বানান-সমিতির আর একটি নিয়ম–কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে বিদেশী শব্দে মূল উচ্চারণ অনুসারে s স্থানে স এবং sh স্থানে শ হবে, যেমন, ইশারা তামাশা শয়তান শেমিজ-এ তালব্য শ, কিন্তু আসমান জিনিস সাদা নোটিস পুলিস-এ দন্ত্য স। হিন্দী প্রভৃতিতে এই রীতি মানা হয়, বাঙালী মুসলমান লেখকরাও তা মানেন। সকলেই এই নিয়মে বানান করলে সামঞ্জস্য আসবে।
আর একটি বিষয় বিচারের যোগ্য। অনেক শব্দে অনর্থক apostrophe বা ঊর্ধ্ব কমা দেখতে পাই। বার্নার্ড শ, পাঁচ শ ইত্যাদিতে ঊর্ধ্ব কমার সার্থকতা কি? না দিলেও লোকে শএর ঠিক উচ্চারণ করবে, কেউ শ বলবে না। দুদিন, নটাকা ইত্যাদি বানানে ঊর্ধ্ব কমার কিছুমাত্র প্রয়োজন দেখি না। দুই থেকে দু, নয় থেকে ন হয়েছে তা জানাবার কি দরকার? দু ছ ন শ ইত্যাদি স্বপ্রতিষ্ঠ শব্দ, এদের ব্যুৎপত্তি না জানালে কোনও ক্ষতি হয় না। সাধু রূপ তাহা তাহাকে তাহাতে তাহার থেকে চলিত রূপ তা তাকে তাতে তার হয়েছে, কিন্তু ঊধ্ব কমা দেওয়া হয় না।
লখনউএর যারা বাসিন্দা তারা সরল বানান লেখে ল খ ন উ, কিন্তু বাঙালী অনর্থক লক্ষ্ণৌ লেখে কেন? দরভঙ্গায় দ্বার নেই, বঙ্গের সঙ্গেও সম্পর্ক নেই, তবু দ্বারবঙ্গ লেখা হয় কেন? আর একটা উৎকট বানান sir স্থানে স্যার। যেমন ক্যাট হ্যাট ব্যাট, তেমনি স্যার। শুধু সার লিখলেই চলে, সেকেলে বানান সর আরও ভাল মনে করি।
অনেকে মনে করেন বিদেশী শব্দের হসন্ত উচ্চারণ বোঝাবার জন্য শেষে হচিহ্ন দিতেই হবে। এঁরা লেখেন–কাটলেট, টি-পট, প্লেট, ডিশ। হসচিহ্ন না দিয়ে যদি শুধু ডিশ লেখা হয় তবে লোকে ডিশঅ পড়বে এমন ভয় আছে কি? অনর্থক হসচিহ্ন দিয়ে লেখা কণ্টকিত করায় লাভ নেই। অনেকে মেইন, চেইন, টেইল লেখেন। এঁদের যুক্তি ইংরেজী শব্দে । অক্ষর আছে, উচ্চারণেও তার প্রভাব পড়ে। এই যুক্তি মিথ্যা। এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় যথাযথ প্রকাশ করা যায় না, কাছাকাছি বানানে হলেই যথেষ্ট। মেইন, চেইন ইত্যাদি লিখলে লোকে ই-কারের উপর অতিরিক্ত জোর দেয়। আর একটি ভয়ংকর বানান মাঝে মাঝে দেখি–কেইক অর্থাৎ কেক। ই-কার না দিলে কি ক্যাক পড়বার ভয় আছে?
