তখন শুধু বাঙলা বই পড়ে পাঠকের বুভুক্ষা মিটত না, প্রচুর ইংরেজী গল্পও লোকে পড়ত। আশ্চর্য এই, সেকালে সদ্য এনট্রান্স পাস করা ছাত্র এবং অনেকে যারা পাস করে নি তারাও ইংরেজী নভেল পড়ত, অথচ শুনতে পাই এখনকার অধিকাংশ গ্রাজুয়েট ইংরেজি নভেল বুঝতে পারে না। নব্য বাঙালীর শক্তি বা রুচির এই পরিবর্তন উন্নতি কি অবনতির লক্ষণ তা শিক্ষাবিশারদগণ বলতে পারেন।
আজকাল পাশ্চাত্ত্য দেশে কোনও শক্তিমান লেখকের আবির্ভাব হলে এদেশে অবিলম্বে তার খবর আসে। সেকালে এমন হত না। অল্প কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত লোক নূতন বইএর সন্ধান রাখতেন কিন্তু আর সকলের পাঠ্য ছিল প্রাচীন লেখকের রচনা। তখন কলেজ স্ট্রীটের বইএর দোকানে ক্লাসিক ভিন্ন অন্য ইংরেজী নভেল পাওয়া যেত না, পাঠকরা হগ মার্কেট, রেলওয়ে বুকস্টল প্রভৃতি থেকে তাদের প্রিয় গল্পের বই যোগাড় করতেন। শিক্ষকরা মনে করতেন ছাত্রদের পক্ষে অবাধ নভেল পাঠ ভাল নয়, তাঁরা বলতেন, রবিনসন ক্রুসো, গলিভার্স ট্রাস, রাসেলাস, ভিকার অভ ওয়েকফিল্ড পড়তে পার, স্কটের বইও দু-চারখানা পড়তে পার, কিন্তু তার বেশী নয়। তখন কোনান ডয়েল সবে লিখতে আরম্ভ করেছেন, কিন্তু তার খবর অল্প বাঙালীই জানত।
সেকালে নভেলখোর বাঙালীর প্রধান পাঠ্য ছিল স্কট, ডিকেন্স, লিটন, থ্যাকারে, ভিকটর হিউগো, রাইডার হ্যাগার্ড, মারি করেলি, ডুমা ইত্যাদি। হার্ডি, গল্সওয়ার্দি আর টলস্টয়ের নাম সাধারণ পাঠকের অজ্ঞাত ছিল। রাশি রাশি অতি সস্তা মার্কিন ডিটেকটিভ আর ওআইল্ড ওয়েস্টের গল্প আমদানি হত, কিন্তু অনভিজ্ঞ পাঠকের পক্ষে তার স্ল্যাং-বহুল ভাষা একটু দুর্বোধ ছিল। লোকে সব চেয়ে বেশী পড়ত রেনল্ডসের রোমাঞ্চকর গল্পাবলী, ডিস এডিশন, ছ আনায় একখানা বেশ বড় বই, বিস্তর ছবি। অতি ছোট হরফে ছাপা, কিন্তু যারা পড়ত তাদের চোখের তেজ ছিল, মিটমিটে প্রদীপ বা হারিকেনের আলোয় অনায়াসে পড়া চলত। আমার এক মাস্টারমশাই গোগ্রাসে রেনল্ডস গিলতেন। আমাকে বলেছিলেন, খবরদার, ত্রিশ বছর বয়সের আগে রেনল্ডস ছোঁবে না। কিন্তু আমার দাদা* বললেন, শুনিস না মাস্টারের কথা, রেনল্ডসের রবার্ট ম্যাকেয়ার পড়ে দেখিস, চমৎকার ডাকাতের গল্প; তার পর রাইহাউস প্লট, নেক্রোমান্সার ব্রঞ্জ স্ট্যাচু এই সব পড়বি। আমি দাদার উপদেশই পালন করেছিলাম। অল্প বয়সেই একগাদা রেনল্ডস পড়া হয়ে গেল, অরুচিও ধরল।
ডিক্স এডিশনের মতন সস্তা বই এখন স্বপ্নের অগোচর। শেকস্পীয়র মিলটন শেলী বাইরন প্রভৃতির সম্পূর্ণ গ্রন্থাবলীর দাম ছিল বারো আনা। ডিকেন্স স্কট লিটন ইত্যাদির উপন্যাস ছ আনা মাত্র। অতি গরিব পাঠকও অল্প খরচে অনেক বই সংগ্রহ করতে পারত।
এককালে যাঁর বইএ এ দেশের বাজার ছেয়ে গিয়েছিল সেই রেনল্ডসের কোনও চিহ্নই এখন পাওয়া যায় না। বিলাতেও তার বই প্রথম প্রথম খুব চলত। দু-একটি বইএ তিনি ব্রিটিশ রাজবংশের কুৎসা করেছিলেন সেজন্য কালক্রমে তার জনপ্রিয়তা লোপ পায়। তাঁর গ্রন্থাবলীর কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ আমার মনে আছে। দেদার রহস্য আর রোমাঞ্চ, কিছু ব্যভিচার, কিছু চুরি ডাকাতি নরহত্যা, এবং লর্ড-লেডিদের বিলাসময় জীবনযাত্রা। নায়ক নায়িকারা রূপে গুণে অতুলনীয়, বিস্তর বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে বহু কষ্টভোগের পর তাদের মিলন হয়। অনেক বইএর শেষে থাকত–And they were happy, oh, supremely happy I went-At last they were united in holy wedlock and lived happily ever after 1
