এ দেশের এবং বোধ হয় সকল দেশেরই বেশীর ভাগ পাঠক প্রথম শ্রেণীর অর্থাৎ নিষ্কণ্টক গল্প চায় যার শেষে নায়ক-নায়িকা সুখে ঘরকন্না করে and live happily ever after। মামুলী ডিটেকটিভ কাহিনী এবং রোমাঞ্চ সিরিজের রূপসী বোম্বেটে জাতীয় গল্পও এই শ্রেণীতে পড়ে। ছোট ছেলেমেয়ের জন্য যেমন রূপকথা তেমনি অসংখ্য সাধারণ পাঠকের জন্য এমন গল্প দরকার যাতে প্রচুর আতঙ্ক আর উত্তেজনা আছে, প্রেমের লড়াইও আছে, কিন্তু যার পরিণাম নিষ্কণ্টক। যে পাঠকরা অপেক্ষাকৃত বিদগ্ধ এবং মানবচিত্তের রহস্য সম্বন্ধে কুতূহলী, অর্থাৎ যাঁরা সমস্যাময় বাস্তব জীবনের চিত্র চান, তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর সকণ্টক গল্পই বেশী উপভোগ করেন।
[* শশিশেখর বসু।—স:।]
গ্রহণীয় শব্দ
গ্রহণীয় শব্দ (১৮৮০/১৯৫৮)
ভাবের বাহন ভাষা, ভাষার উপাদান শব্দ। শব্দের অর্থ যদি সর্বগ্রাহ্য হয় তবেই তা সার্থক, অর্থাৎ প্রয়োগের উপযুক্ত এবং সাহিত্যে গ্রহণীয়।
বাঙলা ভাষা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। তার এক কারণ, বাঙালীর জীবনযাত্রার পরিবর্তন, অর্থাৎ নূতন বস্তু নূতন ভাব নূতন রুচি নূতন আচারের প্রচলন। অন্য কারণ, অজ্ঞাতসারে বা ইচ্ছাপূর্বক ইংরেজী ভাষার অনুকরণ। মৃত ভাষা ব্যাকরণের বন্ধনে মমির মতন অবিকৃত থাকতে পারে, কিন্তু সজীব চলন্ত ভাষায় বিকার বা পরিবর্তন ঘটবেই। আমাদের আহার পরিচ্ছদ আবাস সমাজব্যবস্থা আর শাসনপ্রণালী যেমন বদলাচ্ছে, তেমনি শব্দ শব্দার্থ আর শব্দবিন্যাসও বদলাচ্ছে।
যাঁরা গোঁড়া প্রাচীনপন্থী তারা কোনও পরিবর্তন প্রসন্ন মনে মেনে নিতে পারেন না। আধুনিক ছেলেমেয়েদের চালচলন যেমন অনেক লোকের পক্ষে দৃষ্টিকটু, আধুনিক বাঙলা ভাষার রীতিও সেই রকম। অন্ধ গোঁড়ামি সকল ক্ষেত্রেই অন্যায়, কিন্তু শুধু হুজুক বা ফ্যাশনের বশে কোনও নূতন বস্তু বা রীতি মেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়। ভাষার রীতির তুলনায় সামাজিক রীতির গুরুত্ব অবশ্য অনেক বেশী, তথাপি কোনও শিক্ষিত লোকই চান না যে মাতৃভাষায় জঞ্জাল আসুক। সহসাগত কোনও শব্দ শব্দার্থ বা প্রয়োগরীতিকে সাহিত্যে স্থান দেবার আগে একটু যাচাই করে দেখা ভাল।
ভাষার সমৃদ্ধি হয় কৃতী লেখকের প্রভাবে, কিন্তু তার ক্রমিক মন্থর পরিবর্তনে জনসাধারণের হাতই বেশী। সাধারণ মানুষ ব্যাকরণ অভিধানের বশে চলে না। কয়েকজন শব্দের উচ্চারণে বা প্রয়োগে ভুল করে, তার পর অনেকে সেই ভুলের অনুসরণ করে, তার ফলে কালক্রমে নূতন শব্দ নূতন অর্থ আর নূতন ভাষার উৎপত্তি হয়। ভাষা মাত্রেই পূর্ববর্তী কোনও ভাষার বিকার বা অপভ্রংশ এবং একাধিক ভাষার মিশ্রণ। শব্দ অর্থ আর ভাষার এই স্বাভাবিক অভিব্যক্তি বা evolution বারণ করা যায় না। কিন্তু অভিব্যক্তিতেও মানুষের কিছু হাত আছে। মানুষ অন্ধভাবে সবরকম প্রাকৃতিক পরিবর্তন মেনে নেয় না, স্বচ্ছন্দাগত সব কিছুকে সাদরে বরণ করে না। অভিব্যক্তির বহু ক্ষেত্রে মানুষ সজ্ঞানে হস্তক্ষেপ করেছে, যে পরিবর্তন তার পক্ষে অনুকূল তাই ঘটাবার চেষ্টা করেছে। বন্য প্রাণী আর উভিদ থেকে গৃহপালিত পশুপক্ষী আর ভক্ষ্য শস্য ফলাদির উৎপত্তি মানুষেরই যত্নের ফল। ভাষার ক্ষেত্রেও আমাদের সতর্ক হস্তক্ষেপ শুভজনক হতে পারে।
বিষয়টি সহজ নয়। ভাষার সৌষ্ঠব রক্ষা আর প্রকাশ-শক্তি বর্ধনের প্রকৃষ্ট উপায় কি সে সম্বন্ধে মতভেদ থাকতে পারে, কোন্ শব্দ গ্রহণীয় বা বর্জনীয় তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। সবিস্তার আলোচনা না করে শুধু কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। তা থেকে হয়তো সতর্কতার প্রয়োজন বোঝা যাবে।
এমন অনেক বস্তু এদেশে আছে যার সম্বন্ধে আমাদের সাধারণ শিক্ষিত জন এতকাল উদাসীন ছিলেন। সম্প্রতি এই প্রকার কয়েকটি বস্তুর গুরুত্ব বেড়েছে, সংবাদপত্র এবং সাধারণের পাঠ্যগ্রন্থে তাদের উল্লেখ না করলে চলে না। কিন্তু নামকরণে অসাবধানতা দেখা যাচ্ছে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বৎসর যাবৎ এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে লোহা তৈরি হচ্ছে, নূতন পরিকল্পনায় উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যাবে। যে কাঁচা মাল বা খনিজ বস্তু থেকে লোহা তৈরি হয় তার বাঙলা নাম কি? রাশি রাশি এই বস্তু রেলগাড়িতে বোঝাই হয়ে লোহার কারখানায় যায়, কলকাতার বন্দর থেকে জাহাজে জাপান রাশিয়া ইত্যাদি দেশে রপ্তানি হয়। অতি প্রয়োজনীয় এই ভারতীয় সম্পদের একটা সর্বগ্রাহ্য নাম অবশ্যই চাই। ইংরেজী নাম iron ore, বৈজ্ঞানিক নাম hematite। যে অশিক্ষিত জন এই বস্তু পাহাড় কেটে বার করে বা খনি থেকে তোলে তারা বলে লোহা-পাথর। এই অতি সরল উত্তম নামটি কিন্তু বাঙলা কাগজে স্থান পায় না, লেখা হয়–লৌহপিণ্ড বা খনিজ লৌহ বা আকরিক লৌহ। তিনটে নামই ভুল। লৌহপিণ্ড মানে লোহার তাল, lump of iron। খনিজ বা আকরিক লৌহ বলতে বোঝায়, যে লৌহ খনি বা আকরে থাকে। কিন্তু খনি বা আকরে কুত্রাপি লৌহ থাকে না, থাকে একরকম পাথর যাতে লোহা যৌগিক অবস্থায় আছে। মাটিতে আখ হয়, আখে চিনি আছে, কিন্তু আখকে ভমিজ শর্করা বলা চলে না। খনি আর আকর শব্দের মানে একই, কিন্তু পারিভাষিক প্রয়োগে mineralএর বাঙলা খনিজ, oreএর বাঙলা আকরিক। অতএব iron oreএর শুদ্ধ প্রতিশব্দ লৌহ আকরিক। কিন্তু লোহা-পাথর নাম আরও ভাল।