অনেকসংশয়চ্ছেদি পরোক্ষার্থস্য দর্শক।
সর্বস্য লোচনং শাস্ত্রং যস্য নাস্ত্যন্ধ এব সঃ।
অনেক সংশয়ের উচ্ছেদক এবং অপ্রত্যক্ষ বিষয়ের প্রদর্শক সকলের লোচনস্বরূপ শাস্ত্রজ্ঞান যার নেই সে অন্ধই।
এদেশে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত যেসব বিষয় পড়ানো হয় তার বার বার পরিবর্তন হয়েছে, তথাপি এইগুলিকে প্রধান অঙ্গ বলা যেতে পারে।
–মাতৃভাষা, ইংরেজী, সংস্কৃত, ভারতের ইতিহাস ও শাসনতন্ত্র, ভূগোল, গণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান ইত্যাদি। এইসব বিদ্যার অল্পমাত্র জ্ঞানও যার নেই সে অন্ধ এব, অর্থাৎ তাকে অশিক্ষিত বলা যেতে পারে।
(২) বিশেষ শিক্ষা। –উল্লিখিত সামান্য শিক্ষায় সকলে তৃপ্ত হয় না, অনেকে কয়েকটি বিদ্যা ভাল করে আয়ত্ত করতে চায়। এই বিশেষ শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্থোপার্জন নাও হতে পারে। অনেকে কেবল শখ বা জ্ঞানলাভের জন্যই বিদ্যাবিশেষের চর্চা করেন। হাইকোর্টের জজ ব্যারিস্টার ইত্যাদির মধ্যে গণিত বিজ্ঞান আর সংস্কৃতে উচ্চ উপাধিধারী লোক বিরল নন। এঁরা যে বিশেষ বিদ্যা আয়ত্ত করেছেন তা বিচার সংক্রান্ত কাজের পক্ষে অনাবশ্যক।
এক শ্রেণীর বিদ্যাকে ইংরেজীতে বলা হয় humanities। এই সংজ্ঞাটির অর্থ সুনির্দিষ্ট নয়। মোটামুটি বলা যেতে পারে, লাটিন গ্রীক প্রভৃতি প্রাচীন সাহিত্য এর একটি প্রধান অঙ্গ। কয়েকটি আধুনিক বিদ্যাও এর অন্তর্গত, কিন্তু পরীক্ষা ও প্রযুক্তিমূলক বিজ্ঞান (experimental and applied science) নয়। কলেজের পাঠ্য বিষয়কে সাধারণত দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়, আর্টস্ ও সায়েন্স। সায়েন্সের প্রতিশব্দ আছে–বিজ্ঞান। খবরের কাগজে আর্টস্ স্থানে কলা দেখতে পাই, কিন্তু এই অনুবাদ অন্ধ নকল। আর্টস্ বললে যেসব কলেজী বিদ্যা বোঝায় তাদের কলা নাম দিলে উপহাস করা হয়। আর্টস্ আর হিউম্যানিটিজকে যুক্তভাবে সাহিত্যাদিবর্গ বলা যেতে পারে। প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য এবং ইতিহাস জীবনচরিত দর্শন সমাজ সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয় সাহিত্যাদির অন্তর্গত।
ষাট-সত্তর বৎসর পূর্বে কলেজের উচ্চতর শ্রেণীতে বিজ্ঞানের চাইতে সাহিত্যাদিবর্গের ছাত্র বেশী দেখা যেত। তখন বিজ্ঞ লোকেরা বলতেন, সায়েন্স তো ছেলেখেলা, আসল বিদ্যা হচ্ছে ইংরেজী সাহিত্য, তার পরে ফিলসফি। এখন রুচির পরিবর্তন হয়েছে, বিজ্ঞানের ছাত্রই আজকাল বেশী। এই পরিবর্তনের কারণ, সাহিত্যাদি শিখলে জীবিকার্জনের যত সম্ভাবনা, বিজ্ঞান শিখলে তার চাইতে বেশী। ভারত সরকার শিল্পবর্ধনের ব্যাপক পরিকল্পনা করেছেন, তার ফলে বিজ্ঞানীর চাকরি পাবার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। অর্থবিদ্যা (economics), বাণিজ্য (commerce) প্রভৃতি বিশেষ বিদ্যাও আজকাল জনপ্রিয় হয়েছে, শিখলে জীবিকার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়।