Yellow Back নামে খ্যাত জনপ্রিয় ইংরেজী নভেলসমূহ এবং যেসব বাঙলা বইএর কাটতি সব চেয়ে বেশী তাদের রচনা পদ্ধতি অনেকটা রেনল্ডসের মতন। রূপকথা আর অধিকাংশ ডিটেকটিভ গল্পের পদ্ধতিও এই রকম। আমার মনে হয় সব রকম গল্পই মোটামুটি দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম শ্রেণীর গল্প রূপকথা জাতীয়, প্লটে যতই জটিলতা আর রোমহর্ষণ থাকুক, পরিশেষে পূর্ণ শান্তি, নায়ক-নায়িকার শারীরিক মানসিক আর্থিক সর্বাঙ্গীণ কুশল। পড়া শেষ হলে পাঠক হয়তো মনে মনে কিছুক্ষণ রোমন্থন করেন, কিন্তু তার পরে নিশ্চিন্ত হন, কারণ নায়ক-নায়িকার ভবিষ্যৎ একেবারে নিষ্কণ্টক। দ্বিতীয় শ্রেণীর গল্পের নায়ক-নায়িকা অম্লাধিক আঘাত পায়, তার ক্ষত সম্পূর্ণভাবে সারে না। লেখক মিলনান্ত করে গল্প সমাপ্ত করলেও কিছু কণ্টক রেখে দেন, তার ফলে পাঠকের মনে গল্পের জের চলতে থাকে। এই শ্রেণীর সকণ্টক গল্পকেই বোধ হয় মনস্তত্ত্বমূলক বলা হয়।
মহাভারতের অন্তর্গত সাবিত্রী-সত্যবান আর নল-দময়ন্তীর উপাখ্যান প্রথম শ্রেণীর নিষ্কণ্টক গল্প। কিন্তু মহাভারতের মূল আখ্যান সকণ্টক দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। যুদ্ধজয়ের পর যুধিষ্ঠির ছত্রিশ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। গ্রন্থ সমাপ্তির পরেও আমাদের ভাবনা হয়–যুধিষ্ঠিরের মন হয়তো শেষ পর্যন্ত অশান্ত ছিল, তবে ভীম বোধ হয় বেশ ফুর্তিতেই ছিলেন। দ্রৌপদী তাঁর পিতা ভ্রাতা আর পঞ্চ পুত্রের শোক নিশ্চয় ভুলতে পারেন নি, গান্ধারী আর তাঁর বিধবা পুত্রবধূদের সঙ্গে রাজপুরীতে বাসও বোধ হয় তার পক্ষে সুখকর ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারানী আর যুগলাঙ্গুরীয় নিষ্কন্টক গল্প, বিষবৃক্ষ সকণ্টক। নগেন্দ্র-সূর্যমুখীর পুনর্মিলন হলেও তাদের সম্পর্ক আগের মতন হবার নয়। রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবিকে নিষ্কণ্টক গল্প বলা যেতে পারে, কারণ পাত্রপাত্রীদের সমস্ত দুঃখ শেষকালে মিটে গেছে। কিন্তু তবু সন্দেহ থেকে যায়, জীবনের অত বড় বিপর্যয়ের পর কমলা তার অজ্ঞাত স্বামীকে আবিষ্কার করে কি পূর্ণ তৃপ্তি পেয়েছিল? শেষের কবিতা নিশ্চয় সকণ্টক গল্প। কেটিকে বিবাহ করে অমিত রায় কর্তব্য পালন করেছে, সেই সঙ্গে আত্মবিসর্জনও দিয়েছে। লাবণ্যর কাছে সে যেরকম উচ্ছ্বাসময় বক্তৃতা দিত, কেটির কাছে তার কোনও কদর হবে মনে হয় না। অগত্যা সে হয়তো পলিটিক্স নিয়ে মেতে উঠে একজন দেশনেতা হয়ে যাবে। শরৎচন্দ্রের দত্তা নিষ্কণ্টক গল্প, কিন্তু বামুনের মেয়েতে কণ্টক আছে। প্রিয়নাথ ডাক্তার হয়তো সামলে উঠে আবার রোগী দেখা শুরু করবেন, কিন্তু তার গর্বিতা কন্যার মনস্তাপ সহজে দূর হবে না।