এঁকে তার বন্ধুকে দেখান। বন্ধু বললেন, অতি অশ্লীল। চিত্রকর বললেন, তুমি কিছুই বোঝ না, অশ্লীল কাকে বলে এই দেখ। এই বলে চিত্রকর মূর্তির পায়ে জুতো এঁকে দিলেন। বন্ধু তখন স্বীকার করলেন, চিত্রটি আগে নির্দোষ ছিল, এখন বাস্তবিকই অশ্লীল হয়েছে।
অনিষ্টকর না হলেও অনেক বিষয় কেন কুৎসিত গণ্য হয় তার ব্যাখ্যান নৃবিজ্ঞানী (anthropologist) আর মনোবিজ্ঞানীরা করবেন। আমাদের শুধু মেনে নিতে হবে যে নানারকম taboo সব সমাজেই আছে এবং তা লঙ্ঘন করা কঠিন, যদিও কালক্রমে তার রূপান্তর হয়। রবীন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনে মেয়েদের অভিনয় আর নাচের প্রবর্তন করেন তখন তাকে বিস্তর গঞ্জনা সইতে হয়েছিল। সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে রুচি আর শালীনতার ধারণাও বদলায়। ২৫। ৩০ বৎসর আগে কেউ ভাবতেও পারত না যে উচ্চশ্রেণীর বাঙালী কুলললনা বক্ষ আর পৃষ্ঠ অর্ধমুক্ত আর কক্ষ প্রকটিত করে পরপুরুষের বাহুলগ্না হয়ে বল নাচে মেতেছে। ভদ্র পুরুষের নটবৃত্তিতে আমরা বহুকাল থেকে অভ্যস্ত। কিন্তু ভদ্র নারী সিনেমায় নেমে বহুজনপ্রিয়া রূপবিলাসিনী হবে এবং প্রচুর প্রতিপত্তি পাবে–এও ২৫/৩০ বৎসর আগে কল্পনাতীত ছিল। অচির ভবিষ্যতে বাঙালীর হোটেলে বা রেস্তোরাঁতে হয়তো cabaretএর ব্যবস্থা হবে এবং তাতে মেয়েরা নাচবে।
প্রায় দু শ বৎসরের ব্রিটিশ রাজত্বে আমাদের সমাজে ধীরে ধীরে বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে। স্বাধীনতা লাভের পর যেন পরিবর্তনের প্লাবন এসেছে, দেশের লোক অত্যন্ত আগ্রহে বিলাতী আচার-ব্যবহারের অনুকরণ করছে। ভবিষ্যৎ বাঙালী তথা ভারতীয় সমাজ পাশ্চাত্ত্য সমাজের নকলেই গড়ে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের প্রগতিতে অর্থাৎ সাহেবীভবনে যে বিলম্ব হচ্ছে, তার প্রধান কারণ দারিদ্র, প্রাচীন সংস্কার নয়। যারা ধনী তাদের অনেকে বহুদিন পূর্বেই ইঙ্গবঙ্গ সমাজ স্থাপন করেছেন। জাপানে যা হয়েছে ভারতেও তা না হবে কেন? পাশ্চাত্ত্য বীর্য উদ্যম কর্মনিষ্ঠা প্রভৃতি সদ্গুণ না পেলেও ক্ষতি নেই, পাশ্চাত্ত্য রীতি নীতি ফ্যাশন ব্যসন যথাসাধ্য আত্মসাৎ করতেই হবে, তাই আমাদের পরম পুরুষার্থ।
মহা বাধা আমাদের দারিদ্র। টাকার জোরে এবং শখের প্রাবল্যে অল্প কয়েকজন ভাগ্যবান শীঘ্রই পূর্ণমাত্রায় সাহেব হয়ে যেতে পারবে, কিন্তু মধ্যবিত্ত আর অল্পবিত্ত সকলকেই লোভের মাত্রা কমিয়ে নিজের সামর্থ্যের উপযোগী আধা বা সিকি-সাহেবী সমাজে তুষ্ট হতে হবে। আমাদের রুচি আর শালীনতাও এই মধ্যাল্পবিত্ত সমাজের বশে নিরূপিত হবে।
এদেশের যাঁরা নিয়ন্তা, অর্থাৎ বিধানসভা ইত্যাদির সদস্য, তাদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত বা অল্পবিত্ত। অশ্লীলতা দমন এঁদেরই হাতে। এঁদের দৃষ্টিভঙ্গী পূর্ণমাত্রায় পাশ্চাত্ত্যভাবাপন্ন নয়, ইওরোপ আমেরিকার রুচি এঁরা অন্ধভাবে মেনে নিতে পারবেন না। অতএব আশা করা যেতে পারে, অধিকাংশ শিক্ষিত ভারতবাসীর রুচি অনুসারেই এঁরা শ্লীলতা বা অশ্লীলতা, নিরাপত্তা বা অনিষ্টকারিতা বিচার করবেন এবং তদনুসারে সিনেমার ছবি আর বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রিত করবেন।
কোনও সাহিত্যিকের রচনা ভাল কি মন্দ তার বিচার সমালোচকরা ধীরে সুস্থে করেন। তাঁদের মানদণ্ড অনির্দেশ্য, সকলে তা প্রয়োগ করতে পারে না। যদি বিদগ্ধতার খ্যাতি থাকে তবে পাঠক-সাধারণ তাদের অভিমতই মেনে নেয়। মত প্রকাশে দেরি হলেও ক্ষতি হয় না। কিন্তু সিনেমা-ছবির নির্বাচন অবিলম্বে করতে হয়, সেনসর-বোর্ড বেশী সময় নিতে পারেন না। তারা কিরকম মানদণ্ড অনুসারে শ্লীলতা-অশ্লীলতা বিচার করবেন?
সেনসর-বোর্ডের সদস্যদের রুচি যদি মোটামুটি একরকম হয় তবে বিচার কঠিন হবে মনে করি না। তাদের অতিমাত্রায় উদার না হওয়াই উচিত। যদি তারা মনে করেন, কোনও ছবি দেখে এক শ দর্শকের মধ্যে দশজনের চিত্তবিকার হতে পারে তবে সে ছবি মঞ্জুর করবেন না। মনোবিজ্ঞানীরা যাকে psychosomatic effect বলেন, অর্থাৎ মানসিক উত্তেজনার ফলে দৈহিক বিকার (পূর্বে উদ্ধৃত Sydney Moseleyর উক্তিতে তারই ইঙ্গিত আছে)–তার সম্ভাবনা থাকলে সে ছবি অবশ্যই বর্জন করবেন। বিদেশে সে ছবি দেখানো হয় কিনা, ভারতের অন্য প্রদেশের সেনসর-বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে কিনা–তা ভাববার দরকার নেই। যা তাদের নিজের বিচারে অবাঞ্ছিত, এখানকার সেনসর-বোর্ড তা অবশ্যই নিষিদ্ধ করবেন।
সম্প্রতি শ্ৰীযুক্ত চপলাকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন, পরিবারের সকলে যে ছবি একসঙ্গে দেখতে পারে শুধু সেই ছবিই মঞ্জুর করা উচিত, প্রাপ্তবয়স্ক আর অল্পবয়স্কর জন্য ভেদ রাখা অন্যায়। এই প্রস্তাব অতি সমীচীন। কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য–এই কথা বিজ্ঞাপনে লিখলেই অল্পবয়স্কদের লোভ বাড়ানো হয়।
আর্টের অসংখ্য উপাদানের মধ্যে কিঞ্চিৎ কামকলার প্রয়োজন থাকতে পারে। সিনেমা আর সাহিত্যে তার প্রয়োগ যদি সংযত করা হয় তবে আর্ট আর সংস্কৃতি চর্চার কিছুমাত্র ক্ষতি হবে না।
[এই প্রবন্ধের সাত বৎসর আগে (১৯৫১) একই কথা লিখেছেন পরশুরাম-রামধনের বৈরাগ্য গল্পে। তাতে বোধহয় আধুনিক অশ্লীল বাঙলা সাহিত্যের ইন্ধন ছিল! –স:।]
ধর্মশিক্ষা
ধর্মশিক্ষা (১৮৮১/১৯৫৯)
আমাদের দেশে সব রকম দুষ্কর্ম আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। চুরি ডাকাতি প্রতারণা ঘুষ ভেজাল ইত্যাদি দেশব্যাপী হয়েছে, অনেক রাজপুরুষ আর ধুরন্ধর ব্যবসায়ীর কর্মে অসাধুতা প্রকট হয়েছে, জননেতাদের আচরণেও অসংযম আর গুণ্ডামি দেখা দিয়েছে, ছেলেরা উদ্ধৃঙ্খল দুর্বিনীত হয়েছে। অনেক সরকারী অফিসে কাজ আদায়ের জন্য চিরকালই আমলাদের ঘুষ দিতে হত। এখন তাদের জুলুম বেড়ে গেছে, উপরওয়ালাদের বললেও কিছু হয় না, তারা নিম্নতনদের শাসন করতে ভয় পান।
প্রাচীন ভারতে চোরের হাত কেটে ফেলা হত। বিলাতে দেড় শ বৎসর আগে সামান্য চুরির জন্যও ফাঁসি হত। রাজা রতন রাও কুলনারীহরণের জন্যে নিজের পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এই রকম কঠোর শাস্তির ভয়ে দুর্বত্তরা কতকটা সংযত থাকত, কিন্তু একেবারে নিরস্ত হত না।
সমাজরক্ষার জন্য যথোচিত দণ্ডবিধি অবশ্যই চাই, কিন্তু তার চাইতেও চাই এমন শিক্ষা আর পরিবেশ যাতে দুষ্কর্মে প্রবৃত্তি না হয়। অনেকে বলেন, বাল্যকাল থেকে ধর্মশিক্ষাই দুষ্পবৃত্তির শ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক। রিলিজস এডুকেশনের জন্য বিলাতে আইন আছে, সকল খ্রীষ্টান ছাত্রকেই বাইবেল পড়তে হয় এবং তৎসম্মত ধর্মোপদেশ শুনতে হয়। বিভিন্ন শ্রেণীর নিষ্ঠাবান খ্রীষ্টান মাত্রেই এই শিক্ষা অত্যাবশ্যক মনে করেন। কিন্তু যুক্তিবাদী র্যাশনালিস্টরা (যাঁদের মধ্যে অনেক খ্যাতনামা মনীষী আছেন) বলেন খ্রীষ্টীয় বা অন্য কোনও ধর্মের ভিত্তিতে মরালিটি বা সামাজিক কর্তব্য শেখানো শুধু অনাবশ্যক নয়, ক্ষতিকরও বটে, তাতে বুদ্ধি সংকীর্ণ হয়।
বাল্যকাল থেকে সুনীতি আর সদাচার শিক্ষা কর্তব্য, এ সম্বন্ধে মতভেদ নেই। কিন্তু সেকিউলার বা লোকায়ত ভারত-রাষ্ট্রের প্রজার জন্যে এই শিক্ষার ভিত্তি কি হবে? শিক্ষার্থীর সম্প্রদায় অনুসারে হিন্দু জৈন শিখ মুসলমান খ্রীষ্টান প্রভৃতির ধর্মশাস্ত্র, অথবা শাস্ত্রনিরপেক্ষ শুধুই নীতিবাক্য?
