ইংরেজী অভিধানে যে beauty of form or emotional effectএর উল্লেখ আছে, কবি নীলকণ্ঠ দীক্ষিতের একটি শ্লোকে তারই সমর্থন পাওয়া যায়
যানেব শব্দান্ বয়মালপামোঃ
যানেব চার্থান্ বয়মুন্নিখামঃ।
তৈরেব বিন্যাসবিশেষভব্যৈঃ
সম্মোহয়ন্তীহ কবয়ো জগন্তি।
–আমরা যেসব শব্দ বলি, যেসব অর্থ প্রয়োগ করি, তাদেরই বিশেষ প্রকার ভব্য বিন্যাস দ্বারা কবিগণ জগৎকে সম্মোহিত করেন।
কিন্তু form বা শব্দবিন্যাসের উপর যদি অতিরিক্ত নির্ভর করা হয় তবে emotion বা রসের চাইতে ভঙ্গীই বেশী প্রকট হয়। এরূপ রচনার বহু পাঠক হয় না। জেমস জয়েসের অদ্ভুত রচনায় যাঁরা রস পান তাদের সংখ্যা অল্প। আমাদের দেশের কয়েকজন আধুনিক কবির রচনা সাধারণের পক্ষে দুর্বোধ, কিন্তু এক শ্রেণীর সমানধর্মা পাঠকের সমাদর পেয়েছে। বাঙলা কবিতার যাঁরা চর্চা করেন তারা এখন দ্বিধা বিভক্ত। একদল প্রাচীনপন্থী কবিদের কৃপার চক্ষে দেখেন, আর একদল অত্যাধুনিক কবিদের অপ্রকৃতিস্থ মনে করেন। কোনও নূতন পদ্ধতির প্রবর্তনকালে প্রায় মতভেদ দেখা যায়। কালক্রমে সেই পদ্ধতি বর্জিত বা বহুসমাদৃত হতে পারে অথবা চিরদিনই বিতর্কের বিষয় হয়ে টিকে থাকতে পারে। শত বৎসর পূর্বে বাঙলা কবিতায় যমক অনুপ্রাস ইত্যাদি শব্দালংকারের বাহুল্য ছিল, এখন আর নেই। এককালে গদ্য কবিতা অনেকের দৃষ্টিতে উপহাসের বিষয় ছিল, এখন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আদিরসাত্মক রচনা নিয়ে বোধ হয় চিরদিনই বিতর্ক চলবে।
.
ব্যাপক প্রয়োগে সাহিত্যের আধুনিক অর্থ কোনও বিষয়সংক্রান্ত পুস্তকসমূহ এবং যা কিছু ছাপা হয় (printed_matter)। বিশিষ্ট প্রয়োগে–এমন গ্রন্থ যার রচনাপদ্ধতি বা ভাষা মনোহর, অথবা যা ভাবের উদ্রেক করে, অর্থাৎ যাতে রস আছে।
আর্ট-এর যেমন বাঙলা প্রতিশব্দ নেই, তেমনি রস-এর ইংরেজী নেই। মোটামুটি বলা যেতে পারে, রচনায় যে গুণ থাকলে পড়তে ভাল লাগে তারই নাম রস। অলংকারশাস্ত্রে নবরসের উল্লেখ আছে–আদি (বা শৃঙ্গার), হাস্য, করুণ, অদ্ভুত, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, শান্ত। কৌতূহলও একটা রস, বোধ হয় অদ্ভূতের অন্তর্গত। ডিটেকটিভ গল্পে এই রসই প্রধান। আমাদের আলংকারিকরা রস সম্বন্ধে বিস্তর লিখেছেন, করুণ রস পড়ে লোকে কেন সুখ পায় তাও বোঝাবার চেষ্টা করেছেন।
