.
কালিদাস নারীর অশিক্ষিতপটুত্বের উল্লেখ করেছেন। তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন বঙ্গনারীর পরিচ্ছদ। বাঙালী পুরুষ অনুকরণে পটু, এককালে মোগলাই সাজের নকল করেছিল, তার পর ইওরোপীয় পোশাকও নিয়েছে। কিন্তু বাঙালী মেয়ে তার স্বাতন্ত্র্য হারায় নি। কবিকঙ্কণ চণ্ডীর যুগে সে কাছা দিয়ে শাড়ি পরত, কবি হেমচন্দ্রের আমলে লাজে অবনতমুখী তনুখানি আবরি জুজুবুড়ী সেজে থাকত। কিন্তু আধুনিকা বাঙালিনী সুপর্ণা বিহঙ্গীর ন্যায় শোভনচ্ছদা হয়েছে, চিরন্তন পরিচ্ছদ বজায় রেখেও স্বাস্থ্যের অনুকূল সুরুচিসম্মত সুদৃশ্য সজ্জা উদ্ভাবন করেছে। দেশে বিদেশে শাড়ি অজস্র প্রশংসা পেয়েছে। যেসব ভারত-ললনা আঠারো-হাতি শাড়ি কাছা দিয়ে পরে এবং যারা সালোআর-কমীজ-দোপাট্টায় অভ্যস্ত তারাও ক্রমশ বাঙালিনীর অনুসরণ করছে।
কিন্তু একটা কথা ভাববার আছে। শাড়ি-ব্লাউজ ঘরে বাইরে সুশোভন পরিচ্ছদ, কিন্তু আজকাল অনেক মেয়ে শিক্ষা বা জীবিকার জন্য যে ধরনের কাজ করে তার পক্ষে শাড়ি সকল ক্ষেত্রে উপযুক্ত নাও হতে পারে। যান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক আর চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে শাড়ির আঁচল একটা বাধা, বিপদের কারণও হতে পারে। সুবিধা আর নিরাপত্তার জন্য বোধ হয় ক্ষেত্র বিশেষে শাড়ির বদলে স্কার্ট বা স্ন্যাস জাতীয় পরিধেয়ই বেশী উপযুক্ত।
আমিষ নিরামিষ
আমিষ নিরামিষ (১৮৭৯/১৯৫৭)
মথুর মুখুজ্যে সকালবেলা পার্কে বেড়াচ্ছিলেন, হঠাৎ তাঁর বাল্যবন্ধু অঘোর দত্তর সঙ্গে অনেক দিন পরে দেখা হয়ে গেল। দুজনে একটা বেঞ্চিতে বসলেন। মথুরবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, তার পর, আছ কেমন? বয়স কত হল?
অঘোর দত্ত বললেন, ভাল মন্দ মিশিয়ে আছি, নালিশ করবার কিছু নেই। বয়স প্রায় আটাত্তর হল।
মথুর। আমার পঁচাত্তর, কিন্তু ভাল নই দাদা। বাত হাঁপানি ডিসপেপসিয়া, নানানখানা। আচ্ছা তুমি তো নিরামিষ খাও। কত দিন খাচ্ছ?
অঘোর। তা ষাট-পঁয়ষট্টি বৎসর, ছেলেবেলা থেকেই।
মথুর। বল কি হে! সেই জন্যই এখন পর্যন্ত বেশ আছ। আমিও ভাবছি মাছ মাংস ছেড়ে দেব। আর কেন, ঢের খেয়েছি, শেষ বয়সে সাত্ত্বিক আহারই ভাল। নিরামিষভোজীরা দীর্ঘজীবী হয়, আনি বেসান্ট, বার্নার্ড শ, গান্ধীজী
অঘোর। ভুল করলে ভাই। আমিষ খেয়েও বিস্তর লোক আশি পেরিয়ে বেঁচে আছেন, যেমন চার্চিল, ফজলুল হক, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ। যোগেশ বিদ্যানিধি মশাই তো ছেয়ানব্বই পার হয়ে বার্নার্ড শকেও হারিয়ে দিয়েছেন।
এমন সময় ফণী মল্লিক এসে পড়লেন। এঁর বয়স প্রায় ষাট, বহু কাল আগে একবার বিলাত গিয়েছিলেন, তার লক্ষণ সাজে আর চালচলনে এখনও কিছু দেখা যায়। মথুরবাবু বললেন, আসতে আজ্ঞা হক মল্লিক সায়েব, বসুন এইখানে। এই অঘোর দত্তকে চেনেন তো? অদ্ভুত মানুষ, পঁয়ষট্টি বৎসর নিরামিষ খেয়ে বেঁচে আছেন। আচ্ছা মল্লিক মশাই, আপনি তো বিচক্ষণ জ্ঞানী লোক, আমিষ নিরামিষ আহার সম্বন্ধে আপনার মত কি?