রিলিজন শব্দের বাঙলা প্রতিশব্দ নেই। ক্ৰীড বা নির্দিষ্ট বিষয়ে আস্থা না থাকলে রিলিজন হয় না। হিন্দুধর্ম ঠিক রিলিজন নয়, কারণ তার বাঁধাধরা ক্রীড নেই। কিন্তু যেমন মুসলমান আর খ্রীষ্টীয় ধর্ম, তেমনি জৈন শিখ বৈষ্ণব আর ব্রাহ্ম ধর্মও রিলিজন। ভারতীয় ছাত্র যদি মুসলমান খ্রীষ্টান জৈন শিখ বৈষ্ণব ব্রাহ্ম ইত্যাদি হয় তবে তার সাম্প্রদায়িক ক্ৰীড অনুসারে তাকে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সাধারণ হিন্দু ছাত্রকে কিংবা মিশ্র সম্প্রদায়ের বিদ্যালয়ে কি শেখানো হবে? শুধু অল্পবয়স্কদের জন্যে ব্যবস্থা করলে চলবে না, প্রাপ্তবয়স্করাও যাতে কুকর্মপ্রবণ না হয় তার উপায় ভাবতে হবে।
ধর্ম শব্দের শাস্ত্রীয় অর্থ অতি ব্যাপক–যা প্রজাগণকে ধারণ করে। অর্থাৎ সমাজহিতকর বিধিসমূহই ধর্ম, যাতে জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হয় তাই ধর্ম। ইংরেজীতে gentlemanএর একটি বিশিষ্ট অর্থ–chivalrous wellbred man। জেন্টলম্যান বা সজ্জনের যে লক্ষণাবলী, তা যদি বহুগুণ প্রসারিত করা হয় তবে তাকে ধর্ম বলা যেতে পারে। শুধু ভদ্র আচরণ, মার্জিত আলাপ, সত্যপালন, দুর্বলকে রক্ষা করা ইত্যাদি ধর্ম নয়, শুধু ভক্তি বা পরমার্থতত্ত্বের চর্চাও ধর্ম নয়। স্বাস্থ্য বল বিদ্যা উপার্জন সদাচার সুনীতি বিনয় (discipline) ইন্দ্রিয়সংযম আত্মরক্ষা দেশরক্ষা পরোপকার প্রভৃতিও ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গ। বঙ্কিমচন্দ্র তার ধর্মতত্ত্ব গ্রন্থে যে গুণাবলীর অনুশীলন ও সামঞ্জস্য বিবৃত করেছেন তাই ধর্ম। মানুষের সাধনীয় ধর্মের এমন সর্বাঙ্গীণ আলোচনা আর কেউ বোধ হয় করেন নি।
ভারতীয় বিদ্যার্থী সেকালে গুরুগৃহে যে শিক্ষা পেত তাকে তখনকার হিসাবে সর্বাঙ্গীণ বলা যেতে পারে। বিবিধ বিদ্যা আর শাস্ত্রবিহিত অনুষ্ঠান বা ritualএর সঙ্গে সদাচার আর সামাজিক কর্তব্যও শিক্ষণীয় ছিল। এখন গুরুগৃহের স্থানে স্কুল-কলেজ হয়েছে, শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তায় আস্থা ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। এখনকার বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা অত্যল্প, ধর্ম বা সামাজিক কর্তব্য শেখাবার তাঁদের সময় নেই, যোগ্যতাও নেই।
ধর্মশিক্ষার জন্য কেউ কেউ মুষ্টিযোগের ব্যবস্থা করে থাকেন। ছেলেরা নিয়মিত গায়ত্রী জপ, সন্ধ্যা-আহ্নিক, স্তোত্রপাঠ, গীতা-অধ্যয়ন ইত্যাদি করুক। মেয়েরা মহাকালী পাঠশালার অনুকরণে নানা রকম ব্রতপালন আর শিবপূজা করুক। ছাত্রছাত্রীদের রামায়ণ মহাভারত পুরাণাদি শোনাবার ব্যবস্থা হক। সর্বশক্তিমান পরমকারুণিক ঈশ্বরে বিশ্বাস আর ভক্তি যাতে হয় তার চেষ্টা করা হক।
পাশ্চাত্ত্য দেশেও দুক্কিয়া বেড়ে গেছে। অনেকে বলেন, স্বর্গ-নরকে সাধারণের আস্থা কমে যাওয়াই নৈতিক অবনতির কারণ। Pie in the sky আর hell fire, অর্থাৎ পরলোকে গিয়ে পুণ্যবান স্বর্গীয় পিষ্টক খাবে আর পাপী নরকাগ্নিতে দগ্ধ হবে, এই বিশ্বাস লোপ পাচ্ছে। কলকাতার রাস্তায় খ্রষ্টীয় বিজ্ঞাপন দেখা যায়–Jesus Christ can save to the uttermost! ফ্রেমে বাঁধানো অনুরূপ আশ্বাসবাক্য দেশী ছবির দোকানে পাওয়া যায়–একমাত্র হরিনামে যত পাপ তরে, পাপিষ্ঠের সাধ্য নাই তত পাপ করে। কিন্তু এই সব বাণীতে কোনও ফল হয় না, কারণ জনসাধারণ ইহসর্বস্ব হয়ে পড়েছে।
দৃষ্ক্রিয়া বৃদ্ধির নানা কারণ থাকতে পারে। বোধ হয় একটি প্রধান কারণ, জুয়াড়ী প্রবৃত্তি বা gambling spiritএর প্রসার। লোকে দেখছে, দুষ্কর্মাদের অনেকেই ধরা পড়ে না, যারা ধরা পড়ে তাদেরও অনেকে শাস্তি পায় না। অতএব দুষ্কর্ম করে নিরাপদে লাভবান হবার প্রচুর সম্ভাবনা আছে। এক শ জন দুষ্কর্মার মধ্যে যদি পঁচাত্তর জন সাজা না পায় তবে সেই পঁচাত্তরের মধ্যে আমারও স্থান হতে পারে, অতএব আইনের ভয়ে পিছিয়ে থাকব কেন? ঝুঁকি না নিলে কোনও ব্যবসাতে লাভ হয় না, দুষ্কিয়াও একটা বড় ব্যবসা। লোকনিন্দা গ্রাহ্য করবার দরকার নেই, আমি যদি ধনবান হই তবে আমার দুষ্কর্ম জানলেও লোকে আমাকে খাতির করবে।
বহুকালের সংস্কার সহজে মুছে যায় না, স্বর্গ নরকে বিশ্বাস কমে গেলেও পাপের জন্যে একটা প্রচ্ছন্ন অস্বস্তিবোধ অনেকের আছে এবং তা থেকে মুক্তি পাবার আশায় তারা সুসাধ্য উপায় খোঁজে। বিস্তর লোক মনে করে, গঙ্গাস্নান, একাদশী পালন, দেববিগ্রহ দর্শন, গো-ব্রাহ্মণের কিঞ্চিৎ সেবা, মাঝে মাঝে তীর্থভ্রমণ ইত্যাদি কর্মেই পাপস্খলন হয়। হরিনাম-কীর্তনে বা খ্রীষ্ট-শরণে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, এই উক্তির সঙ্গে উহ্য আছে–আগে অনুতপ্ত হয়ে পাপকর্ম ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু লোকে কুকর্মের অভ্যাস ছাড়তে পারে না, মনে করে ভগবানের নাম নিলেই নিত্যনৈমিত্তিক সমস্ত পাপ ক্ষয় হবে। লোভী ডায়াবিটিক যেমন মিষ্টান্ন খায় আর ইনসুলিন নেয়।
আইনের ফেসাদে পড়লে লোকে যেমন উকিল মোক্তার বাহাল করে, তেমনি অনেকে পাপস্খলনের জন্য গুরুর শরণ নেয়। সেকেলে মন্ত্রদাতা গুরুর প্রতিপত্তি এখন কমে গেছে, আধুনিক জনপ্রিয় সাধু-মহাত্মারা গুরুর স্থান নিয়েছেন। তারা একসঙ্গে বিপুল ভক্তজনতাকে উপদেশ দেন, যেমন গৌতম বুদ্ধ দিতেন এবং একালের রাজনীতিক নেতারা দেন। অনেকে মনে করে, আমার মাথা ঘামাবার দরকার কি, গুরুকে যদি ভক্তি করি আর ঘন ঘন তাঁর কাছে যাই তা হলে তিনিই আমাকে রক্ষা করবেন। আমাদের দেশে– সাধুসন্তের আবির্ভাব চিরদিনই হয়েছে, জনসাধারণের কাছে তারা ভক্তি শ্রদ্ধাও প্রচুর পেয়েছেন। কিন্তু এখনকার জনপ্রিয় গুরু-গুর্বীর সন্নিধানে যে বিপুল ভক্তসমাগম হয় তা বোধ হয় বুদ্ধ আর চৈতন্যদেবের কালেও দেখা যায় নি। শ্রীরামকৃষ্ণ আর শ্রীঅরবিন্দেরও এমন ভক্তভাগ্য হয় নি।
একদিকে গুরুভক্তির তুমুল অভিব্যক্তি, অন্যদিকে দুষ্কর্মের দেশব্যাপী প্লাবন, এই দুইএর মধ্যে কার্যকারণসম্বন্ধ আছে কি? একথা বলা যায় না যে গুরুভক্তি বেড়ে যাওয়ার ফলেই দুষ্কর্মের প্রবৃত্তি বেড়ে গেছে, কিংবা গুরুরা জাল ফেলে চুনোপুঁটি রুই কাতলা সংগ্রহ করছেন। সাধুসঙ্গকামী ধার্মিক সজ্জন এখনও অনেক আছেন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এমন হতে পারে যে দুষ্কর্ম বৃদ্ধির ফলেই সাধু মহাত্মা গুরুর চাহিদা বেড়ে গেছে, বিনা আয়াসে পাপমুক্ত হবার মতলবে এখন অসংখ্য লোক গুরুর দ্বারস্থ হচ্ছে।
ভক্ত অথচ লম্পট মাতাল চোর ঘুষখোর ইত্যাদি দুশ্চরিত্র লোক অনেক আছে। তথাপি দেখা যায়, যারা স্বভাবত ভক্তিমান তারা প্রায় শান্ত সচ্চরিত্র হয়। কিন্তু স্বাভাবিক যোগ্যতা না থাকলে কোনও লোককে যেমন গণিতজ্ঞ বা সংগীতজ্ঞ করা যায় না, তেমনি কৃত্রিম উপায়ে অপাত্রকে ভক্তিমান করা যায় না। মামুলী নৈষ্ঠিক ক্রিয়াকর্ম করলে বা স্তোত্র আবৃত্তি করলে চিত্রের পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা অতি অল্প। পুরোহিত মন্ত্র পড়ান–অপবিত্র বা পবিত্র যেকোনও অবস্থায় যদি পুণ্ডরীকাক্ষকে স্মরণ করা হয় তবে বাহ্য আর অভ্যন্তর শুচি হয়ে যায়। কেবল নাম স্মরণেই যদি দেহশুদ্ধি আর চিত্তশুদ্ধি হত তবে লোকে অতি সহজে দিব্যজীবন লাভ করত। গোঁড়া আচারনিষ্ঠ স্ত্রীপুরুষও কত মন্দ হতে পারে তার অনেক চিত্র শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে পাওয়া যায়।
যে স্বভাবত সচ্চরিত্র বুদ্ধিমান আর জিজ্ঞাসু, সে নিজের রুচি অনুসারে ভক্তি কর্ম বা জ্ঞানের চর্চা করে। শুনেছি বিদ্যাসাগর প্রায় নাস্তিক ছিলেন, কিন্তু তার মতন কর্মবীর পরোপকারী সমাজহিতৈষী অল্পই জন্মেছেন। গান্ধীজী ভক্ত বিশ্বাসী, নেহেরুজী অভক্ত যুক্তিবাদী, কিন্তু দুজনেই অক্লান্তকর্মা লোকহিতৈষী সাধুপুরুষ।
মনুর বচন বলে খ্যাত একটি প্রাচীন শ্লোক আছে—
পরস্পরভয়াৎ কেচিং পাপাঃ পাপং ন কুর্বতে।
রাজদণ্ডভয়াৎ কেচিৎ যমদণ্ডভয়াৎ পরে ৷৷
সর্বেষামপি চৈতেষামাত্মা যময়তাং যমঃ।
আত্মা সংযমিতো যেন যমস্তস্য করোতি কি।
–কোনও কোনও পাপমতি পরস্পরের ভয়ে পাপকর্ম থেকে বিরত থাকে, কেউ রাজদণ্ডের ভয়ে, কেউ বা যমদণ্ডের ভয়ে। কিন্তু সকল শাসকের উপরে শাসন করে আত্মা বা অন্তঃকরণ। অন্তঃকরণ যে সংযমিত করেছে যম তার কি করবে?
মোট কথা, ধর্মশিক্ষার উদ্দেশ্য অন্তঃকরণের সংযমন বা বিনয়ন, disciplining the mind। এই বিনয়নের উপায় অন্বেষণ করতে হবে!
.
শোনা যায় কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার দ্বারা অবিনীত লোককে বিনীত করা হয়। প্রথমে হয় brain washing বা মস্তিষ্ক ধোলাই, অর্থাৎ লোকটির মনে যেসব কমিউনিস্ট-নীতিবিরুদ্ধ পূর্ব সংস্কার আছে তার উচ্ছেদ করা হয়, তার পর অবিরাম মন্ত্রণা দিয়ে এবং দরকার মতন পীড়ন করে নূতন সংস্কার বদ্ধমূল করা হয়। এই indoctrinationএর ফলে বহু নবাগত বিদেশী পূর্বের ধারণা ত্যাগ করে কমিউনিস্ট শাসনের আজ্ঞাবহ ভক্ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রের প্রজাদের শিশুকাল থেকেই শেখানো হয়–পিতা মাতা আত্মীয় স্বজন সকলের স্বার্থের চাইতে রাষ্ট্রের স্বার্থ বড়, রাষ্ট্রশাসকের বিধান শিরোধার্য করাই শ্রেষ্ঠ কর্তব্য ও শ্রেষ্ঠ ধর্ম, অন্য দেশে যে ডিমোক্রেসি আছে তা দুর্নীতিপূর্ণ ধাপ্পাবাজি মাত্র, প্রকৃত গণতন্ত্র কমিউনিস্ট রাষ্ট্রেই আছে, সেখানকার প্রজাই প্রকৃত স্বাধীনতা ভোগ করে। অবশ্য এমন লোক অনেক আছে যারা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের প্রজা না হয়েও স্বেচ্ছাক্রমে সেখানকার শাসনতন্ত্রের বশংবদ ভক্ত এবং তার কোনও দোষই মানতে চায় না।
এই রাষ্ট্রবিহিত একদেশদর্শী শিক্ষার ফলে কমিউনিস্ট প্রজার মানসিক পরিণতি কি হয়েছে তার আলোচনা অনাবশ্যক, অনেকে সে সম্বন্ধে বলেছেন। কিন্তু যেসব পর্যটক অপক্ষপাতে দেখেছেন তারা কমিউনিস্ট শাসনের শুধু দোষ আবিষ্কার করেন নি, অনেক সুফলও লক্ষ্য করেছেন। সম্প্রতি (২৪-১০-১৯৫৯) স্টেটসম্যান পত্রে প্রকাশিত একজন নিরপেক্ষ দর্শকের বিবরণ থেকে কিছু তুলে দিচ্ছি।
China today is free of all signs of robbery and corruption, and this is no mean achievement. … One does feel that we, in our country, could do with a little more honesty. There is an air of efficiency everywhere in the new China. …One does not have to worry about things like the purity of food, …or short measure or incorrect prices. These things are the result of strict controls. I miss these on my return to India. … The people have been made conscious of the need to keep their homes and the streets clean. …Is it fear that drives him or is it patriotism? The truth probably is, a bit of both. …The Communist party has used two methods : coercion and education.
ডিকটেটর-শাসিত রাষ্ট্রে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম সম্পাদিত হয়, সেখানকার প্রজা ভয়ে বা ভক্তিতে নিয়মনিষ্ঠ হয়ে চলে। গণতন্ত্রে ততটা আশা করা যায় না, কারণ, দুষ্ট দমনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সেখানকার শাসকদের নেই। যারা দুষ্ট আর দুষ্টের পোষক, তাদেরও ভোট আছে, সুতরাং তারা অসহায় নয়। গণতন্ত্রের আদর্শ–প্রজার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় বেশী হস্তক্ষেপ না করে এমন শিক্ষা পরিবেশ আর দণ্ডবিধির প্রবর্তন যাতে লোকে সুবিনীত কর্তব্যনিষ্ঠ হয়। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের অনুকরণ না করেও সেখান থেকে আমরা কিছু শিখতে পারি।
Indoctrinationএর একটি ভাল প্রতিশব্দ অধ্যাপক শ্রীযুক্ত চিন্তাহরণ চক্রবর্তীর কাছ থেকে পেয়েছি-কর্ণেজপন, চলিত কথায় যার নাম জপাননা বা ভজানো। শব্দটি মন্দ অর্থেই চলে, কিন্তু ভাল মন্দ মাঝারি সকল উদ্দেশ্যেই এই প্রক্রিয়ার প্রয়োগ হতে পারে। শিশুকে যখন শেখানো হয়– সত্য কথা বলবে, চুরি করবে না, ঝগড়া মারামারি করবে না, গুরুজনের কথা শুনবে ইত্যাদি, তখন শিশুর মঙ্গলের জন্যই তার কর্ণেজপন হয়। ভোটের দালালরা যখন নিরন্তর গর্জন করে–অমুককে ভোট দিন ভোট দিন, তখন পাড়ার লোকের কর্ণেজপন হয়। ধর্মঘটী আর রাজনীতিক শোভাযাত্রীর দল অবিরাম যে স্লোগান আওড়ায় তা সর্বসাধারণের কর্ণেজপনই, কিন্তু এই ধরনের স্থূল ঘোষণায় বিশেষ কিছু ফল হয় না, কর্ণেজপন হলেও তা প্রায় অরণ্যে রোদনের তুল্য।
ব্যবসায়ী যে বিজ্ঞাপন প্রচার করে তাও কর্ণেজপন। অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনে সত্য মিথ্যা আর অত্যুক্তির এমন নিপুণ মিশ্রণ থাকে যে বহু লোক মোহগ্রস্ত হয়।তেল ঘি খেয়ে স্বাস্থ্য নষ্ট করবেন না, অমুক বনস্পতি খান, পুষ্টির জন্য তা অপরিহার্য, আধুনিক সভ্য আর শিক্ষিত জনের রান্নাঘরে তা ছাড়া অন্য কিছু ঢুকতে পায় না। সম্প্রতি লোকসভায় একজন মন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে এরকম বিজ্ঞাপন আপত্তিজনক, কিন্তু এমন আইন নেই যাতে এই অপপ্রচার বন্ধ করা যায়।
বিনা টিকিটে রেলে ভ্রমণ, অকারণে শিকল টেনে গাড়ি থামানো, রেলকর্মচারীকে নির্যাতন, গাড়ির আসবাব চুরি ইত্যাদি নিবারণের জন্য সরকার বিস্তর বিজ্ঞাপন দিয়ে দেশবাসীকে আবেদন জানাচ্ছেন, কিন্তু কোনও ফল হচ্ছে না, কারণ, কুকর্ম নিবারণে শুধু কর্ণেজপন যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে শাস্তির অবশ্যম্ভাবিতা আর লোকমতের প্রবল সমর্থন আবশ্যক। ভেজাল ধরা পড়লে যে শাস্তি হয় তা অতি তুচ্ছ। অপরাধী ধনী হলে তার নাম প্রায় প্রকাশিত হয় না। একই নোক তেল-ঘিএ ভেজালের জন্য বহুবার জরিমানা দিয়েছে এবং স্বচ্ছন্দে সসম্মানে কারবার চালিয়ে যাচ্ছে এমন উদাহরণ বিরল নয়।
বিষ্ণুশর্মা বলেছেন, নব মৃৎপাত্রে যে সংস্কার লগ্ন হয় তার অন্যথা হয় না। বাল্যশিক্ষার অর্থ, লেখাপড়া শেখাবার সঙ্গে সঙ্গে বিবিধ হিতকর সংস্কার দৃঢ়বদ্ধ করা। এর প্রকৃষ্ট উপায় নির্ধারণের জন্য বিচক্ষণ মনোবিজ্ঞানীদের মত নেওয়া আবশ্যক। শিক্ষার সবটাই বুদ্ধিগ্রাহ্য নয়, চরিত্র-গঠনে অভিভাবন বা suggestionএরও স্থান আছে। যে শিক্ষক ধর্মশিক্ষা বা নীতিশিক্ষা দেবেন তাকে শিক্ষণের পদ্ধতি শিখতে হবে। কিন্তু বাল্যশিক্ষাই যথেষ্ট নয়, বয়স্থ জনসাধারণ যাতে সংযমিত থাকে তার জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা দরকার। শুধু উপদেশ বা সরকারী বিজ্ঞাপনে কাজ হবে না, বর্তমান দণ্ডনীতি কঠোরতর করতে হবে এবং সেইসঙ্গে প্রবল জনমত গঠন করতে হবে।
সৎকর্ম আর সচ্চরিত্রতার শ্রেষ্ঠ উদ্দীপক জনসাধারণের প্রশংসা, দুষ্কর্মের শ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক জনসাধারণের ধিক্কার। ট্রামকর্মী, মোটরবস ও ট্যাক্সির চালক, মুটে ইত্যাদির সাধুতা, বালক বৃদ্ধ স্ত্রীলোকের সাহসিকতা ইত্যাদি বিবরণ মাঝে মাঝে কাগজে দেখা যায়। এইসব কর্মের প্রশংসা আরও ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়া উচিত। সাধারণের কাছে সিনেমাতারকা, ফুটবল-ক্রিকেট-খেলোয়াড়, সাঁতারু ইত্যাদির যে মর্যাদা, সৎকর্মা আর সাহসী স্ত্রীপুরুষেরও যাতে অন্তত সেই রকম মর্যাদা হয় তার চেষ্টা করা উচিত। দুষ্কর্মের নিন্দা তীক্ষ্ণ ভাষায় নিরন্তর প্রচার করতে হবে, যাতে জনসাধারণের মনে ঘৃণার উদ্রেক হয়। শুধু মামুলী দুষ্কর্ম নয়, রাস্তায় ময়লা ফেলা, যেখানে সেখানে প্রস্রাব করা, পানের পিক ফেলা, রাস্তার কল খুলে জল নষ্ট করা, নিষিদ্ধ আতসবাজি পোড়ানো ইত্যাদি নানা রকম কদাচারের বিরুদ্ধে প্রবল আন্দোলন দরকার। সংবাদপত্রের কর্তারা যদি বিবিধ রাজনীতিক সভার বিবরণ, সিনেমা চিত্রের বিস্তারিত পরিচয়, রাশিফলের আলোচনা ইত্যাদি কমিয়ে দিয়ে সৎকর্মের প্রশংসা আর কুকর্মের নিন্দা বহুপ্রচারিত করেন তবে তা সার্থক কর্ণেজপন হবে, লোকমতও প্রভাবিত হবে। যেমন দেশব্যাপী খাদ্যাভাব, তেমনি দেশব্যাপী দুর্নীতি, কোনটাই উপেক্ষণীয় নয়। আমাদের রাজনীতিক আর সাংস্কৃতিক নেতাদেরও এই জনমত গঠনে উদ্যোগী হওয়া কর্তব্য।
সাধারণের পক্ষে ফ্যাশনের বিধান প্রায় অলঙ্ঘনীয়। যে নিষ্ঠার সঙ্গে স্ত্রী-পুরুষ ফ্যাশনের বিধি-নিষেধ মেনে চলে সেই রকম নিষ্ঠা বিহিত-অবিহিত কর্ম সম্বন্ধেও যাতে লোকের মন দৃঢ়বদ্ধ হয় তার জন্যে সুকল্পিত ব্যাপক আর অবিরাম প্রচার আবশ্যক। পঞ্চশীল ভঙ্গ করে চীন দুঃশীল হয়েছে, কর কর্ম করে ভারতবাসীকে ক্ষুব্ধ বিদ্বিষ্ট করেছে। চীনের শাসনতন্ত্রের যতই স্বেচ্ছাচার নির্দয়তা আর কুটিলতা থাকুক, প্রজার স্বাধীন চিন্তা যতই দমিত হক, সে দেশের জনসাধারণের যে নৈতিক উন্নতি হয়েছে তা অগ্রাহ্য করা যায় না। কিছুকাল আগেও দুর্নীতির জন্যে চীন কুখ্যাত ছিল, কিন্তু দশ বৎসরে ভাল-মন্দ যে উপায়েই হক, চীনের প্রজা সংযমিত কর্তব্যনিষ্ঠ হয়েছে, আর আমাদের দেশে তার বিপরীত অবস্থা দেখা দিয়েছে। কোনও অবতার বা মহাপুরুষ অলৌকিক শক্তির দ্বারা আমাদের উদ্ধার করতে পারবেন না। কমিউনিস্ট পদ্ধতির অন্ধ অনুকরণ না করেও আমরা সমবেত চেষ্টায় দেশের কলঙ্ক মোচন করতে পারি। যদি হাল ছেড়ে দিয়ে যভবিষ্য নীতি আশ্রয় করি তবে আমাদের রক্ষা নেই।
রিপূর্ণ সাহিত্য
পরিপূর্ণ সাহিত্য (১৮৮১/১৯৫৯)
রোজগার বললে অধিকাংশ বাঙালী বোঝে চাকরি। ওকালতি ডাক্তারি ঠিকাদারি দালালি ব্যবসা ইত্যাদি রোজগার হলেও অগ্রগণ্য নয়, সাধারণ ভদ্রসন্তানের দৃষ্টিতে চাকরিই সর্বোত্তম জীবিকা। সেই রকম, সাহিত্য বললে অধিকাংশ বাঙালী বোঝে প্রধানত গল্প-উপন্যাস, তার পর কবিতা, তার পর লঘু প্রবন্ধ বা রম্যরচনা। ইংরেজীতে literature অর্থে অনেক রকম রচনা বোঝায়, কিন্তু বাঙলায় সাহিত্য শব্দ অতি সংকীর্ণ অর্থে চলে। অমুক একজন সাহিত্যিক এ কথার মানে, লোকটি গল্প উপন্যাস বা কবিতা লেখেন, অথবা তার সমালোচনা করেন।
অনেকে বলেন, বাঙলা কথাসাহিত্য এখন ইংরেজীর সমকক্ষ এবং বাঙলা ভাষা অন্যান্য ভারতীয় ভাষার চাইতে অনেক এগিয়ে আছে। কথাটা হয়তো সত্য, কিন্তু সেজন্য আমাদের বেশী আত্মপ্রসাদের কারণ নেই। শুধু গল্প । উপন্যাস নয়, সমগ্র ইংরেজী সাহিত্যের তুলনায় সমগ্র বাংলা সাহিত্যের অবস্থা কি রকম তা ভাবা দরকার।
স্কুল-কলেজের টেক্সটবুক, শিশুপাঠ্য গল্প-কবিতা, ওকালতি ডাক্তারি ইত্যাদি কর্ম সংক্রান্ত পুস্তক, রাজ্যশাসন সংক্রান্ত নানারকম বিধিগ্রন্থ–এই সব ছাড়া যত গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাই বয়স্থ জনসাধারণ অবসরকালে পড়ে। তা থেকেই আধুনিক বাঙালী লেখক আর পাঠকের সাহিত্যিক রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। এই সমস্ত রচনা মোটামুটি দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম শ্রেণীতে পড়ে–উদ্ভাবী (বা কাল্পনিক) আর ভাবাত্মক অর্থাৎ creative আর emotional রচনা। গল্প উপন্যাস কবিতা ভক্তিগ্রন্থ ইত্যাদি এই শ্রেণীর অন্তর্গত এবং এই সবেরই পাঠক বেশী। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে– জ্ঞানাত্মক আর বাস্তব-বিষয়ক অর্থাৎ informative আর factual রচনা। এই শ্রেণীর উদাহরণ–বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতত্ত্ব, রবীন্দ্রনাথের কালান্তর, বিশ্বপরিচয়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর জিজ্ঞাসা, বিচিত্র জগৎ, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের বিশ্বের উপাদান, বিনয় ঘোষের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, সমরেন্দ্রনাথ সেনের বিজ্ঞানের ইতিহাস। প্রথম শ্রেণীর তুলনায় দ্বিতীয় শ্রেণীর গ্রন্থসংখ্যা অনেক কম, পাঠকও কম। এসব বইএর বারো মাসে তেরো সংস্করণ হবার কোন আশা নেই।
ইংরেজী প্রভৃতি সমৃদ্ধ ভাষায় ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের পত্রিকা আছে, যেমন, গল্প-উপন্যাস, কবিতা, দেশ-ভ্রমণ, সার-সংকলন বা digest, খেলা, বিভিন্ন বিজ্ঞান ও দর্শন ইত্যাদি, বাঙলা পত্রিকার বৈচিত্র্য বেশী নেই, সাধারণ মাসিক আর সাপ্তাহিক পত্রিকায় সব রকম জনপ্রিয় রচনা ছাপা হয়। এইসব পত্রিকায় নানারকম বইএর যে বিজ্ঞাপন থাকে তা থেকেই বাঙলা সাহিত্যের বর্তমান অবস্থার আন্দাজ পাওয়া যেতে পারে। আমার অনুরোধে Statisticsএর একটি ছাত্র * অনেকগুলি বিজ্ঞাপন থেকে একটি মোটামুটি পরিসংখ্যান খাড়া করেছেন। তার হিসাব অনুসারে বিজ্ঞাপিত বিভিন্ন শ্রেণীর বইএর শতকরা হার এই রকম —
গল্প উপন্যাস এবং তার আলোচনা – ৭৫
কবিতা নাটক এবং তার আলোচনা – ৫
ভক্তিগ্রন্থ – ৬
চরিতকথা, স্মৃতিকথা – ৪
ভ্রমণকথা, স্থান-বিবরণ – ২
ইতিহাস – ২
রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব – ২
অর্থনীতি, কৃষি, বাণিজ্য শিল্প – ১ এর কম
দার্শনিক বিষয় – ১
বৈজ্ঞানিক বিষয় – ১ এর কম
ফলিত জ্যোতিষ, অলৌকিক বিষয় – ১
অন্যান্য বিবিধ বিষয় – ১
এই ফর্দ থেকে বোঝা যায় যে বাঙলা সাহিত্যের শতকরা প্রায় ৮৬ ভাগ উদ্ভাবী বা কাল্পনিক এবং ভাবাত্মক রচনা। ইংরেজী প্রভৃতি বিদেশী সাহিত্যেও গল্প-উপন্যাসাদির সংখ্যা বেশী, কিন্তু জ্ঞানাত্মক গ্রন্থের অনুপাত এদেশের মতন অত্যল্প নয়।
সংস্কৃত শাস্ত্রে চৌষট্টি কলার উল্লেখ আছে, তার কতকগুলি ইংরেজী art সংজ্ঞার অন্তর্গত। যেমন গীত বাদ্য নৃত্য নাট্য আলেখ্য তক্ষণ। ইংরেজীতে গল্প আর কাব্য-রচয়িতাও আর্টিস্টরূপে গণ্য হন, বাঙলাতেও তাঁদের কলাবিৎ বলা চলে। যাঁরা ছবি আঁকেন, মূর্তি গড়েন, গীতবাদ্য-নৃত্য বা অভিনয় করেন তারা যেমন আর্টিস্ট, গল্প-উপন্যাস আর কবিতার লেখকও তেমনি আর্টিস্ট বা কলাবিৎ। এঁদের সকলেরই রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য চিত্তবিনোদন। যাতে বিনোদনের সঙ্গে মনের উৎকর্ষ আর অনুভূতির প্রসার হয় সেই রচনা অবশ্যই প্রকৃষ্ট। সকল দেশেই সংস্কৃতির একটি প্রধান অঙ্গ আর্ট বা কলাচর্চা।
সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে কথাসাহিত্য কাব্য সংগীত নাট্য চিত্রকলা প্রভৃতি অপরিহার্য তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কলাচর্চাই সংস্কৃতির সবটা নয়। উভাবী বা কাল্পনিক, এবং ভাবাত্মক, creative আর emotional সাহিত্যে সব প্রয়োজন মেটে না, জ্ঞানাত্মক আর বাস্তব বিষয়ক সাহিত্যও অপরিহার্য। এই জাতীয় সাহিত্য বাঙলায় যথেষ্ট নেই।
কেউ কেউ হয়তো বলবেন, জ্ঞানাত্মক বাস্তব বিষয়ের চর্চা তো স্কুল কলেজেই চুকে গেছে, প্রৌঢ় আর বৃদ্ধ বয়সেও যদি তার জের টানতে হয় তবে জীবন দুর্বহ হবে। এ রকম মনোভাব ঠিক নয়। শিক্ষার শেষ নেই, আজীবন তা চলে। ঠেকে শেখা শুনে শেখা আর দেখে শেখার সুযোগ সকল ক্ষেত্রে মেলে না, তাই যত কাল সামর্থ্য তত কালই পড়ে শিখতে হয়। মানুষের যে জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা পুরাকাল থেকে সংগৃহীত হয়ে আসছে তা শুধু বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতদের সংরক্ষিত গুহ্য বিদ্যা নয়, জনসাধারণের সাহিত্যেও যথাসম্ভব মনোজ্ঞ ভাষায় তাকে স্থান দিতে হবে।
টেক্সটবুক প্রায় নীরস রচনা, পরীক্ষা পাসের জন্যেই ছেলেমেয়েরা তা পড়ে। সে রকম লেখা বয়স্থ লোকের উপযুক্ত নয়। শুধু তথ্য থাকলেই চলবে না, রচনা চিত্তাকর্ষক হওয়া চাই, তবেই সাধারণ পাঠকের পড়বার আগ্রহ। হবে। ইংরেজীতে এই জাতীয় গ্রন্থ বিস্তর আছে, পাঠকও অসংখ্য। উদাহরণ আর আদর্শস্বরূপ কয়েকটি গ্রন্থের নাম করছি।–
