একালের ভাইস-চানসেলর (বিশেষত বিশ্বভারতীর তুল্য আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের) সেকালের কুলপতিরই সমপর্যায়ের। অধিপাল উপাধিতে তার অধিনায়কত্ব ও পদোচিত গৌরব সূচিত হয়। চানসেলরকে আচার্য আখ্যা না দিয়ে মহাধিপাল বললে তারও যথোচিত মর্যাদা বজায় থাকে।
[* কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিযুক্ত সমিতির মতন এটিরও সভাপতি ছিলেন–রাজশেখর বসু।–স:।]
আমাদের পরিচ্ছদ
আমাদের পরিচ্ছদ (১৮৭৮/১৯৫৬)
সম্প্রতি জওহরলাল নেহরু এক বক্তৃতায় বলেছেন, ইওরোপীয় পোশাকের উপর এ দেশের লোকের অত্যন্ত ঝোঁক তিনি পছন্দ করেন না। কি রকম সাজ ভারতবাসীর উপযুক্ত তা তিনি খোলসা করে বলেন নি। কয়েক বৎসর পূর্বে যখন তিনি ইংলান্ডে গিয়েছিলেন তখন কাগজে তার হ্যাট কোট টাই ট্রাউজার পরা ছবি বেরিয়েছিল। সম্প্রতি আমেরিকা ভ্রমণের ছবিতে তাঁর পরনে লংকোট টাই আর গান্ধীটুপি দেখা গেছে। ভারতবর্ষে তিনি চুড়িদার পাজামা আচকান আর গান্ধীটুপি পরে থাকেন। অতএব ধরে নিতে পারি সর্বাবস্থায় সাহেব সেজে থাকাই তার অপছন্দ; ক্ষেত্র বিশেষে বিলাতী বা দেশী-বিলাতীর মিশ্র পোশাকে তার সম্মতি আছে।
হিন্দীতে একটা প্রবাদ আছে যার মানে নিজের রুচিতে খাবে আর পরের রুচিতে পরবে। নিজের রুচিতে সাজতে গেলে বাধা পাওয়া যায় তা আমি দেখেছি। একবার দরজীকে ফরমাশ করেছিলাম–আমার যে পঞ্জাবি করবে তার বুকের উপর বাঁ দিকে একটা মামুলী পকেট হবে, আর ভিতরে ডান দিকে আর একটা পকেট হবে; বাঁ দিকের পকেট বাইরে, আর ডান দিকেরটা ভিতরে। বুঝেছ? দরজী বলল, আজ্ঞে ঠিক বুঝেছি। যখন জামা তৈরি হয়ে এল তখন দেখলাম দুটো পকেটই বাঁ দিকে, একটা বাইরে আর একটা ঠিক তার পিছনে ভিতর দিকে। বললাম, এ কি করেছ মিয়া? মিয়া উত্তর দিল, দুটো দু দিকে থাকলে যে বেপ্যাটান হবে বাবু, তা তো দস্তুর নয়। দরজী নিষ্ঠাবান লোক, দস্তুর ভঙ্গের পাতক থেকে আমাকে রক্ষার জন্য নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছিল। আর একবার পঞ্জাবির ফরমাশ দিয়েছিলাম যার বুক কোটের মতন সবটা খোলা যায়। দরজী এবারে আমার অনুরোধ রেখেছিল। কিন্তু শুভানুধ্যায়ী বন্ধুরা বলল, এ কি রকম বেয়াড়া জামা! এ যে কোটজাবি, না কোট না পঞ্জাবি, ফেলে দাও এটা। আমি ফেলি নি, দু-তিন জন আমার দেখাদেখি কোটজাবি বানিয়েছিল।
.