(৩) বৃত্তিমুখী শিক্ষা। –এই শ্রেণীর শিক্ষা হাতেকলমে না শিখলে সম্পূর্ণ হয় না। আইন আর এঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা বৃত্তিমুখী, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ নয়। ডাক্তারি শিক্ষার পদ্ধতিকেই প্রকৃতপক্ষে বৃত্তিমুখী বলা চলে। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র রোগীর সাক্ষাৎ সম্পর্কে আসেন, চিকিৎসা কার্যেও সাহায্য করেন, সেজন্য তার বৃত্তির উপযোগী প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ হয়। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টান্ট পদের শিক্ষার্থীও ভবিষ্যৎ মক্কেল শ্রেণীর সম্পর্কে আসেন, সেজন্য তাঁর শিক্ষাও যথার্থ বৃত্তিমুখী। আইন শিক্ষার্থীকে যদি বাদী প্রতিবাদীর সম্পর্কে আনা হত এবং মকদ্দমা চালাবার কিছু ভার দেওয়া হত, এঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীকে দিয়ে যদি নূতন ব্রিজ বাঁধ বা কারখানার প্ল্যান এস্টিমেট আর তদারকের কাজ কিছু কিছু করানো হত, তবেই তাদের শিক্ষা যথার্থ বৃত্তিমুখী হত।
.
মানুষের শৈশবে যার আরম্ভ হয় এবং জীবিকানির্বাহের উপযোগী কর্মে নিয়োগ পর্যন্ত যা চলে, যাতে যথাসম্ভব শরীর আর মনের উৎকর্ষ এবং অর্থোপার্জনের যোগ্যতা লাভ হয়, সেই সমগ্র শিক্ষাই পর্যাপ্ত শিক্ষা। এরূপ শিক্ষার উদ্দেশ্য–সকল লোকেরই সামর্থ্য অনুযায়ী বিদ্যা আর জীবিকার বিধান। শুনতে পাই সোভিএট রাষ্ট্রে সমস্ত প্রজার জন্য এই ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সেখানে কর্ম নির্বাচনে প্রজার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কতটা গ্রাহ্য হয় জানি না। ভারতে এবং অন্যান্য সকল দেশে অল্পসংখ্যক প্ৰজাই সরকারী কাজ পায়, বাকী সকলকেই নিজের চেষ্টায় জীবিকার যোগাড় করতে হয়। আমাদের দেশে সকলে কাজ পায় না, সেজন্য বেকারের সংখ্যা ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
বন্দে মাতরম্ স্তোত্রে বঙ্কিমচন্দ্র স্বদেশকে ধরণীং ভরণীং বলেছেন, অর্থাৎ বঙ্গমাতা তার সন্তানগণকে ধারণ করেন, ভরণও করেন। এখন নানা কারণে আমাদের মাতৃভূমির ধারণ ও ভরণের ক্ষমতা খর্ব হয়েছে। সকল প্রজার উপযুক্ত পর্যাপ্ত শিক্ষা আর জীবিকার সংস্থান শীঘ্র সম্ভাব্য না হলেও কল্যাণ রাষ্ট্র বা ওয়েলফেয়ার স্টেটের লক্ষ্য তাই হওয়া উচিত।
শিক্ষা যদি পর্যাপ্ত বা বৃত্তিমুখী নাও হয় তথাপি জীবিকার্জনের উপযোগী হতে পারে। যারা কেবল সাহিত্যাদি বিদ্যায় ব্যুৎপন্ন তাঁরাও রাষ্ট্রের অতি উচ্চ পদ পেতে পারেন, সরকারী বিভাগের অধিকর্তা, রাজনীতিক, অধ্যাপক, লেখক, সম্পাদক, ব্যবসায়ী ইত্যাদি হতে পারেন। যাঁরা বিজ্ঞানাদি বিশেষ বিদ্যা আয়ত্ত করেন অথবা বৃত্তিমুখী শিক্ষা লাভ করেন তাদের জীবিকার ক্ষেত্র অবশ্য আরও বিস্তৃত।