H G Walesএর Short History of the World, সদ্য প্রকাশিত Julian Huxley Story of Evolution, M Davidson4g Easy Outline of Astronomy, Gilbert Murry Myths and Ethics, AN Whiteheadএর Science and the Modern World, নির্মলকুমার বসুর Cultural Anthropology।
বাঙলায় এই জাতীয় গ্রন্থ নেই এমন নয়, কিন্তু যথেষ্ট নেই। বিশ্ববিদ্যা সংগ্রহ নামে বিশ্বভারতী অনেকগুলি জ্ঞানগর্ভ ঘোট বই প্রকাশ করেছেন। শুনেছি এই গ্রন্থমালার ক্রেতা অনেক কিন্তু পাঠকও অনেক কিনা জানি না।
বাঙলা গল্প কাব্য আর ভক্তিগ্রন্থ সংখ্যায় এবং উৎকর্ষে শ্রেষ্ঠ হতে পারে, কিন্তু অন্যান্য রচনায় হিন্দী এগিয়ে যাচ্ছে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বাঙলা অনুবাদ প্রকাশের অনেক বৎসর আগেই হিন্দী অনুবাদ ছাপা হয়েছে। ভারতের প্রাকৃতিক আর শিল্পজাত দ্রব্যের বিবরণেও হিন্দী অগ্রণী। বাঙলার তুলনায় হিন্দীভাষীর সংখ্যা অনেক বেশী, হিন্দী বইএর পাঠকও বেশী। বিহার উত্তরপ্রদেশ পঞ্জাব রাজস্থান মধ্যপ্রদেশ–এই সকল রাজ্যে হিন্দী সাহিত্যের উন্নতির জন্য প্রচুর সরকারী সাহায্য আর উৎসাহ দেওয়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের পোষকতা তো আছেই। এ সবের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের সরকারী সাহায্য অতি অল্প। আমাদের অপূর্ণ সাহিত্যকে পূর্ণতা দেবার জন্য লেখক প্রকাশক পাঠক আর সরকার সকলকেই অবহিত হতে হবে। বাঙলা সাহিত্য চিরকালই ভারতের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হয়ে থাকুক এমন স্পর্ধা করতে বলি না, কিন্তু বাঙলা সাহিত্য সকল বিভাগে পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক এই কামনা বাঙালী মাত্রেরই করা উচিত।
[* আমি। –স:।]
বাংলা সাইক্লোপিডিয়া
বাংলা সাইক্লোপিডিয়া (১৮৭৭/১৯৫৫)
অষ্টাদশ শতাব্দের মাঝামাঝি কয়েকজন ফরাসী পণ্ডিত (Diderot, DAlembert, Voltaire, Euler ইত্যাদি) Encyclopedie নাম দিয়ে একটি গ্রন্থমালা রচনা করেন। নামটি গ্রীক থেকে উদ্ভূত, মৌলিক অর্থ– বিদ্যাপরিবৃতি, অর্থাৎ সর্বজ্ঞানের ভাণ্ডার। প্রচলিত সংস্কারের বিরোধী মত প্রকাশের জন্য সম্পাদকগণ তখনকার রোমান ক্যাথলিক ধর্মনেতাদের বিষদৃষ্টিতে পড়েছিলেন, রাজদণ্ডও ভোগ করেছিলেন। এই গ্রন্থ প্রকাশের কিছু পরে ইংরেজী Encyclopedia Britannica সংকলিত হয় এবং এ পর্যন্ত তার অনেক সংস্করণ হয়েছে। এই প্রকাণ্ড বহুখণ্ড বহুবার সংশোধিত গ্রন্থে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের লেখা যে সকল বিবৃতি আছে তা প্রামাণিক বলে গণ্য হয়।
নগেন্দ্রনাথ বসু প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব কর্তৃক সম্পাদিত বিশ্বকোষ এবং . অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ কর্তৃক আরব্ধ মহাকোষ গ্রন্থের উদ্দেশ্য উক্ত দুই গ্রন্থের অনুরূপ। নানা বিদ্যার ও জ্ঞাতব্য বিষয়ের বিবৃতিসংবলিত কোষগ্রন্থের সম্পাদন একজনের সাধ্য নয়, বহু বিশেষজ্ঞের সাহায্য ভিন্ন প্রামাণিক সংকলন অসম্ভব। নগেন্দ্রনাথ যা সমাপ্ত করেছেন এবং অমূল্যচরণ যার কয়েক খণ্ড প্রকাশ করে গেছেন তা অসাধারণ অধ্যবসায়ের ফল। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা যেমন মুখ্যত ব্রিটিশ জাতি, আর ইংরেজী ভাষার প্রয়োজনে রচিত, নগেন্দ্রনাথ আর অমূল্যচরণের গ্রন্থ তেমনি বাঙালী আর বাংলা ভাষার প্রয়োজনে রচিত।
কয়েকটি বৃহৎ বাংলা শব্দকোষে ভূগোল, ইতিহাস, ও সাহিত্য-বিষয়ক তথ্য এবং জীবনচরিত আছে। শ্ৰীযোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বহু বৎসর পূর্বে যে বাঙ্গলা শব্দকোষ রচনা করেছিলেন তাতে এদেশের খনিজ, বনজ, কৃষিজ দ্রব্য, প্রাণী, নৌকাদি যান, শিল্পসাধিত্র যথা তাঁত ঢেঁকি ঘানি, মাছ-ধরা জাল, গৃহোপকরণ এবং তাস পাশা দাবা প্রভৃতি খেলার বিবরণও আছে। অন্য কোনও বাংলা শব্দকোষে এসব পাওয়া যায় না। যোগেশচন্দ্রের গ্রন্থ সংস্কৃতেতর বাংলা শব্দের অভিধান, সেজন্য তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ প্রায় বর্জিত হয়েছে, তথাপি কয়েকটি সংস্কৃত নামযুক্ত বিষয়ের বিবৃতি আছে, যেমন সংগীতের তাল ও রাগ-রাগিণী। এই শব্দকোষ এখন পাওয়া যায় না। নব সংস্করণের জন্য তিনি গ্রন্থের আমূল পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন, শুনেছি তৎসম শব্দ যোগ করে অভিধানও পূর্ণাঙ্গ করেছেন। সুখের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থসাহায্যে এই বহু তথ্যপূর্ণ অদ্বিতীয় গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণের আয়োজন হচ্ছে।
বহুমূল্য কোষগ্রন্থ কেনা সকলের সাধ্য নয়, বিশেষ প্রয়োজন ভিন্ন প্রকাণ্ড গ্রন্থ নাড়াচাড়া করাও অসুবিধাজনক। ইংরেজীতে বড় মাঝারি ছোট অনেক রকম সাইক্লোপিডিয়া আছে। ছোটগুলির দাম বেশী নয়। তাতে যে বিবৃতি থাকে তা খুব সংক্ষিপ্ত হলেও মোটামুটি কাজ চলে। বাংলায় এই রকম ছোট কোষ রচনার চেষ্টা কয়েকজন করেছেন, কিন্তু ইংরেজী গ্রন্থের সঙ্গে কোনওটির তুলনা হয় না।
একটি ছোট সুসংকলিত প্রামাণিক বাংলা সাইক্লোপিডিয়ার প্রয়োজন আছে। যদি হাজার-বার শ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ পনর-কুড়ি টাকার মধ্যে পাওয়া যায় তবে বোধ হয় ক্রেতার অভাব হবে না। ইংরেজীর নকলে এই ছোট গ্রন্থের নাম বিশ্বকোষ বা ওই রকম কিছু দিলে অতিরঞ্জন হবে। বিষয়কোষ নাম চলতে পারে। শব্দকোষ বা অভিধানের প্রধান উদ্দেশ্য–শব্দের রূপ অর্থ ও প্রয়োগবিধির নির্দেশ। বিষয়কোষের উদ্দেশ্য–বিষয় (subject) অর্থাৎ পদার্থ, জাতি (class), ব্যক্তি (individual), স্থান, ঘটনা প্রভৃতির বিবৃতি। শব্দকোষ যেমন ভাষা শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চার সহায়, বিষয়কোষ সেইরূপ বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে সন্দেহ নিরসন ও জ্ঞান লাভের সহায়।
যে কোষগ্রন্থের প্রস্তাব করছি তার উদ্দেশ্য বাংলা ভাষার গৌরব বর্ধন নয়, শুধুই উপস্থিত প্রয়োজন সাধন। সাধ্যের অতিরিক্ত সঙ্কল্প করলে কাজ অগ্রসর হবে না, হয়তো পণ্ড হবে। এমন একটি গ্রন্থ চাই যা থেকে ছাত্র শিক্ষক লেখক পাঠক সাংবাদিক রাজনীতিক ব্যবসায়ী প্রভৃতি সকলেই দেশীয় বিষয় সম্বন্ধে জিজ্ঞাসার সংক্ষিপ্ত উত্তর পান। যা ইংরেজী গ্রন্থে পাওয়া যায় তা দেবার কিছুমাত্র প্রয়োজন দেখি না, তাতে সম্পাদনের শ্রম আর প্রকাশের খরচ অনর্থক বাড়ানো হবে। আমরা এখনও ইংরেজী ভাষার চর্চা করি। যখন ইংরেজী বর্জন করব, তখন বিষয়কোষের পরিধি বাড়ালেই চলবে, যাতে বিদেশী গ্রন্থের দরকার না হয়। আপাতত পাশ্চাত্ত্য কোনও বিষয় জানতে হলে ইংরেজী সাইক্লোপিডিয়াই দেখব। যা তাতে নেই, যা নিতান্ত এদেশের শুধু তার জন্যই বাংলা বিষয়কোষের প্রয়োজন।
শব্দকোষের মতন বিষয়কোষ বর্ণানুক্রমেই সংকলিত হওয়া আবশ্যক। বিষয়ের শ্ৰেণী ভাগ করলে (অর্থাৎ বিজ্ঞান ইতিহাস শিল্প জীবন-চরিত ইত্যাদি পৃথক পৃথক দিলে) সুবিধা হবে না। প্রস্তাবিত গ্রন্থে আল্পস্, লন্ডন, পিরামিড, তড়িত্তত্ত্ব, সাইক্লোট্রন, ব্যাকটিরিয়া, বাওবাব বৃক্ষ অনাবশ্যক, কিন্তু অবিভক্ত ভারতের নগর পর্বত নদী মন্দিরাদি, পশুপক্ষী, কীট-পতঙ্গ, শাল সেগুন ধান যব গম আম কাঁঠাল কলা থাকবে। এদেশের চটকল, কাপড় কল, কাগজ, সিমেন্ট, রাসায়নিক সার, লোহা তামা এঞ্জিন টেলিফোন বন্দুক কামান বারুদ প্রভৃতির কারখানা, দামোদর পরিকল্পনা ইত্যাদির কথাও থাকবে। সীজার শেক্সপীয়র মার্কস স্তালিন চার্চিল, ফরাসী বিপ্লব, ইউরোপীয় দর্শন সাহিত্য ও কলা বাদ যাবে; চন্দ্রগুপ্ত কালিদাস তুলসীদাস রবীন্দ্রনাথ বরাহমিহির গান্ধী, সিপাহী-বিদ্রোহ, ভারতীয় দর্শন সাহিত্যকলা দিতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় এলিজাবেথ বাদ যাবেন, আলেকজান্ডার, হিউএসাং, মহম্মদ ঘোরি, অলবেরুনি, ভিক্টোরিয়া থাকবেন, কারণ তাঁদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঘটেছিল। কৃষ্ণ বুদ্ধ চৈতন্য রামমোহন রামকৃষ্ণ থাকবেন, বিদেশী হলেও জরথুস্ত্র খ্রীষ্ট মহম্মদ সেন্ট টমাস থাকবেন, কারণ এঁদের সঙ্গে বহু ভারতবাসীর ধর্মীয় সম্বন্ধ আছে; কিন্তু আখেনাটেন, সেন্ট পল, মার্টিন লুথার বাদ যাবেন। কংগ্রেস, মোসলেম লীগ, হিন্দু মহাসভা, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি ভারতীয় রাজনীতিক দল থাকবে, কিন্তু নাৎসী বলশেভিক কুমেনটাং প্রভৃতি বাদ যাবে।
কিউবা কোথায়? প্লেটোর প্রধান রচনাবলী কি কি? ক্যাসানোভা কে? আইফেল টাওয়ার কি? ইভোলিউশন থিওরি কি? জেসুইট কোয়েকার মরমন কারা? এই সব প্রশ্নের জন্য আমরা ইংরেজী সাইক্লোপিডিয়া দেখব। বাংলা বিষয়কোষে দেখব–মাণ্ডি রাজ্য কোথায়? ভাস কবির প্রধান রচনা কি কি? পরাগল খাঁ কে? যন্ত্রমন্ত্র কি? নব্য ন্যায় কি রকম? মিতাক্ষরা আর দায়ভাগের প্রভেদ কি? নাথপন্থী কর্তাভজা ওআহাবী কারা?
.
এই রকম একটি বিষয়কোষ রচনা করতে হলে বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ লোকের সমবেত চেষ্টা চাই। তারা এক বা একাধিক সম্পাদকের নির্দেশ অনুসারে লিখবেন অথবা তথ্য যোগান দেবেন। বাংলা দেশে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি মহাশয়ের তুল্য অশেষজ্ঞ পণ্ডিত দ্বিতীয় নেই। বয়স ছিয়ানব্বই হলেও তার নানা বিষয়ে আগ্রহ আছে, এখনও তিনি লেখেন। প্রস্তাবিত গ্রন্থের সম্পাদনের ভার তাকে দিতে বলছি না, লেখার জন্য কিছুমাত্র পীড়ন করতেও বলছি না। বিষয়কোষ যাঁরা রচনা করবেন তাদের কর্তব্য হবে যোগেশচন্দ্রের সঙ্গে যোগ রাখা, তার উপদেশ নেওয়া, এবং তার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। নানা বিদ্যায় তার অধিকার আছে, ভারতীয় জ্যোতিষ উভিদ প্রাণী এবং চিরাগত শিল্প সম্বন্ধে তার অগাধ জ্ঞান, এবং অনেক তথ্য তার জানা আছে যা আমাদের আধুনিক শিক্ষিত বিজ্ঞানীরা জানেন না। এদেশের লোকাঁচার এবং ব্রত-পূজাদি সম্বন্ধেও তিনি অনেক জানেন। তিনি বর্তমান থাকতে তার জ্ঞানভাণ্ডার থেকে যদি তথ্য আহরণ না করি, তবে আমরা বঞ্চিত হব।*
.
এই গ্রন্থ রচনা ও প্রকাশের উদ্যোগ কে করবেন? বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ জড়ত্ব লাভ করেছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিত্য কর্ম আর শিক্ষার সংস্কার নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, নূতন কিছুতে হাত দেবেন মনে হয় না। উত্তর ও মধ্য প্রদেশের সরকার নিজ ভাষার উন্নতির জন্য প্রচুর টাকা খরচ করছেন, শুনেছি একটি ছোট হিন্দী সাইক্লোপিডিয়া রচনারও আয়োজন হয়েছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গ সরকার রবীন্দ্রপুরস্কার ছাড়া বাংলা ভাষার জন্য কিছু খরচ করেন কি না জানি না। নানা পরিকল্পনা আর বিদেশী বিশেষজ্ঞদের। জন্য তারা অজস্র টাকা যোগাতে পারেন। যাতে এদেশের শিক্ষার সাহায্য হয়, জিজ্ঞাসুর জ্ঞানলাভ হয়, এমন একটি উদ্দেশ্যের জন্য তারা কি কয়েক হাজার টাকা খরচ করতে পারেন না? রাধাকান্ত দেব, মহাতাব চাঁদ, কালীপ্রসন্ন সিংহের তুল্য কোনও বিদ্যোৎসাহী বদান্য ব্যক্তি বা ধনী বাঙালী ব্যবসায়ী যদি সাহস করে গ্রন্থ প্রকাশের আয়োজন করেন, তবে তাদের ক্ষতি না হয়ে লাভেরই সম্ভাবনা।
গ্রন্থ রচনার জন্য এমন একদল লোকের প্রয়োজন হবে যাঁরা ভূগোল ইতিহাস পুরাণ দর্শন বিবিধ বিজ্ঞান, কৃষি গোপালন খনিকৰ্ম শিল্প চিকিৎসা স্বাস্থ্যতত্ত্ব আইন রাজনীতি অর্থনীতি পরিসংখ্যান প্রত্নতত্ত্ব সমাজতত্ত্ব লোকাঁচার সাহিত্য চারুকলা স্থাপত্য, বিবিধ ধর্মসম্প্রদায়, খ্যাত লোকের জীবনচরিত, ইত্যাদিতে অভিজ্ঞ। যাঁরা শুধু পাশ্চাত্ত্য বিদ্যাই শিখেছেন তারা বেশি কিছু করতে পারবেন না। এদেশের ঐতিহ্য প্রকৃতি আর আধুনিক শিল্পোদ্যোগ সম্বন্ধে যাঁরা খবর রাখেন তারাই এই কাজের যোগ্য। খ্যাতিমান সাক্ষিগোপাল বা অতি বৃদ্ধ অক্ষম লোককে সম্পাদনের ভার দেওয়া বৃথা। যিনি (বা যাঁরা) কর্মঠ ও বহুজ্ঞ, এমন লোককেই সম্পাদক পদে বরণ করতে হবে। সম্পাদক ও সহকর্মী সকলকে পরিমিত পারিশ্রমিক দিতে হবে, বেগারে কাজ চলবে না।
যদি জনকতক উৎসাহী সুশিক্ষিত লোক অগ্রণী হন তবে এই গ্রন্থ রচনার সূত্রপাত হতে পারবে। দু শ বৎসর আগে ফ্রান্সে কয়েকজন পণ্ডিত যার উদ্যোগ করেছিলেন এবং চার্চের বশংবদ রাজশক্তির প্রবল বাধা সত্ত্বেও যা সমাপ্ত করেছিলেন, তার চাইতে অনেক ছোট একটি গ্রন্থ রচনা কি এই যুগের বাঙালীর পক্ষে অসম্ভব?
