নরমান বিজয়ের পর ইংলান্ডের এবং মুসলমান বিজয়ের পর মিসর। পারস্য প্রভৃতির সর্বাঙ্গীণ পরাধীনতা ঘটেছিল এবং মিশ্রণের ফলে কয়েক শ বৎসরের মধ্যে তা তিরোহিত হয়েছিল। কিন্তু ভারতের পরাধীনতা আংশিক, অর্থাৎ শুধু রাজনীতিক, অত্যাচারিত হয়েও দেশের অধিকাংশ লোক তাদের ধর্মগত আর সমাজগত স্বাতন্ত্র রক্ষা করেছিল। বহুবর্ষব্যাপী নিশ্চেষ্টতার মধ্যেও ভারতবাসীর একটি বিষয়ে দৃঢ়তা ছিল, সে তার সহজং কর্ম (বা ধর্ম) সদোষমপি ত্যাগ করে নি। সমগ্র ভারত যদি পরধর্ম গ্রহণ করত তবে আমাদের পরাধীন দশার স্থিতি সাত শ বৎসর না হয়ে দু শ বৎসর গণ্য হত, অর্থাৎ শুধু ব্রিটিশ অধিকার কাল। সে ক্ষেত্রে সমস্ত মুসলমানের সঙ্গে সাজাত্য অনুভব করে কবি ইকবালের মতন আমরাও হৃত রাজ্যের জন্য বিলাপ করতাম–চীন হমারা, স্পেন হমারা।
অন্য বিষয়ে উদ্যমহীন হয়েও ভারতবাসী তার দৃঢ় স্বধর্মনিষ্ঠা কোথা থেকে পেয়েছে? কেউ কেউ বলবেন, এর মূলে আছে বর্ণাশ্রম ধর্ম। কিন্তু যথার্থ বর্ণাশ্রম আর চাতুর্বর্ণ বহুকাল আগেই লোপ পেয়েছে, তার স্থানে যা এসেছে তা জাতিভেদ বা casteism। এই শতমুখী ভেদবুদ্ধির এমন শক্তি থাকতে পারে না যার দ্বারা বিজেতার ধর্মকে বাধা দেওয়া যায়। ভারতবাসীর প্রকৃতিতে এক প্রকার প্রবল জাড্য বা inertia আছে, সে অজ্ঞাতসারে অনেক পরিবর্তন মেনে নেয় কিন্তু সজ্ঞানে তার নিষ্ঠা ত্যাগ করতে চায় না। হয়তো এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই বহিরাগত আঘাত প্রতিহত হয়েছিল। পেগান গ্রীস আর রোমের সংস্কৃতি প্রচুর ছিল, তথাপি সেখানকার লোকে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীষ্টান হয়ে গিয়েছিল। ভারতের অসংখ্য ধর্মমত আর লোকাঁচারের মধ্যে এমন কিছু বলিষ্ঠ অবলম্বন আছে যার কাছে বিদেশীর প্রভাব হার মেনেছিল। ইতিহাসজ্ঞ সমাজবিজ্ঞানীরা হয়তো তার সন্ধান পেয়েছেন।
আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। পাঁচ শ বৎসরের মুসলমান শাসনের ফলে ভারতবাসীর সংস্কৃতি অবশ্যই কিছু বদলেছে। কিন্তু তার চাইতে বহুগুণ বদলেছে দুশ বৎসরের ব্রিটিশ শাসনে। মুসলমান সংস্কৃতি থেকে গ্রহণযোগ্য বেশী কিছু আমরা পাই নি, কিন্তু ব্রিটিশ বা ইওরোপীয় সংস্কৃতি থেকে প্রচুর পেয়েছি। আমরা খ্রীষ্টীয় ধর্ম নেবার প্রয়োজন বোধ করি নি, কিন্তু ইওরোপীয় আচার কিছু কিছু আত্মসাৎ করেছি এবং সাগ্রহে পাশ্চাত্ত্য বিদ্যা বুদ্ধি ও ভাবধারা অজস্র পরিমাণে বরণ করে নিয়েছি।