শিক্ষার আদর্শ
শিক্ষার আদর্শ (১৮৮০/১৯৫৮)
আমার শোবার ঘরের পাশে একটা বকুল গাছ আছে, এক জোড়া বুলবুলি আর গোটাকতক শালিক চড়াই তাতে রাত্রিযাপন করে। চৈত্র মাসে নূতন পাতা গজাবার পর তারা প্রায় সকলেই বিতাড়িত হয়, দুটো কাগ এসে গাছে বাসা বাঁধে। নিশ্চয় একটা পুরুষ আর একটা স্ত্রী। কিছুদিন পরে দেখি, বাসার খড়কুটোর মধ্যে একটা কদাকার বাচ্চা প্রকাণ্ড হাঁ করছে, তার মা নিজের ঠোঁট দিয়ে সন্তানের লাল মুখের ভিতর খাবার পুরে দিচ্ছে। শিশু কাগ ক্রমশ বড় হয়ে ওঠে, তার মুখের ব্যাদান আর রক্তিমা কমে আসে, সে নিজের ঠোঁট দিয়ে মায়ের মুখ থেকে খাবার তুলে নেয়। আরও কিছুদিন পরে দেখি, কিশোর কাগ বাসা ছেড়ে ডালের উপর বসেছে, তার মা তাকে ঠেলা দিচ্ছে, বাচ্চা ভয়ে কা কা করছে, পাখা নাড়ছে, আর দু পায়ের আঙুল দিয়ে ডাল আঁকড়ে আছে। তার পর তরুণ কাগ হঠাৎ শাখাচ্যুত হয়ে ঝটপট করছে, তার মা নিজের দেহ দিয়ে তাকে সামলাচ্ছে। একজন সাঁতারপটু লোক ছোট ছেলেকে যেমন করে সাঁতার শেখায়, কাগের মা তেমনি করে নিজের বাচ্চাকে উড়তে শেখাচ্ছে।
পাখির যা প্রাথমিক শিক্ষা, ওড়া আর আহার সংগ্রহ, তা সে নিজের মায়ের কাছ থেকেই পায়। বাকী যা কিছু সবই তার সহজ প্রবৃত্তি (instinct) আর অভিজ্ঞতার ফল। মাছ ব্যাঙ সাপ ইত্যাদি নিম্নতর প্রাণী পিতামাতার উপর আরও কম নির্ভর করে, তাদের জীবিকার্জনের সামর্থ্য জন্মগত।
আদিম মানুষ পিতা মাতা আর গোষ্ঠীবর্গের কাছ থেকে জীবনযাপনের উপযোগী সকল প্রকার শিক্ষা পায়। সভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজন বেড়েছে, শিক্ষার ব্যবস্থা ক্রমশ জটিল হয়েছে। আত্মীয়স্বজনের কাছে যা শেখা যায় তা এখন পর্যাপ্ত নয়, সমাজ আর রাষ্ট্রই নানাপ্রকার শিক্ষার ব্যবস্থা করে। ইতর প্রাণী আর আদিম মানুষ পিতামাতা ইত্যাদির কাছে যা শেখে তা যতই সামান্য হক, তাদের জীবনযাত্রার পক্ষে পর্যাপ্ত বা যথেষ্ট। আধুনিক সভ্য মানুষের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে তাও কি পর্যাপ্ত? অন্য দেশ সম্বন্ধে আলোচনা না করে আমাদের দেশের কথাই বলছি।
.
প্রচলিত শিক্ষাকে মোটামুটি তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। (১) সামান্য শিক্ষা, যা সকলের পক্ষেই আবশ্যক এবং পরবর্তী শিক্ষার ভিত্তিস্বরূপ গণ্য হয়। (২) বিশেষ শিক্ষা, যা শিক্ষার্থীর রুচি ও সামর্থ্য অনুসারে নির্ধারিত হয়। (৩) বৃত্তিমুখী শিক্ষা, যার উদ্দেশ্য জীবিকার্জনের উপযোগী কোনও কর্মে জ্ঞান ও পটুতা লাভ।
(১) সামান্য শিক্ষা।– আমাদের দেশে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার জন্য যেসব বিষয় নির্দিষ্ট আছে সেগুলিকেই সামান্য শিক্ষার অঙ্গ বলা যেতে পারে। মহাত্মা গান্ধীর প্রবর্তিত বুনিয়াদী তালিমও সামান্য শিক্ষা, যদিও তার অঙ্গগুলি কিছু অন্যরকম। নিরক্ষর লোকেও জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, কেউ কেউ কোটিপতি ধনী বা সাধু মহাত্মাও হতে পারে, তথাপি বিদ্যার প্রয়োজন চিরকালই স্বীকৃত হয়েছে। এককালে লেখাপড়া বললে বোঝাত ন্যূনতম বিদ্যা অর্থাৎ নামমাত্র লেখা আর পড়া, আর একটু অঙ্ক করা। ইংরেজীতে এরই নাম three Rs-reading, riting and rithmetic। এই লেখাপড়া কখনই যথেষ্ট গণ্য হয় নি, শাস্ত্র (অর্থাৎ সুশৃঙ্খল কেতাবী বিদ্যা) না পড়লে মানুষ অন্ধবৎ হয়, একথা বিষ্ণুশর্মা হিতোপদেশ গ্রন্থে বলেছেন