[* এই প্রবন্ধ লেখার সময় যোগেশচন্দ্র জীবিত ছিলেন।]
রচনা ও রচয়িতা
রচনা ও রচয়িতা (১৮৮১/১৯৫৯)
আমরা যেসব বস্তু নিত্য ব্যবহার করি তার অধিকাংশের উদ্দেশ্য জীবনযাত্রার স্কুল প্রয়োজন মেটানো। এইসব বস্তুর কতকগুলি অতি প্রাচীন, তাদের উদ্ভাবক বা প্রবর্তকের নাম আমাদের জানা নেই। যেমন তীর-ধনুক, পোড়ামাটির বাসন, গাড়ির চাকা, কাপড় বোনার তাঁত ইত্যাদি। কতকগুলি বস্তুর প্রবর্তকের নাম আমরা জানি এবং সসম্মানে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। কিন্তু তাদের প্রবর্তিত বস্তুর পরিবর্তন করতে আমাদের কিছুমাত্র দ্বিধা হয় না, তাতে তাদের মর্যাদাহানি হবে তাও মনে করি না। আমরা চাই, যা কাজের জিনিস তা আরও কাজের উপযুক্ত হক, আরও ভাল হক। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রচিত প্রথম ব্যাকরণের জন্য পাণিনির নাম জগদবিখ্যাত, কিন্তু পরবর্তী ব্যাকরণকারগণ পাণিনির অন্ধ অনুকরণ করেন নি। প্রথম বিজলী বাতির উদ্ভাবক এডিসন এবং প্রথম সার্থক এয়ারোপ্লেনের নির্মাতা রাইট-ভ্রাতৃদ্বয় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন, কিন্তু তাদের নির্মিত বস্তুর সঙ্গে আধুনিক বস্তুর সাদৃশ্য খুব কম।
নিত্যব্যবহার্য জিনিসের উপযোগিতা বা utilityই অগ্রগণ্য, তার উদ্ভাবকের কীর্তি অতি গৌণ। কে প্রথমে তৈরি করেছিলেন তা অনেকেই জানে না, যারা জানে তারাও ব্যবহারকালে স্মরণ করে না। কিন্তু যেসব বস্তুর মুখ্য উদ্দেশ্য আনন্দদান অথবা ভাব বা রসের উৎপাদন, তার সঙ্গে রচয়িতার সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য। রচয়িতা যদি অজ্ঞাত হন তথাপি তার কৃতির উপর অন্যের হস্তক্ষেপ স্যাক্রিলেজ তুল্য অপরাধ গণ্য হয়। কেউ যদি অ্যাপোলো, বেলভিডিয়র বিগ্রহ বা অশোকস্তম্ভের সিংহমূর্তি আরও ভাল করে গড়তে চায়, কিংবা কালিদাস শেক্সপীয়র রবীন্দ্রনাথের রচনার সংস্কার করতে চায়, তবে সে উন্মাদ গণ্য হবে।
বেদের এক নাম শুতি, কারণ গুরুশিষ্যপরম্পরায় মুখে মুখে আর শুনে শুনে বেদাধ্যয়ন হত। প্রাচীন ভারতের লিপির প্রচলনের পরেও বেদাভ্যাসের এই পদ্ধতি বজায় ছিল, এখনও কিছু কিছু আছে। পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতরা সহজে প্রশংসা করেন না, কিন্তু তারাও মেনেছেন যে অন্তত তিন হাজার বৎসর যাবৎ বেদবিদ্যা মুখে মুখেই চলে আসছে এবং অপরিবর্তিত আছে। শুধু তার বাক্য নয়, উদাত্ত অনুদাত্ত স্বরিত ভেদে তার উচ্চারণ বা পঠনরীতিও প্রায় যথাযথ রক্ষিত হয়েছে। এই আশ্চর্য ঘটনার কারণ, বেদের প্রতি ভারতবাসীর অসীম শ্রদ্ধা। বাঙলা দেশে বেদচর্চা প্রায় লোপ পেয়েছিল, সেজন্য মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কয়েকজন বাঙালী পণ্ডিতকে শুদ্ধ পাঠ শেখবার জন্য কাশী পাঠিয়েছিলেন। এখনও ব্রাহ্ম উপাসনায় প্রাচীন রীতিতে উপনিষদাদির শ্লোক উচ্চারিত হয়।
শুধু বেদ নয়, সংস্কৃত কাব্য পাঠের রীতিও অতি প্রাচীন এবং সর্বত্র প্রায় একরকম। কিন্তু বাঙালীর সংস্কৃত উচ্চারণে বিকার এসেছে। শুনেছি কোনও এক পণ্ডিত রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, সংস্কৃত বাক্য রচনার যেমন গৌড়ী আর বৈদভী রীতি আছে তেমনি বাঙালীর সংস্কৃত উচ্চারণকে গৌড়ী রীতি রূপে মেনে নিতে দোষ কি? এই উক্তির জন্য তিনি ধমক খেয়েছিলেন। আমরা সংস্কৃত কবিতা সুর করে পড়তে জানি না, নীরস গদ্যের মতন পড়ি; কিন্তু ভারতের অধিকাংশ প্রদেশে সুর করে পড়াই রীতি। বিহারী উত্তরপ্রদেশী মরাঠী গুজরাটী এবং দ্রাবিড় পণ্ডিতরা প্রায় একই সুরে সংস্কৃত কাব্য আবৃত্তি করেন। এই চিরাগত রীতির কারণও সংস্কৃতের প্রতি শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ।
আমাদের দেশের অনেক ওস্তাদ মনে করেন, গান-বাজনা গুণিজনের স্বচ্ছন্দ বিহার বা কসরতের ক্ষেত্র, যদি নির্দিষ্ট সুর আর তাল মোটামুটি বজায় রাখা হয় তবে কর্তব বা সুর ভাঁজায় গায়কের চিরন্তন অধিকার আছে। গান যদি বেওয়ারিশ হয় কিংবা গানের বাক্য যদি তুচ্ছ আর সুরের বাহন মাত্র হয় তবে কর্তবে আপত্তির কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু রচয়িতা যদি কবিতার সঙ্গে তাল মান লয় যোগ করে গান রচনা করেন তবে তার অলংকরণের অধিকার গায়কের থাকে না। কালিদাস পার্বতী-পরমেশ্বরকে বাগর্থ তুল্য সম্পৃক্ত বলেছেন। কবি যখন গান রচনা করেন তখন বা আর অর্থের সঙ্গে সুরও সম্পৃক্ত করেন, অর্থাৎ কবিরচিত গানে কবিতার সঙ্গে সুরের অচ্ছেদ্য ও অপরিবর্তনীয় বন্ধন ঘটে।
রবীন্দ্রকাব্যের বাক্যের পরিবর্তন যেমন গর্হিত, রবীন্দ্রসংগীতের সুরের পরিবর্তন বা অলংকরণও তেমনি গর্হিত। মনালিসার বাঁকা হাসি যদি ভাল না লাগে তবে অতি বড় চিত্রবিশারদেরও তা সোজা করবার অধিকার নেই। যিনি মনে করেন, নির্দিষ্ট রীতিতে না পেয়ে রবীন্দ্রসংগীত আরও শ্রুতিমধুর করে গাওয়া যেতে পারে, তার উচিত অন্য গান রচনা করে তাতে নিজের– সুর দেওয়া।
রবীন্দ্র-জন্মদিন
রবীন্দ্র-জন্মদিন (১৮৮১/১৯৫৯)
কোনও মহাপুরুষের উদ্দেশে লোকে যখন সমবেতভাবে শ্রদ্ধার অর্ঘ দেয়। তখন এক বা একাধিক প্রতীক উপলক্ষ্য করেই তা দিয়ে থাকে। এই প্রতীক প্রতিমূর্তি হতে পারে, কৃতির নিদর্শন হতে পারে, জন্মস্থান সাধনাস্থান বা জন্মদিনও হতে পারে। যদি অসংখ্য অনুরাগী জন একই কালে বা একই স্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তবে সেই শ্রদ্ধা বিপুলতা পায়।
পঁচিশে বৈশাখে অনেক লোক জন্মেছে, কিন্তু একাধিক রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয় নি। অতএব এই তারিখের কোনও নিজস্ব নিরপেক্ষ মহত্ত্ব নেই। ফলিত জ্যোতিষে যাঁদের আস্থা আছে তারা হয়তো বলবেন, শুধু দিন ক্ষণ তিথি নক্ষত্র নয়, আরও অনেক রকম জটিল যোগাযোগ চাই, তবেই রবীন্দ্রনাথের তুল্য পুরুষের উদ্ভব হতে পারে। যাঁরা কার্যকারণের অনন্ত শৃঙ্খলা মানেন তারা বলবেন, শুধু জ্যোতিষিক সমাবেশ নয়, অসংখ্য কারণপরম্পরার ফল স্বরূপ রবীন্দ্রনাথের উদ্ভব হয়েছিল, কিন্তু তার নির্ণয় আমাদের অসাধ্য।
তীর্থস্থানের মাহাত্ম্য দেবতার অধিষ্ঠানের জন্য নয়, বহু কাল যাবৎ অগণিত ভক্তের সমাগমের ফলে সামান্য স্থানও পুণ্যভূমি হয়ে ওঠে। চৈত্র শুক্ল-নবমী, ভাদ্র-কৃষ্ণ-অষ্টমী, ক্রিসমাস ডে প্রভৃতির পুণ্যতা রামচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণ বা যিশুখ্রীষ্টের জন্মের জন্য নয়, অসংখ্য ভক্ত একই দিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করে, সেই কারণেই তা পুণ্যদিন। পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের জন্ম একটি আকস্মিক ঘটনা। তিনি যদি সামান্য লোক হতেন তবে এই দিন কেউ গ্রাহ্য করত না। তিনি অসামান্য, তাই এই দিনকে উপলক্ষ্য করে গুণগ্রাহী ভক্তজন সমবেতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করে, এবং তার ফলেই এই দিনটি পুণ্যময় পর্বদিনে পরিণত হয়েছে।
বুদ্ধ খ্রীষ্ট চৈতন্যদেব প্রভৃতির যে বিবরণ সমকালীন লোকরা রেখে গেছেন তার কতটা ইতিবৃত্ত আর কতটা পৌরাণিক বা mythical তার নির্ণয় সহজ নয়। ধর্মনেতা বা অবতারদের চরিতকথায় কালক্রমে অতিরঞ্জন এসে পড়ে। ভাগ্যক্রমে রবীন্দ্রনাথ ধর্মনেতা ছিলেন না এবং তিনি স্বয়ং স্মৃতিকথা লিখে গেছেন। যারা তার অন্তরঙ্গ ছিলেন তাঁদের অনেকে কবির কথা লিখেছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন তারা এখনও লিখছেন। পঞ্চাশ ষাট সত্তর বৎসর পরে এই সাক্ষাৎদর্শীদের কেউ জীবিত থাকবেন না, তখন তাদের লিখিত বিবরণ আর কবির স্বরচিত আত্মকথাই আমাদের ঐতিহাসিক সম্বল হবে।
স্মরণ কীর্তন আর আলোচনাই শ্রদ্ধাপ্রকাশের শ্রেষ্ঠ উপায়। তার ভিত্তি বিশ্বস্ত সত্যাশিত বিবরণ। যাঁরা কবির কথা লিখছেন, ভবিষ্যদ্-বংশীয়দের কাছে তাদের গুরুতর দায়িত্ব আছে। লেখক আর সমালোচকদের সতর্ক থাকতে হবে যেন রবীন্দ্রচরিতকথায় কল্পনা আর জল্পনা না আসে, যেন তা কিংবদন্তী বা অবদানকল্পলতায় পরিণত না হয়।
বীন্দ্রকাব্যবিচার
রবীন্দ্রকাব্যবিচার (২৬.০৪.১৯৬০)
যাঁরা সাহিত্যের চর্চা করেন তাদের তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়– লেখক, পাঠক, আর সমালোচক। লেখক সাহিত্য রচনা করেন, পাঠক তা উপভোগ করেন, সমালোচক তার উপভোগ্যতা বিচার করেন। এই তিন শ্রেণীর চেষ্টা বিভিন্ন, পটুতাও বিভিন্ন, কিন্তু এঁদের সংস্কার বা মানসিক পরিবেশ যদি মোটামুটি একরকম না হয় তবে লেখক পাঠক আর সমালোচকের সংযোগ হতে পারে না। বন্দে মাতরম্ গান সকল জাতির এবং সকল সম্প্রদায়ের উপভোগ্য হতে পারে নি, কারণ তার রূপক অনেকের সংস্কারের অনুকূল নয়। রুল ব্রিটানিয়া, ইয়াংকি ডুডল প্রভৃতি গান সম্বন্ধেও এই কথা খাটে।
রবীন্দ্রনাথ নিজেকে হিন্দু বলতেন, যদিও তিনি সনাতনী ছিলেন না। ভারতীয় পুরাণ তত্ত্বে তার প্রচুর জ্ঞান ছিল, বাল্মীকি কালিদাস প্রভৃতির তিনি অনুরক্ত পাঠক ছিলেন, উপনিষৎ থেকে আরম্ভ করে রূপকথা আর গ্রাম্য ছড়া পর্যন্ত ভারতীয় সাহিত্য ইতিহাস আর ঐতিহ্যের কোনও অঙ্গই তিনি উপেক্ষা করেন নি। পূর্ববর্তী লেখক ভারতচন্দ্র মধুসূদন বঙ্কিমচন্দ্র হেমচন্দ্র নবীনচন্দ্র প্রভৃতির ন্যায় রবীন্দ্রনাথও ভারতীয় ঐতিহ্যে লালিত হয়েছিলেন। তারই ফলস্বরূপ কর্ণ-কুন্তী, কচ-দেবযানী, ব্রাহ্মণ, অভিসার, মেঘদূত প্রভৃতি অনবদ্য রচনা তার কাছ থেকে আমরা পেয়েছি। এই বিশিষ্ট ভারতীয় সংস্কারের চিহ্ন তার সকল রচনাতেই অল্পাধিক পরিমাণে লক্ষ্য করা যায়।
পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য যেমন গ্রীস-রোমের পুরাণ, বাইবেল আর ইউরোপীয় ইতিহাস থেকে সংস্কার পেয়েছে, আমাদের সাহিত্যও তেমনি ভারতীয় দর্শন পুরাণ ইতিহাসাদি থেকে পেয়েছে। পাশ্চাত্ত্য সংস্কার মোটামুটি আয়ত্ত না করলে যেমন পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের রসগ্রহণ করা যায় না, তেমনি ভারতীয় সংস্কারে ভাবিত না হলে এদেশের সাহিত্য উপভোগ করা অসম্ভব।
রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী কবিদের মধ্যে যাঁদের প্রাচীনপন্থী বা রবীন্দ্রানুসারী বলা হয় তাদের রচনাও ভারতীয় সংস্কার দ্বারা অনুপ্রাণিত। কিন্তু যাঁরা আধুনিক বলে খ্যাত তারা এই সংস্কার প্রায় বর্জন করে চলেন, তাঁদের রচনায় আধুনিক পাশ্চাত্ত্য কবিদের প্রভাবই প্রকট, গ্রীস-রোমের পুরাণকথার উল্লেখও কিছু কিছু দেখা যায়। এই নব্য রীতি প্রবর্তনের কারণ– গতানুগতিকতায় বিতৃষ্ণা এবং আধুনিক পাশ্চাত্ত্য কাব্যরীতির প্রতি অনুরাগ। আর একটি কারণ–এদেশের ঐতিহ্যকে এঁরা প্রগতির পথে বাধা স্বরূপ মনে করেন, সেজন্য তার যথোচিত চর্চা করেননি।
পূর্ববর্তী কবিরা যে সংস্কার অর্জন করেছিলেন, তা থেকে এঁরা প্রায় বঞ্চিত। রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্মণ, মেঘদূত প্রভৃতির তুল্য রচনা এঁদের আদর্শের অনুরূপ নয়, সাধ্যও নয়। এ নহে কুঞ্জ কুন্দ-কুসুম রঞ্জিত, ফেনহিল্লোল কল কল্লোলে দুলিছে–এইরকম অনুপ্রাসময় ছন্দ তারা অতি সেকেলে মনে করেন। তার লটপট করে বাঘছাল তার বৃষ রহি রহি গরজে, তার বেষ্টন করি জটাজাল, যত ভুজঙ্গদল তরজে–এই ধরণের পৌরাণিক কল্পনাতেও তাদের অরুচি ধরে গেছে। রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্ব তারা অস্বীকার করেন না, কিন্তু আদর্শও মনে করেন না।
বাঙালী সমাজের একটি শাখা ইঙ্গবঙ্গ নামে খ্যাত। আধুনিক বাঙলা সাহিত্যে যে নূতন শাখা উদ্গত হয়েছে, তাকে ইওরোবঙ্গ নাম দিলে ভুল হবে না। এই নূতন শাখার প্রসারের ফলে আমাদের সাহিত্যের প্রাচীন শাখার ক্ষতি হবে মনে করি না। সাহিত্যের মার্গ বহু ও বিচিত্র, কালধর্মে নূতন নূতন মার্গ আবিষ্কৃত হবেই। একদল কবি যদি পূর্ব ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বনির্বাচিত পথেই চলেন এবং তাদের গুণগ্রাহী পাঠক আর সমালোচকের সমর্থন পান তাতে সাহিত্যের বৈচিত্র্য বাড়বে ছাড়া কমবে না।
প্রাচীন আর নবীন দুই শাখায়ই নিষ্ঠাবান লেখক পাঠক আর সমালোচক আছেন। এক শাখার সমালোচক যদি অন্য শাখার রচনা বিচার করেন, তবে পক্ষপাতিত্ব অসম্ভব নয়। তথাপি বাঙ্গালী সমালোচকের পক্ষে সমগ্র বাঙলা কাব্য বিচারের চেষ্টা স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতীয় বা বিদেশী যে কোনও পণ্ডিতের পক্ষে ভারতীয় আর পাশ্চাত্ত্য রচনার তুলনাত্মক সমালোচনা সহজ নয়।
এককালে রবীন্দ্রকাব্যের যেসব দোষদর্শী সমালোচক ছিলেন তাঁরা সকলেই প্রাচীনপন্থী। নব্যতন্ত্রের পক্ষ থেকে প্রতিকূল সমালোচনা বিশেষ কিছু হয়নি। রবীন্দ্রকাব্য আর পাশ্চাত্ত্যকাব্যের তুলনাত্মক নিরপেক্ষ বিচার করতে পারেন এমন বিদগ্ধ প্রতিভাবান সাহিত্যিক কেউ আছেন কিনা জানি না। মধুসূদন দত্ত যদি একালের লোক হতেন, তবে হয়তো পারতেন, প্রমথ চৌধুরীও হয়তো পারতেন। কোনও বিদেশী পণ্ডিতের এইরূপ সমালোচনার যোগ্যতা আছে কিনা সন্দেহ। ভারতীয় আর পাশ্চাত্ত্য উভয়বিধ সাহিত্যে যাঁর গভীর জ্ঞান নেই, উভয়বিধ সংস্কারে যিনি ভাবিত নন, তাঁর পক্ষে তুলনাত্মক বিচারের চেষ্টা না করাই উচিত।
রাশি রাশি
রাশি রাশি (১৮৮১/১৯৫৯)
শ্রীপ্রমথনাথ বিশীর কোনও বইএ পড়েছি, অক্ষয়কুমার দত্ত অহরহ ভাবতেন, ব্রহ্মাণ্ড কি প্রকাণ্ড! শেষ বয়সে তার মাথার অসুখ হয়েছিল, নিরামিষ ছেড়ে আমিষ খেতে শুরু করেছিলেন। প্রকাণ্ড ব্রহ্মাণ্ডের চিন্তাই বোধ হয় তার অসুখের কারণ।
বিপুল, বিশাল, বিরাট, ভূমা, অসীম ইত্যাদি শব্দের একটা মোহিনী শক্তি আছে। অত্যন্ত বৃহতের চিন্তা আমাদের একটু অভিভূত করে, তার উপলব্ধিতে আমরা বিস্ময়াবিষ্ট হই, আনন্দিত হই, কিঞ্চিৎ ভয়ও পাই। অদৃষ্টপূর্ব বিশ্বরূপ দর্শন করে অর্জুন হর্ষিত অর্থাৎ রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন, তাঁর মন ভয়ে প্ৰব্যথিত হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বিপুলতা থেকে আশ্বাসও পান। ভবভূতি তার জীবদ্দশায় অবজ্ঞাত ছিলেন। মালতীমাধব নাটকের প্রস্তাবনায় এই বলে তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছেন কাল নিরবধি, পৃথিবীও বিপুলা; কোনও কালে কোনও দেশে এমন লোক থাকতে পারেন যিনি আমার সমানধর্মা এবং এই রচনার গুণগ্রহণে সমর্থ।
.
আকাশ সমুদ্র হিমালয় ইত্যাদির বিশালতা কবিকে ভাবাবিষ্ট করে। দেশ আর কাল নিয়ে দার্শনিকরা চিরকাল মাথা ঘামিয়েছেন, এই দুই বিরাট পদার্থের কি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, না শুধুই আমাদের অধ্যাস বা illusion? এখনও তারা এ রহস্যের সমাধান খুঁজে পান নি। বিজ্ঞানীরা সমস্তই মাপতে চান, তাদের মানদণ্ড একদিকে বেড়ে চলেছে, আর একদিকে সূক্ষ্মাদপি সূক্ষ্ম হচ্ছে, আগে যে সংখ্যা পর্যাপ্ত মনে হত এখন তাতে কুলয় না। সেকালেও লোকের ধারণা ছিল যে আকাশে অসংখ্য তারা আছে, কিন্তু শুধু চোখে যা দেখা যায় তার সংখ্যা তিন হাজারের বেশী নয়, লোকে তাই অসংখ্য মনে করত। এখন যন্ত্রের যত উৎকর্য হচ্ছে ততই বেশী তারা দেখা যাচ্ছে, লক্ষ থেকে কোটি, তার পর বহু কোটি।
এক শ বৎসর আগে পাশ্চাত্ত্য দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত লোক বাইবেলের উক্তি অনুসারে বিশ্বাস করতেন যে খ্রীষ্টজন্মের প্রায় চার হাজার বৎসর পূর্বে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল। উনিশ শতকের মধ্যভাগে ভূবিজ্ঞানী লায়েল বললেন, পৃথিবীর বয়স কয়েক হাজার নয়, কয়েক কোটি বৎসর। তার পর ডারউইন আর ওআলেস প্রচার করলেন, লক্ষ লক্ষ বৎসর ব্যাপী ক্রমিক পরিবর্তনের ফলে পুরাতন জীব থেকে নব নব জীবের উদ্ভব হয়েছে। তখনকার গোঁড়া খ্রীষ্টানরা (মায় বিলাতের প্রধান মন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন) এই মতের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগলেন, কিন্তু তর্কযুদ্ধে পরাস্ত হলেন। আধুনিক গবেষণায় স্থির হয়েছে, পৃথিবীর বয়স কয়েক কোটি নয়, বহু কোটি বৎসর।
আমাদের শাস্ত্রোক্ত সৃষ্টিতত্ত্বের কালপরিমাণ আরও বিপুল। চতুর্যগ = ৪৩ লক্ষ ২০ হাজার বৎসর। এক মন্বন্তর = ৩০ কোটি ৬৭ লক্ষ ২০ হাজার বৎসর। ব্রহ্মার এক অহোরাত্র = ২৮,৮০০ কোটি বৎসর। ব্রহ্মার আয়ু = ১০,৩৬৮র পর ১২ শূন্য দিলে যত হয় তত বৎসর।
প্রচলিত ধারাপাতে সংখ্যার এই তালিকা দেখা যায়–এক, দশ, শত, সহস্র, অযুত, লক্ষ, নিযুত (million), কোটি, অবুদ, বৃন্দ, খর্ব, নিখর্ব, শঙ্খ (billion), পদ্ম, সাগর, অন্ত্য, মধ্য, পরাধ। বৃন্দএর অন্য নাম অজ। Prof N W Pirie, FRS ১৯৫৪ সালে লিখিত Origin of Life প্রবন্ধে অজ শব্দ প্রয়োগ করেছেন।
পরার্ধ মানে ১এর পিঠে ১৭ শূন্য। ছেলেবেলায় আমরা যে ধারাপাত পড়তুম তাতে পরার্ধের পরেও অনেক সংখ্যা ছিল। তাদের নাম ভুলে গেছি, শুধু শেষের দুটি মনে আছে–পার, অপার। আমাদের যিনি অঙ্ক শেখাতেন তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, অপারের পরে কোন্ সংখ্যা? তার বিদ্যা বেশী ছিল না, উত্তর দিলেন, অপার সব চাইতে বড়, তার পরে আর সংখ্যা নেই। আমি বললুম, কেন, অপারের পিঠে তো আরও শূন্য জুড়ে দেওয়া যায়। তিনি বললেন, তাতে তোর লাভটা কি? অপারের বেশী টাকাও তোর হবে না, কইবিচিও হবে না। মাস্টারমশাই রিয়ালিস্ট ছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ-কথিত পিঁপড়ের মতন। চিনির এক কণায় যদি পেট ভরে তবে বস্তার সন্ধান করা বোকামি।
বিজ্ঞানীরা টাকা গোনবার জন্য সংখ্যা চান না, যেসব বৃহৎ বা সূক্ষ্ম বা রাশি রাশি বস্তু নিয়ে তাদের কারবার, তার পরিমাপের জন্যই সংখ্যা দরকার। লক্ষ, কোটি, মিলিয়ন, বিলিয়ন ইত্যাদিতে এখন কাজ চলে না। তারায় তারায় দূরত্ব মাপা হয় আলোকবর্ষ (প্রায় ৬এর পর ১২ শূন্য মাইল), অথবা parsec (প্রায় ১৯ এর পর ১২ শূন্য মাইল) দিয়ে, অতি সূক্ষ্ম বস্তু মাপা হয় Angstrom unit দিয়ে (১ সেন্টিমিটারের ১০ কোটি ভাগের ১ ভাগ)।
খ্যাতনামা গণিতজ্ঞ দার্শনিক A N Whitehead লিখেছেন-Let us grant that the pursuit of mathematics is a divine madness of the human spirit, a refuge from the goading emergency of contingent happenings। অর্থাৎ ধরা যেতে পারে, গণিতের চর্চা এক রকম দিব্যোন্মাদ, ঝঞ্জাট থেকে নিষ্কৃতি পাবার উপায়। হোআইটহেডের যদি ভারতীয় অলংকার শাস্ত্র পড়া থাকত তা হলে হয়তো লিখতেন–গণিতচর্চায় যে আনন্দ লাভ হয় তা ব্রহ্মস্বাদসহোদর।
যাঁরা খাঁটী গাণিতিক তারা সংখ্যা নির্ধারণ করেই খুশী, তা দিয়ে কি মাপা হবে সে চিন্তা তাদের নেই। Edward Kasner একজন বিখ্যাত মার্কিন গণিতজ্ঞ। খেয়ালের বশে একদিন তিনি একটা সংখ্যা স্থির করলেন–১এর পিঠে ১০০ শূন্য। তাঁর ন বছরের ভাইপোকে বললেন, ওরে, একটা নাম বলতে পারিস? ভাইপো বলল, googol। নামটি গ্রীক লাটিন বা ইংরেজী নয়, ছোট ছেলের স্বচ্ছন্দ বালভাষিত, যেমন হাটটিমাটিমটিম। কিন্তু এই গুগল নাম এখন সর্বস্বীকৃত হয়েছে। কাসনার তার ভাইপোকে আবার বললেন, গুগলের চাইতে ঢের বড় একটা সংখ্যা বলতে পারিস? ভাইপো বলল, পারি, একের পিঠে দেদার শূন্য বসিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না হাতে ব্যথা হয়। কাসনার বললেন, তা হলে তো একটা মূর্খ পালোয়ানের কাছে। আইনস্টাইনকে হেরে যেতে হবে, সংখ্যার নির্ধারণ গায়ের জোরে হতে পারে না। তখন ভাইপো চিন্তা করে বলল, একের পিঠে এক গুগল শূন্য, এর নাম হক googolplex। কাসনার বললেন, তথাস্তু, গাণিতিক সমাজও তাই মেনে নিলেন।
আপনি অঙ্কপাত করে অনায়াসে এক গুগল অর্থাৎ ১এর পর ১০০ শূন্য লিখতে পারেন, লাইনটি লম্বায় চার-পাঁচ ইঞ্চির বেশী হবে না। কিন্তু গুগলপ্লেক্স লেখবার চেষ্টা করবেন না, পাগল হয়ে যাবেন। কাগজে কুলোবে না, ঘরেতেও নয়, পৃথিবীতেও নয়, আকাশের অতিদূরস্থ নক্ষত্র পর্যন্ত শূন্যের পর শূন্য বসিয়ে যেতে হবে।
গন্ধর্ব পুষ্পদন্ত যে মহিম্নস্তব রচনা করেছেন তার একটি শ্লোকে আছে–
সমুদ্র যদি মসীপাত্র হয়, তাতে যদি অসিতগিরিসম স্তূপীকৃত কজ্জল গোলা হয়, সুরতরুর শাখা যদি লেখনী হয়, ধরণী যদি পত্র হয় এবং শারদা যদি সর্বকাল লিখতে থাকেন, তথাপি হে মহেশ, তোমার গুণাবলীর পারে পৌঁছতে পারবেন না। পুষ্পদন্ত যদি আধুনিক গণিতের সংখ্যা জানতেন তা হলে সংক্ষেপে বলতে পারতেন, হে মহেশ, তোমার গুণরাশি গুগলপ্লেক্সের চাইতেও বেশী।
সংখ্যাবিশারদরা অনেক রকম অদ্ভুত হিসাব করেছেন। মানবজাতি যখন প্রথম বলতে শিখল তখন থেকে এখন পর্যন্ত মোট কত কথা বলেছে? শিশুর আধ-আধ কথা প্রেমালাপ গালাগালি রাজনীতিক বক্তৃতা ইত্যাদি সব নিয়ে ১এর পিঠে মোটে ১৬টা শূন্য, গুগলের চাইতে ঢের কম।