সমস্ত ভারতের স্ত্রীপুরুষের পরিচ্ছদের আলোচনা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য চলচ্চিন্তা নয়, কেবল বাঙালী হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কথাই বলব, প্রথমে পুরুষের, শেষে মেয়ের। পরিচ্ছদ সম্বন্ধে আমাদের রুচি তিন কারণে প্রভাবিত হয়– (১) গতানুগতিক রীতি, (২) সাময়িক ফ্যাশন হুজুক বা বিখ্যাত লোকের আদর্শ এবং (৩) স্বাস্থ্য স্বাচ্ছন্দ্য বা সুবিধার জ্ঞান। তা ছাড়া আর্থিক কারণ বা সুলভতা দুর্লভতা তো আছেই।
গতানুগতিক রীতি কালক্রমে বদলায়। আমার শৈশবে অর্থাৎ প্রায় সত্তর বৎসর আগে সাধারণ ভদ্র বাঙালীর পরিচ্ছদ ছিল ধুতি পিরান চাদর আর বিলাতী গড়নের জুতো (শু বা পম্প)। পিরানের আকার আধুনিক পঞ্জাবির মতন, কিন্তু ঝুল কম। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতরা পরতেন ধুতি, কোরতা বা খাটো আঙরাখা, চাদর আর চটি, অনেক সময় শুধু ধুতি চাদর চটি। কোরতায় বোতামের বদলে ফিতা থাকত, ঝুল কোমর পর্যন্ত। খাটো আঙরাখার গড়ন চাপকানের মতন কিন্তু ঝুল নিতম্ব পর্যন্ত। কীর্তন-গায়করা এখনও কোরতা পরে থাকেন। গেঞ্জির চলন ৬০৭০ বৎসর আগে হয়। সেকালে নাম ছিল। গেঞ্জিফ্রক। ইংলান্ড আর ফ্রান্সের মাঝে যেসব দ্বীপ আছে তার একটার নাম। Guernsey আর একটার Jersey। তা থেকেই জামার নাম গেঞ্জি আর জার্সি হয়েছে।
বিলাতফেরতরা তখন সর্বদা সাহেবী পোশাক পরতেন, সুরেন বাড়জ্যে এবং আরও দু-চার জন ছাড়া। উকিল ডেপুটি সবজজ আর বড় কর্মচারীরা ইজার চাপকানের উপর চোগা বা পাকানো চাদর পরতেন, মাথায় শামলা বা পিরালী পাগড়ি দিতেন। রবীন্দ্রনাথের চোখের বালিতে আছে, মহেন্দ্র চাপকান পরে মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে যেত। শীতকালে অবশ্য সকলেরই পোশাকের পরিবর্তন হত, মধ্যবিত্তরা ধুতির উপর গরম কোট এবং র্যাপার বা শাল পরতেন। অল্প কয়েক জন অতি সেকেলে লোক পারসী কোট (ঝুল প্রায় হাঁটু পর্যন্ত) আর চায়না কোট (গলায় কলার নেই, ঢিলা গড়ন) পরতেন।
প্রায় ষাট বৎসর আগে অল্পবয়স্কদের মধ্যে পিরানের বদলে শার্টের প্রচলন হল। শার্টের উপর চাদর বা উড়নি ইচ্ছাধীন, কিন্তু কলকাতার যুবসমাজে কোটের উপর চাদর পরা বাঙাল বা খোট্টা-বাঙালীর লক্ষণ গণ্য হত। ক্রমশ শিক্ষিত লোকের অনেকের হুঁশ হল, শার্ট হচ্ছে সাহেবদের অন্তরীয়, কোটের নীচে পরবার। তখন তার বদলে এল পঞ্জাবি, অর্থাৎ বেশী ঝুলওয়ালা পিরান। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালীর সাজ নিরূপিত হয়ে গেল– ধুতি আর পঞ্জাবি, তার উপর চাদর ইচ্ছাধীন। ধুতি-চাদর আমাদের বহু প্রাচীন পরিধেয়, কিন্তু পঞ্জাবি নামেই বোঝা যায় এটি খাঁটি বাঙলা দেশের জিনিস নয়। পিরান শার্ট আর পঞ্জাব অঞ্চলের আজানুলম্বিত কমীজ-এর মিশ্রণে পঞ্জাবি নামক জামার উৎপত্তি হয়েছে। ১৯২০-৩০ নাগাদ চাপকান চোগা শামলা পাগড়ি লোপ পেতে লাগল এবং সাহেবী সাজই সম্ভ্রান্ত পোশাক গণ্য হল, কিন্তু হ্যাট বহুপ্রচলিত হয় নি।