ফণী মল্লিক বললেন, প্রচুর আমিষ খাওয়া উচিত, আমিষের অভাবেই হিন্দু জাতির অধঃপতন হয়েছে।
মথুর। আচ্ছা অঘোর, তোমার তো কোনও কালেই ধর্মে তেমন মতি দেখি নি। তবে মাছ মাংস খাও না কি কারণে?
অঘোর। যে কারণে তুমি সাপ ব্যাঙ খাও না।
মথুর। ও একটা বাজে কথা। যদি বলতে অহিংসার জন্য বা স্বাস্থ্যের জন্য খাও না, কিংবা শাস্ত্রমতে প্রশস্ত নয় তাই খাও না তা হলে বুঝতাম।
অঘোর। আমরা যা করি সব কিছুরই কি কারণ বলা যায়? যা বলেছি। তার সোজা অর্থ–তোমার যেমন সাপ ব্যাঙে রুচি হয় না আমার তেমনি মাছ মাংসে হয় না। যদি জেরা কর কেন রুচি হয় না, তবে ঠিক উত্তর দিতে পারব না। হয়তো পাকযন্ত্রের গড়ন এমন যে আমিষ সয় না কিংবা পুষ্টির জন্য দরকার হয় না। হয়তো ছেলেবেলায় এমন পরিবেশে ছিলাম বা এমন কিছু দেখেছিলাম শুনেছিলাম বা পড়েছিলাম যার প্রভাব স্থায়ী হয়ে আছে। যদি নিরামিষ সহ্য না হত তবে নিশ্চয় আমিষ ধরতাম, যেমন অক্ষয়কুমার দত্ত শেষ বয়সে রোগে পড়ে ধরেছিলেন। আমি কিন্তু পুরোপুরি ভেজিটেরিয়ন নই। দুধ খাই, যা হচ্ছে খাঁটী গোরস, আর মাঝে মাঝে চিকিৎসার জন্য জান্তব ঔষধও খেতে বা ইনজেকশন নিতে হয়েছে।*
ফণী মল্লিক সহাস্যে বললেন, হ্, এইবার পথে আসুন। এক মার্কিন ভদ্রলোক এচ জি ওয়েল্সকে বলেছিলেন, আপনাদের বার্নার্ড শ একজন ক্ষণজন্মা জ্ঞানী সাধুপুরুষ, নিরামিষ খেয়েই এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মস্তিষ্ক চালনা করছেন। ওয়েল্স হেসে বললেন, নিরামিষ না ছাই। দুধ খাচ্ছেন, চীজ খাচ্ছেন, ডিম খাচ্ছেন, আবার প্রতিদিন লিভার এক্সট্রাক্ট ইনজেকশন নিচ্ছেন, যা হল রক্তমাংসের সারাৎসার। শুনুন মথুরবাবু, মাছ মাংস ডিম খেলে যত সহজে পুষ্টি আর শক্তিলাভ হয়, তেমন আর কিছুতে হয় না। জনকতক ভাত ডাল শাগ তরকারি খেয়ে দীর্ঘজীবী হতে পারে, কিন্তু অ্যাভারেজ লোকের পক্ষে আমিষ বর্জন অনিষ্টকর। যার প্রচুর দুধ ক্ষীর ছানা খাবার সামর্থ্য আছে তার হয়তো চলে যেতে পারে, কিন্তু সকলের পক্ষে আর সকল জায়গায় তা সুলভ নয়।
মথুর। কিন্তু শুনেছি মাংস খেলে হিংসাবৃত্তি প্রবল হয়। এই দেখুন না, এদেশে যারা মাংসখোর তারাই দাঙ্গাবাজ আর একটুতে ছোরা মারে।
ফণী। মারবেই তো, অন্য পক্ষ যে নিস্তেজ ভীরু। মুখুজ্যে মশাই, আমাদের যে মাইল্ড হিন্দু বলে খ্যাতি আছে তা মোটেই গৌরবের নয়। আমাদের একটু উগ্র হওয়া দরকার। ভারতীয় আর্যজাতির ইতিহাস দেখুন। রাম লক্ষ্মণ সীতা বনে গিয়ে মাংস খেয়েই জীবনধারণ করতেন। চিত্রকূট আর দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে চাল ডাল আটা পাবেন কোথা? পেলে অবশ্য ফলমূলও খেতেন, কিন্তু সেটা তাদের প্রধান খাদ্য ছিল না, শুধু ভাইটামিন-সিএর জন্য খেতেন। বনবাসী পাণ্ডবরাও তাই করতেন। তারা এত হরিণ মারতেন যে সেখানকার ঋষিরা তাদের অন্যত্র চলে যেতে বলেছিলেন। আমাদের মাংসাশী পূর্বপুরুষরা তেজস্বী মহাবীর যুদ্ধবিশারদ ছিলেন, আবার বেদ-বেদান্তও রচনা করেছেন। তাদের বংশধররা বৌদ্ধ আর জৈনদের নকলে নিরামিষভোজী হয়েই অধঃপাতে গেছে।