নোবেল-পুরস্কৃত এডিংটন হিসাব করেছেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত প্রোটন আছে তার সংখ্যা ১৩৬.২x১এর পর ২৫৬ শূন্য। ইলেকট্রনের সংখ্যাও তাই। অর্থাৎ গুগলের চাইতে বেশী কিন্তু গুগলপ্লেক্সের চাইতে কম।
আমাদের গ্যালাক্সি বা ছায়াপথে কত তারা আছে? জ্যোতিষীরা অনুমান করেন, ৩,০০০ কোটি থেকে ১০,০০০ কোটির মধ্যে, অর্থাৎ ৩এর পর ১০ শূন্য এবং ১এর পর ১১ শূন্যর মধ্যে। গুগলের চাইতে ঢের কম।
দাবা খেলার যত চাল হতে পারে তার সংখ্যা কত? আগে ১এর পর ৫৯ শূন্য বসান। যে সংখ্যা পাবেন তত শূন্য ১এর পর বসান। গুগলের চাইতে বেশী কিন্তু গুগলপ্লেক্সের চাইতে কম।
এইবার অতি ক্ষুদ্র রাশি সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বলে এই প্রবন্ধ শেষ করব। আমাদের শাস্ত্রোক্ত অণু-পরমাণু কি বস্তু তা বোঝা যায় না। সংস্কৃত অভিধানে এসরেণুর অর্থ–ছয় পরমাণুর সমষ্টি, অথবা গবাক্ষচ্ছিদ্রাগত রৌদ্রে দৃশ্যমান চঞ্চল সূক্ষ্ম পদার্থ। জীববিজ্ঞানে কীটের চাইতে কীটাণু ছোট, তার চাইতে জীবাণু বা মাইক্রোব ছোট, তার চাইতে ভাইরস ছোট (অণুবীক্ষণে অদৃশ্য)। রসায়নের অণু আরও ছোট, পরমাণু তার চাইতে ছোট, প্রোটন আরও ছোট, ইলেকট্রন সব চাইতে ছোট।
সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মের উত্তম উদাহরণ হোমিওপ্যাথিক ঔষধ। মাদার টিংচারে যে মূল বস্তু থাকে তার ১০ ভাগের ১ ভাগ থাকে প্রথম ডাইলিউশনে। তৃতীয় ডাইলিউশনে ১,০০০ ভাগের ১ ভাগ! দ্বাদশ ডাইলিউশনে লক্ষ কোটি ভাগের ১ ভাগ। শততম ডাইলিউশনে থাকে ১ গুগলের ১ ভাগ। হোমিওপ্যাথরা বলেন, ডাইলিউশন বৃদ্ধিতে ঔষধের পোটেন্সি বৃদ্ধি হয়। অবিশ্বাসীরা বলেন, ১০০ ডাইলিউশনে পৌঁছবার আগেই এমন অবস্থা হয়। যে এক শিশিতে অণু-প্রমাণ ঔষধও থাকে না। বিশ্বাসী বলেন, তোমার অঙ্কশাস্ত্র যাই বলুক, অণু-প্রমাণ ঔষধও থাকুক বা না থাকুক, স্পষ্ট দেখছি উপকার হয়, অতএব তর্ক না করে খেয়ে যাও, বিশ্বাসেই কৃষ্ণলাভ হয়।
অতি সূক্ষ্মের আর একটি উদাহরণ–ব্যাঙের আধুলির গল্প। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কঙ্কাবতীতে তার ভাল বর্ণনা আছে। ব্যাঙ তার বন্ধুকে একটি আধুলি ধার দিয়েছিল। শর্ত এই ছিল যে প্রতি কিস্তিতে অর্ধেক শোধ। করতে হবে। প্রথম কিস্তিতে চার আনা, দ্বিতীয়তে দু আনা, তার পর যথাক্রমে এক আনা, দু পয়সা, এক পয়সা আধা পয়সা ইত্যাদি। ব্যাঙ হিসাব করে দেখল, তার পাওনা কোনও দিন শোধ হবে না, একটু বাকী থাকবেই। সে মনের দুঃখে কাঁদতে লাগল। ব্যাঙ যদি বুদ্ধিমান হত তবে বুঝত যে কয়েক কিস্তি পরেই বাকীর পরিমাণ নগণ্য হয়ে যাবে, অনন্তকাল তাকে অপেক্ষা করতে হবে না।
অন্তরকলন বা differential calculusএর আবিষ্কর্তা লাইবনিৎস সম্বন্ধে একটি গল্প আছে। একদিন তিনি পুশিয়ার রানীকে বললেন, যদি অনুমতি দেন তবে আজ আপনাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র infinitesimal রাশির রহস্য বুঝিয়ে দেব। রানী বললেন, আপনাকে বোঝাতে হবে না, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাকে বলে তা এখানকার এই সভাসদের আচরণ থেকেই আমি টের পাই।
[পরশুরামএর শেষ রচনা–দাঁড়কাগ, ১-৬-১৯৫৯এ লেখা। ১৫-৬এ আর একটি গল্প–জামাইষষ্ঠী–আরম্ভ করেও কোনদিন তা শেষ করেন নি। এর পর প্রায় দশ মাস জীবিত ছিলেন পরশুরাম; কিন্তু তাঁর কুঠার অবনমিত ছিল।
রাজশেখর বসু কিন্তু এই সময়ে পাঁচটি প্রবন্ধ লেখেন। তার কলম থামে মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে–রবীন্দ্রকাব্যবিচার লিখে।
রবীন্দ্ৰশতবর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে, কলকাতা বেতারএর পক্ষে শ্রীঅমল হোমের অনুরোধে এই প্রবন্ধ রচনা আরম্ভ করেন ১৭-৪-১৯৬০এ, তার চিরাচরিত নিয়মে পেনসিলে লিখে; শেষ হয় ২৬ এপ্রিল। (এও তাঁর চিরকালীন অভ্যাস–সব কিছুরই তারিখ লিখে রাখা।) ২৭ এপ্রিল সকালে এর একপাতা ফেআর কপিও করেন। বেলা একটা নাগাদ অকস্মাৎ নিঃশব্দ নিষ্ক্রমণ।
লেখাটা আর হল না–অমল হোমকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু কয়েকমাস পরে কাগজপত্রের মধ্যে এটির আবিষ্কর্তা-রাজশেখরের সব রচনার দিশারী–আমি। রবীন্দ্ৰশতবর্ষে যথাসময়ে এটি কলকাতা বেতারে পঠিত হয়।
এটি পড়ে দশ বৎসর আগে আমার ধারণা হয়েছিল আসন্ন মৃত্যুর আভাস এতে আছে, একটি শৃংখলাবদ্ধ সূচনা মাঝপথে দিশা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লিখেছিলুম–এও কি সেই রাজশেখরীয় সংক্ষিপ্ততা?
আসলে তখনও, পরশুরাম গল্পসমগ্র প্রায় কণ্ঠস্থ করলেও রাজশেখর প্রবন্ধাবলী ক্কচিৎ পড়েছি। আজ সমস্ত পড়ে উপলব্ধি করছি দুজনের রচনার গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। পরশুরামের প্রতিটি গল্পে শেষরক্ষা দৃঢ় শৃংখলিত; রাজশেখর বসুর সব প্রবন্ধে সমগ্র বক্তব্য উপস্থাপনের পরেই আকস্মিক abrupt সমাপ্তি। রবীন্দ্রকাব্যবিচারেও তা স্খলিত হয় নি।
রবীন্দ্রনাথের পরম স্নেহধন্য রাজশেখরের–যার অধিকাংশই আজও সাধারণের অজানা-রবীন্দ্রনাথের প্রতি শেষ ঐহলৌকিক শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে রবীন্দ্রলোকে প্রত্যাবর্তন মোটেই সমাপতন নয়। বোধহয় বহুপূর্বনির্ধারিত ছিল।
–দীপংকর বসু]
স্নেহদ্রব্য
স্নেহদ্রব্য (১৮৮১/১৯৫৯)
বাঙালীর রান্নায় সরষের তেল আর ঘি বহুকাল থেকে চলে আসছে। কুড়ি-পঁচিশ বৎসর আগে পঞ্জাবী আর উত্তরপ্রদেশীকে বলতে শুনেছি, সরষের তেল খেলে পেট জ্বলে যায়, কিন্তু এখন তারাও খেতে আরম্ভ করেছে। গান্ধীজী বলতেন, লংকা আর সরষের তেল বিষবৎ ত্যাজ্য। কিন্তু লংকাখোর দক্ষিণভারতবাসীর জঠর এপর্যন্ত দগ্ধ হয় নি, বাঙালীর জঠরও সরষের তেলে স্নিগ্ধ আছে, যদিও কেউ কেউ বিষাক্ত ভেজাল তেল খেয়ে রোগে পড়েছেন।
বনস্পতি নাম কোন মহাপণ্ডিত চালিয়েছেন জানি না। সরকার এই উৎকট নাম মেনে নিয়েছেন। এর আভিধানিক অর্থ–পুষ্পব্যতিরেকে ফলজনক বৃক্ষ, অশ্বত্থাদি; বৃক্ষ মাত্র (শব্দসার)। হিন্দীতে বনস্পতি মানে উভিদ। যদি সেই অর্থই ধরা হয় তা হলেও উদভিজ্জ তৈলজাত দ্রব্যবিশেষের নাম বনস্পতি হবে কেন? গরু থেকে দুধ হয়, দুধ থেকে ঘি। সে কারণে ঘিকে গরু বলা চলে কি? এই প্রবন্ধে হাইড্রোজেনেটেড অয়েলকে সংক্ষেপে হাইড্রোতেল বলব। বিভিন্ন কারখানায় প্রস্তুত এই দ্রব্য ডালডা, রসোই, কুসুম, পকাও ইত্যাদি নানা নামে বিক্রি হয়।
গত যুদ্ধের আগে ঘি আর সরষের তেলের যে দাম ছিল এখন তার পাঁচ ছ গুণ হয়েছে। হাইড্রোতেল প্রায় পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে বিদেশ থেকে আসতে আরম্ভ করে। প্রথম প্রথম হোটেলের রান্নায়, ময়রার ভিয়ানে, আর ঘিএর ভেজালে চলত, কিন্তু সাধারণ গৃহস্থ তা পছন্দ করত না, যদিও দাম ছিল দশ আনা সেরের কাছাকাছি, অর্থাৎ ঘিএর অর্ধেক। অনেকে মনে করত, বস্তুটি অপকারী, অন্তত তার ফুড-ভ্যালু কিছু নেই। হাইড্রোতেল সম্বন্ধে সাধারণের ভয় ক্রমশ দূর হল, গৃহস্বামীর আপত্তি থাকলেও গৃহিণীরা লুকিয়ে আনাতে লাগলেন। কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের কত্রী আমাকে বলেছিলেন, কি করা যায় বলুন, ছেলেগুলো রাক্ষসের মতন লুচি খাচ্ছে, কাহাতক ঘি যোগান? (ঘি তখন পাঁচ সিকে সের)।
এখন এদেশে প্রচুর হাইড্রোতেল তৈরি হচ্ছে, জনকতকের আপত্তি থাকলেও জনসাধারণ বিনা দ্বিধায় খাচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি এই বস্তুটির বিরুদ্ধে নূতন অভিযোগ উঠেছে, এবং সবিশেষ জানবার জন্য অনেকে আগ্রহী হয়েছেন। এই প্রবন্ধে তেল ঘি হাইড্রোতেল প্রভৃতি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করছি।
স্নেহ (fat)— ইংরেজী ফ্যাট শব্দের অর্থ প্রাণিদেহের চর্বি, কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় মাখন ঘি আর উভিজ্জ তেলও ফ্যাটএর অন্তর্গত। এই ব্যাপক অর্থে ফ্যাট সংজ্ঞার প্রতিশব্দ রূপে অনেকে লেখেন, চর্বি বা চর্বিজাতীয় দ্রব্য। ইংরেজী প্রয়োগের অন্ধ অনুকরণে সরষে তিল ইত্যাদির তেলকে চর্বি বললে আমাদের সংস্কারের উপর পীড়ন হয়। বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গে ফ্যাটএর প্রতিশব্দ স্নেহ বা স্নেহদ্রব্য লেখাই ভাল, তাতে ভুল বোঝবার সম্ভাবনা থাকবে না।
স্নেহাম্ল (fatty acid)— স্নেহ শব্দের এক অর্থ স্নিগ্ধতা, চিক্কণতা, বা তেলা ভাব। ভ্যাসেলিন, লুব্রিকেটিং অয়েল প্রভৃতিও চিক্কণ, কিন্তু তাদের রাসায়নিক গঠন স্নেহ বা ফ্যাটের তুল্য নয়। স্নেহ মাত্রেরই প্রধান উপাদান গ্লিসারিন এবং কয়েক প্রকার স্নেহাম্ল বা ফ্যাটি অ্যাসিড। রসায়ন শাস্ত্রে যাকে অম্ল বা অ্যাসিড বলা হয় তার স্বাদ টক নাও হতে পারে। অধিকাংশ স্নেহাম্ল টক নয়।
অপূরিত (unsaturated) ও প্রপূরিত (saturated)— প্রত্যেক স্নেহাম্লের অণুতে কতকগুলি কার্বন হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের পরমাণু থাকে। এই সব পরমাণুর বিন্যাস ও সংখ্যা এক-এক স্নেহাম্নে এক-এক প্রকার। এক শ্রেণীর স্নেহাম্লে আরও হাইড্রোজেন পরমাণু জুড়ে দিতে পারা যায়, অপর শ্রেণীতে তা পারা যায় না। প্রথম শ্রেণীকে বলা হয় অপূরিত (অনসাটুরেটেড), অর্থাৎ যতটা হাইড্রোজেন থাকতে পারে ততটা নেই, হাইড্রোজেনের কিছু আসন খালি আছে। অপর শ্রেণীর স্নেহাম্লকে বলা হয় প্রপূরিত (সাটুরেটেড), অর্থাৎ এগুলিতে পূর্ণমাত্রায় হাইড্রোজেন আছে, আসন খালি নেই।
বিভিন্ন তেলে আর ঘিএ যে স্নেহাম্ল থাকে তার মধ্যে অপূরিত আর প্রপূরিতর শতকরা হার মোটামুটি এই রকম–
অপূরিত—প্রপূরিত
সরষের তেল—৫০—৫০
তিল তেল—৮৫—১৫
চীনাবাদাম তেল—৭৫-৮৭—২৫-১৩
নারকেল তেল—২—৯৮
ঘি (গাওয়া ভঁয়সার কিছু তারতম্য আছে)—২৯—৭১
সরষে তিল আর চীনাবাদাম তেলে অপূরিত স্নেহাম্ল প্রচুর আছে, এই সব তেল শীতকালেও তরল থাকে। নারকেল তেল আর ঘিএ প্রপূরিত বেশী, ঠাণ্ডায় জমে যায়।
রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন সংযোগ করলে অপূরিত স্নেহা প্রপূরিত হয়ে যায়, তার ফলে তরল তেল গাঢ় হয়। যোজিত হাইড্রোজেনের মাত্রা অনুসারে তেলের রূপ ঘিএর মতন নরম, ছাগল-ভেড়ার চর্বির মতন জমাট বা মোমের মতন শক্ত করা যায়। এদেশে ৯ ভাগ চীনাবাদাম তেলে ১ ভাগ তিল তেল মিশিয়ে তাই থেকে হাইড্রোতেল তৈরি হয়, কিন্তু সবগুলির গাঢ়তা সমান নয়। হাইড্রোতেলের কথা পরে হবে, এখন সাধারণ তেলের কথা বলছি।
কোন্ তেল ভাল?