একশ্রেণীর সমালোচকরা বলেন, শুধু রসে চলবে না, উচ্চ আদর্শ থাকা চাই। সমাজের যা আদর্শ সাহিত্যেরও কি তাই? হিতোপদেশ, প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক, Pilgrims Progress, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সভাবশতক ইত্যাদি গ্রন্থে উচ্চ আদর্শ আছে। রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে মুকুন্দ দাস যেসব যাত্রার পালা রচনা করেছিলেন তা নীতিবাক্যে পরিপূর্ণ। ক্ষেত্রবিশেষে এই সব রচনার অবশ্যই প্রয়োজন আছে, কিন্তু সাহিত্যে যদি নীতিকথা বা সামাজিক আদর্শ প্রচারের বাহুল্য থাকে তবে তার রস শুখিয়ে যায়। হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, ঘরে বাইরে, দেনাপাওনা, পথের পাঁচালি ইত্যাদিতে উচ্চ আদর্শ কতটুকু আছে? আমরা নিজের জীবনে রোগ শোক নিষ্ঠুরতা কৃতঘ্নতা প্রতারণা ব্যভিচার ইত্যাদি চাই না, ভয়ানক আর বীভৎস রসও পরিহার করি, কিন্তু সাহিত্যে এ সমস্তই রসসৃষ্টির সহায়। পুণ্যের জয় আর পাপের পরাজয়ও সাহিত্যে অত্যাবশ্যক নয়।
ব্যক্তিগত বা সামাজিক আকাঙ্ক্ষা আর সাহিত্যিক আকাক্ষা সমান নয়। মনোবিজ্ঞানীরা এই পার্থক্যের কারণ অনুসন্ধান করেছেন, কিন্তু কোনও বহুসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন নি। সাহিত্যের যে রস সুধীজনের কাম্য তা বহু জটিল উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। আমাদের রসতত্ত্বের জ্ঞান নিতান্ত অস্পষ্ট, art for arts sake, মানবকল্যাণের নিমিত্তই সাহিত্য, মানুষে মানুষে মিলনের জন্যই সাহিত্য, জীবনের আলেখ্যই সাহিত্য–এই ধরনের উক্তিতে রসতত্ত্বের নিদান পাওয়া যায় না। উত্তম সাহিত্য আমাদের আনন্দ দেয়, কিন্তু কোন্ কোন্ রস কি ভাবে যোজিত হলে উত্তম সাহিত্য উৎপন্ন হয় তা আমরা জানি না। অনেক বৎসর পূর্বে এ সম্বন্ধে যা লিখেছিলাম তা থেকে কিছু পুনরুক্তি করছি।*
সাহিত্যের অনেক উপাদান নীতিবিরোধী, অনেক উপাদান পরস্পর বিরোধী, কিন্তু কৃতী রচয়িতা কোনও উপাদান বাদ দেন না। নিপুণ পাঁচক কটু তিক্ত মিষ্ট সুগন্ধ দুর্গন্ধ নানা উপাদান মিশিয়ে সুখাদ্য প্রস্তুত করে। নিপুণ সাহিত্যিকের পদ্ধতিও অনুরূপ। খাদ্যে কতটা ঘি দিলে উপাদেয় হবে, কটা লংকা দিলে মুখ জ্বালা করবে না, কতটা পেঁয়াজ রসুন দিলে উৎকট গন্ধ হবে না,এবং সাহিত্যে শান্তরস আদিরস বা বীভৎসরস, সুনীতি বা দুর্নীতি, একনিষ্ঠ প্রেম বা ব্যভিচার, কত মাত্রায় থাকলে সুধীজনের উপভোগ্য হবে তার নিরূপণের সূত্র অজ্ঞাত। জনকতক ভোক্তার হয়তো কোনও বিশেষ রসে আসক্তি বা বিরক্তি থাকতে পারে, কিন্তু তাদের বিচারই চূড়ান্ত গণ্য হয় না। যিনি শুধু একশ্রেণীর ভোক্তার তৃপ্তিবিধান করেন অথবা জনসাধারণের অভ্যস্ত ভোজ্যই পরিবেশন করেন তিনি সামান্য পেশাদার বা hack writer মাত্র। যাঁর রুচি অভিনব এবং যিনি বহু ভোক্তার রুচিকে নিজের রুচির অনুগত করতে পারেন তিনিই উত্তম সাহিত্যস্রষ্টা। যিনি কোনও লেখকের রচনায় এই গুণ উপলব্ধি করে পাঠকগণকে তৎপ্রতি আকৃষ্ট করতে পারেন তিনিই উত্তম সমালোচক।