ভারতের অনেক প্রদেশে তিল আর চীনাবাদাম তেলে রান্না হয়, দক্ষিণ ভারতে নারকেল তেলও চলে। বাঙালী সহজে অভ্যাস বদলাতে পারে না। বার-তের বৎসর আগে যখন সরষের তেল খুব দুষ্প্রাপ্য হয়েছিল তখন অনেকে জেনে শুনে ভেজাল তেল কিনত, কিন্তু তিল বা চীনাবাদাম তেল ছুঁত না। প্রচলিত তেলের মধ্যে কোটি বেশী হজম হয় বা বেশী পুষ্টিকর তার পরীক্ষা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ পর্যন্ত হয় নি, অতএব নিশ্চয় করে কিছু বলা যায় না। আয়ুর্বেদে তিল তৈলের বহু প্রশংসা আছে, তৈল শব্দের ব্যুৎপত্তি অর্থই তিলজাত (যেমন oilএর মৌলিক অর্থ olive-জাত)। সরষে তিল আর চীনাবাদাম তিন রকম তেলই অনেক কাল থেকে ভারতবাসীর রান্নায় চলছে, তাতে স্বাস্থ্যহানি হয়েছে এমন শোনা যায় নি। অতএব ধরা যেতে পারে যে তিনটি তেলই সুপাচ্য। অবশ্য এমন লোক আছে যার পেটে এক রকম তেল সয় কিন্তু অন্য রকম তেল সয় না, কিংবা ঘি সয় কিন্তু কোনও তেল সয় না। সব রকম তেলের চাইতে ঘি বেশী পাচ্য আর পুষ্টিকর, এ বিষয়ে মতভেদ নেই।
খাদ্যের রাসায়নিক গঠনের সঙ্গে তার পাচ্যতা আর পুষ্টিকরতার সম্বন্ধ আছে, কিন্তু সেই সম্বন্ধ সকল ক্ষেত্রে সুনিণীত হয় নি। মোটামুটি দেখা যায়, স্নেহদ্রব্যের মধ্যে যেগুলি তরল এবং যাতে অপূরিত স্নেহা বেশী, সেইগুলিই সহজে জীর্ণ হয়। ঘিএ প্রপূরিত স্নেহা বেশী থাকলেও তার লঘু গঠনের জন্য সুপাচ্য। তা ছাড়া ঘিএ ভাইটামিন এ আর ডি আছে, তেলে নেই। নারকেল তেলে প্রপূরিত স্নেহা খুব বেশী, কিন্তু তার কতকটা ঘিএর তুল্য।
পূর্বোক্ত তালিকায় বিভিন্ন তেলের যে স্নেহা দেখানো হয়েছে তাতে তিল তেলে অপূরিত স্নেহাম্ল সব চাইতে বেশী আর প্রপূরিত কম। এই কারণে অন্য তেলের তুলনায় সম্ভবত তিল তেল পাচ্যতায় শ্রেষ্ঠ, তার পরেই চীনাবাদাম তেল।
খাদ্যদ্রব্য ভাজবার সময় তেল ঘি তপ্ত করতে হয়। বেশী তাপে সব। স্নেহদ্রব্যই বিকৃত হয় বা পুড়ে যায়, কিন্তু তেল যত আঁচ সইতে পারে, ঘি তত পারে না। সেজন্য প্রবাদ–তেল পুড়লে ঘি, ঘি পুড়লে ছাই। ঘি বেশী পুষ্টিকর হলেও ভাজবার পক্ষে তেলই ভাল, যদিও ঘি ভাজা তপ্ত লুচির খ্যাতি বেশী। চর্বি আর হাইড্রোতেলও বেশী আঁচ সইতে পারে।
ভাজবার সময় তেল-ঘিএর কিছু অংশ বাম্পাকারে উবে যায়। ঘিএ সব চাইতে বেশী যায়, তিল তেলে আর নারকেল তেলে একটু কম, সরষে আর চীনাবাদাম তেলে আরও কম। এই কারণে ভাজবার পক্ষে সরষে আর চীনাবাদাম তেল শ্রেষ্ঠ। সরষের তেলের দুর্লভতার সময় আমি তিন-চার মাস তিল তেল চালিয়েছিলাম, তার ফলে রান্নাঘরের দেওয়াল তৈলাক্ত হয়ে যায়।
খাদ্য সম্বন্ধে অকারণ পক্ষপাত বা বিদ্বেষ ভাল নয়। পশ্চিম বাংলার খাদ্যসংকটের একটি কারণ–রুটিতে আপত্তি আর ভাতে অত্যাসক্তি। যে সব খাদ্য অন্য প্রদেশে খুব চলে তা বাঙালীরও অভ্যাস করা উচিত। প্রত্যেক তেলেরই বিশিষ্ট গন্ধ আছে। সরষের তেল না হলে চলবে না, অন্য তেলের গন্ধ খারাপ, এমন মনোভাব ক্ষতিকর। অভ্যাস করলে তিল আর চীনাবাদাম তেলেও রুচি হবে।
হাইড্রোতেল
ঘিএর উপর ভারতবাসীর যে আসক্তি আছে তা অন্যায় নয়, কারণ অন্য স্নেহদ্রব্যের চাইতে ঘিএর পুষ্টিকরতা বেশী। জল আর বাতাসের সংস্পর্শে, পুরনো হলে, এবং বার বার তপ্ত করলে ঘি আর তেল বিকৃত হয়। ঘিএর উপর সাধারণের পক্ষপাত আছে, তাই খারাপ ঘি দিয়ে তৈরি খাবারে একটু দুর্গন্ধ থাকলে লোকে গ্রাহ্য করে না, বরং সেই গন্ধকেই ঘৃতপক্কতার প্রমাণ মনে করে। ঘি আভিজাত্যের লক্ষণ, মান্য কুটুম্ব বা অতিথিকে তেলে ভাজা খাবার দেওয়া যায় না। খাঁটী ঘি দুর্মূল্য হলে লোকে সজ্ঞানে বা অজ্ঞাতসারে সস্তা ভেজাল দেওয়া ঘি কেনে। ঘিএর কৃত্রিম এসেন্স বাজারে পাওয়া যায়, হাইড্রোতেলে অল্প একটু দিলে পচা ঘিএর মতন গন্ধ হয়। অনেক দোকানের বিশুদ্ধ ঘৃতের খাবার এই নকল ঘি তৈরি হয়। গৃহস্থের যে চক্ষুলজ্জা আগে ছিল এখন তা দূর হয়েছে, নকল ঘি কিনে আত্মবঞ্চনা বা অতিথিবঞ্চনার দরকার হয় না, খোলাখুলি হাইড্রোতেলে রান্না হয়। তেলে ভাজা খাবারে যে গন্ধ হয় তা হাইড্রোতেলের খাবারে থাকে না, সেজন্য ঘৃতপকের বিকল্পরূপে হাইড্রোতেলপক্ক খাবার অবাধে চলে।
হাইড্রোতেলে ঘি-ব্যবসায়ীর ক্ষতি
অনেকে বলেন, হাইড্রোতেলে ঘিএর সর্বনাশ হচ্ছে, এর উৎপাদন একেবারে বন্ধ না করলে ঘি লোপ পাবে। এই অভিযোগ যুক্তিসঙ্গত নয়। চল্লিশ বৎসর আগে হাইড্রোতেল ছিল না, তখন ঘিএ চর্বি চীনাবাদাম তেলের ভেজাল দেওয়া হত। ভাল চর্বির গন্ধ অনেকটা ভঁয়সা ঘিএর মতন, তাই ভেজাল ধরা সাধারণের অসাধ্য ছিল। হাইড্রোতেল তুলে দিলে আবার চর্বি চলবে। ঘি-ব্যবসায়ীর যে অসুবিধা হয়েছে তার প্রকৃত কারণ হিন্দু জনসাধারণ চোখ বুজে চর্বি-মিশ্রিত ভেজাল ঘি খেলেও শুধু চর্বি খেতে রাজী নয়, কিন্তু শুধু হাইড্রোতেল খেতে তার আপত্তি নেই। সেকালে খাঁটী আর ভেজাল ঘিএর একাধিপত্য ছিল, তাই ঘিএর ব্যবসা ভাল চলত। কিন্তু এখন হাইড্রোতেল প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছে। হাইড্রোতেল তুলে দিলে চর্বি-মিশ্রিত ভেজাল ঘিএর বিক্রি খুব বেড়ে যাবে, খাঁটী ঘিএর দাম চড়বে।
ভারতবর্ষ ভেজালের জন্য কুখ্যাত। আমাদের ব্যবসায়ীদের মধ্যে অসংখ্য অসাধু আছে, জনসাধারণও নিশ্চেষ্ট। বাজারের ঘি আর তেলে প্রচুর ভেজাল চলে, বিদেশ থেকে ঘি আর সরষের তেলের কৃত্রিম এসেন্স অবাধে আমদানি হয়। আমাদের সরকার ছোটখাট ভেজালদারদের সাজা দেন কিন্তু বড়দের পরিহার করেন। যেমন, বেরাল নেংটি ইঁদুর ধরে কিন্তু ড্রেনবাসী বড় ইঁদুর দেখলে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দেয়।
সরকারী নিয়ম অনুসারে হাইড্রোতেলে কিছু তিল তেল দেওয়া হয়। রাসায়নিক পরীক্ষায় তিল তেল সহজেই ধরা যায়, সেজন্য ঘিএ হাইড্রোতেল থাকলে তিল তেলের জন্যই ভেজাল ধরা পড়ে। কিন্তু রাসায়নিক পরীক্ষা সাধারণের সাধ্য নয়, সেজন্য প্রস্তাব হয়েছে, হাইড্রোতেলে এমন রঙ দেওয়া হক যাতে ঘি মেশালে রঙ দেখেই লোকে ভেজাল বুঝতে পারে। এই প্রস্তাব একেবারে নিরর্থক। হাইড্রোতেলে যদি প্রচুর রঙ থাকে তবেই ঘিএ তার ভেজাল ধরা পড়বে। কিন্তু লাল নীল সবুজ ব্রাউন ইত্যাদি রঙের হাইড্রোতেল তৈরি করা বৃথা, কেউ তা কিনবে না।
হাইড্রোতেলের দোষ
হাইড্রোতেলে প্রপূরিত গাঢ় স্নেহাম্ল বেশী, সেজন্য তার কতকটা হজম হয় না, মলের সঙ্গে বেরিয়ে যায়। এই কারণে খাদ্য হিসাবে তেলের চাইতে হাইড্রোতেল নিকৃষ্ট।
শারীরবিজ্ঞানী আর স্বাস্থ্যবিশারদগণ মাঝে মাঝে এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন যাতে লোকে উদবিগ্ন হয়। কয়েক বৎসর থেকে তারা প্রচার করছেন সিগারেটখোরদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসার বেশী দেখা যায়। সিগারেট ব্যবসায়ীরা এই মত খণ্ডনের জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন, নামজাদা ডাক্তারদের দিয়ে প্রতিবাদও প্রচার করাচ্ছেন, তথাপি সিগারেটের অনিষ্ট করতা এখন প্রায় সর্বস্বীকৃত হয়েছে। এই বিষয় নিয়ে সাধারণ লোকেও খুব জল্পনা করছে, কিন্তু সিগারেটের কাটতি এখন পর্যন্ত কিছুমাত্র কমে নি। লোকের মনোভাব বোধ হয় এই হুজুকে পড়ে নেশা ছাড়তে পারব না, ক্যানসার যখন হবে তখন দেখা যাবে। সম্প্রতি শারীরবিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্ত করেছেন, স্নেহদ্রব্যে যদি প্রপূরিত স্নেহা থাকে তবে তা বেশী খেলে রক্তে কোলেস্টেরল নামক পদার্থ উৎপন্ন হয়, তার ফলে থ্রম্বোসিস হতে পারে। হাইড্রোতেলে প্রপূরিত স্নেহাম্ন বেশী, সেজন্য এসব জিনিস খেলে থ্রম্বোসিসের সম্ভাবনা বাড়ে। মাখন আর ঘিও নিরাপদ নয়, কারণ তাতেও প্রপূরিত স্নেহা আছে। অতএব তরল তেল খাওয়াই সব চেয়ে ভাল।
ঘিএর অনুকল্প
এদেশে যেমন ঘিএর, পাশ্চাত্ত্য দেশে তেমনি মাখনের আদর। মাখন দুর্মূল্য, সেজন্য দরিদ্রের জন্য মাখনের অনুকল্প মার্গারিনএর প্রচলন হয়েছে। ঘিএরও একটা অনুকল্প দরকার। মার্গারিন দেখতে মাখনের মতন হলেও উপাদান মাখনের সমান নয়, কিন্তু সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। আমাদের দেশে ঘিএর যে অনুকল্প হবে তারও উপাদান আর লক্ষণ নিয়ন্ত্রিত হওয়া দরকার। হাইড্রোতেলে প্রপূরিত স্নেহা যদি খুব কমানো হয়, অর্থাৎ চীনাবাদাম তেলে যদি বেশী হাইড্রোজেন সংযোগ নিষিদ্ধ হয় তবে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা কমবে। এ রকম হাইড্রোতেল হয়তো খুব নরম হবে, গ্রীষ্মকালে তেলের মতন তরল থাকবে, কিন্তু নিরাপত্তার জন্য তাই চালাতে হবে। সরকার স্বয়ং উদযোগী হয়ে কিছু করবেন মনে হয় না, কিন্তু জনমত যদি প্রবল হয়, তবে আইন করতে বাধ্য হবেন।
এক বিষয়ে চর্বি আর গাঢ় হাইড্রোতেল ঘি আর তরল তেলের চাইতে শ্রেষ্ঠ। বিস্কুটে ঘি বা তেলের ময়ান দিলে চলে না। পূর্বে দেশী বিলাতী সব বিস্কুটেই চর্বির ময়ান চলত, এখন হাইড্রোতেল দেওয়া হয়। রান্নার হাইড্রোতেল যদি পাতলা করা হয় বিস্কুটওয়ালাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে।
বাজারে প্রায় গন্ধহীন ও বর্ণহীন চীনাবাদাম তেল পাওয়া যায়, তার দাম সাধারণ তেলের চাইতে বেশী, কিন্তু হাইড্রোতেলের চাইতে কম। অনেক গুজরাটী আর মারোয়াড়ী খাবারওয়ালা তা ঘিএর বদলে ব্যবহার করে। এই deodorized decolorized তেলে হাইড্রোজেন যোগ করা হয় না, তেলের স্বাভাবিক স্নেহাই বজায় থাকে। বাঙালী গৃহস্থ এই তেল ঘিএর অনুকল্পরূপে ব্যবহার করে দেখতে পারেন।