অষ্টাদশ শতাব্দের মাঝামাঝি কয়েকজন ফরাসী পণ্ডিত (Diderot, DAlembert, Voltaire, Euler ইত্যাদি) Encyclopedie নাম দিয়ে একটি গ্রন্থমালা রচনা করেন। নামটি গ্রীক থেকে উদ্ভূত, মৌলিক অর্থ– বিদ্যাপরিবৃতি, অর্থাৎ সর্বজ্ঞানের ভাণ্ডার। প্রচলিত সংস্কারের বিরোধী মত প্রকাশের জন্য সম্পাদকগণ তখনকার রোমান ক্যাথলিক ধর্মনেতাদের বিষদৃষ্টিতে পড়েছিলেন, রাজদণ্ডও ভোগ করেছিলেন। এই গ্রন্থ প্রকাশের কিছু পরে ইংরেজী Encyclopedia Britannica সংকলিত হয় এবং এ পর্যন্ত তার অনেক সংস্করণ হয়েছে। এই প্রকাণ্ড বহুখণ্ড বহুবার সংশোধিত গ্রন্থে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের লেখা যে সকল বিবৃতি আছে তা প্রামাণিক বলে গণ্য হয়।
নগেন্দ্রনাথ বসু প্রাচ্যবিদ্যামহার্ণব কর্তৃক সম্পাদিত বিশ্বকোষ এবং . অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ কর্তৃক আরব্ধ মহাকোষ গ্রন্থের উদ্দেশ্য উক্ত দুই গ্রন্থের অনুরূপ। নানা বিদ্যার ও জ্ঞাতব্য বিষয়ের বিবৃতিসংবলিত কোষগ্রন্থের সম্পাদন একজনের সাধ্য নয়, বহু বিশেষজ্ঞের সাহায্য ভিন্ন প্রামাণিক সংকলন অসম্ভব। নগেন্দ্রনাথ যা সমাপ্ত করেছেন এবং অমূল্যচরণ যার কয়েক খণ্ড প্রকাশ করে গেছেন তা অসাধারণ অধ্যবসায়ের ফল। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা যেমন মুখ্যত ব্রিটিশ জাতি, আর ইংরেজী ভাষার প্রয়োজনে রচিত, নগেন্দ্রনাথ আর অমূল্যচরণের গ্রন্থ তেমনি বাঙালী আর বাংলা ভাষার প্রয়োজনে রচিত।
কয়েকটি বৃহৎ বাংলা শব্দকোষে ভূগোল, ইতিহাস, ও সাহিত্য-বিষয়ক তথ্য এবং জীবনচরিত আছে। শ্ৰীযোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি বহু বৎসর পূর্বে যে বাঙ্গলা শব্দকোষ রচনা করেছিলেন তাতে এদেশের খনিজ, বনজ, কৃষিজ দ্রব্য, প্রাণী, নৌকাদি যান, শিল্পসাধিত্র যথা তাঁত ঢেঁকি ঘানি, মাছ-ধরা জাল, গৃহোপকরণ এবং তাস পাশা দাবা প্রভৃতি খেলার বিবরণও আছে। অন্য কোনও বাংলা শব্দকোষে এসব পাওয়া যায় না। যোগেশচন্দ্রের গ্রন্থ সংস্কৃতেতর বাংলা শব্দের অভিধান, সেজন্য তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ প্রায় বর্জিত হয়েছে, তথাপি কয়েকটি সংস্কৃত নামযুক্ত বিষয়ের বিবৃতি আছে, যেমন সংগীতের তাল ও রাগ-রাগিণী। এই শব্দকোষ এখন পাওয়া যায় না। নব সংস্করণের জন্য তিনি গ্রন্থের আমূল পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন, শুনেছি তৎসম শব্দ যোগ করে অভিধানও পূর্ণাঙ্গ করেছেন। সুখের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থসাহায্যে এই বহু তথ্যপূর্ণ অদ্বিতীয় গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণের আয়োজন হচ্ছে।
বহুমূল্য কোষগ্রন্থ কেনা সকলের সাধ্য নয়, বিশেষ প্রয়োজন ভিন্ন প্রকাণ্ড গ্রন্থ নাড়াচাড়া করাও অসুবিধাজনক। ইংরেজীতে বড় মাঝারি ছোট অনেক রকম সাইক্লোপিডিয়া আছে। ছোটগুলির দাম বেশী নয়। তাতে যে বিবৃতি থাকে তা খুব সংক্ষিপ্ত হলেও মোটামুটি কাজ চলে। বাংলায় এই রকম ছোট কোষ রচনার চেষ্টা কয়েকজন করেছেন, কিন্তু ইংরেজী গ্রন্থের সঙ্গে কোনওটির তুলনা হয় না।
একটি ছোট সুসংকলিত প্রামাণিক বাংলা সাইক্লোপিডিয়ার প্রয়োজন আছে। যদি হাজার-বার শ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ পনর-কুড়ি টাকার মধ্যে পাওয়া যায় তবে বোধ হয় ক্রেতার অভাব হবে না। ইংরেজীর নকলে এই ছোট গ্রন্থের নাম বিশ্বকোষ বা ওই রকম কিছু দিলে অতিরঞ্জন হবে। বিষয়কোষ নাম চলতে পারে। শব্দকোষ বা অভিধানের প্রধান উদ্দেশ্য–শব্দের রূপ অর্থ ও প্রয়োগবিধির নির্দেশ। বিষয়কোষের উদ্দেশ্য–বিষয় (subject) অর্থাৎ পদার্থ, জাতি (class), ব্যক্তি (individual), স্থান, ঘটনা প্রভৃতির বিবৃতি। শব্দকোষ যেমন ভাষা শিক্ষা ও সাহিত্য চর্চার সহায়, বিষয়কোষ সেইরূপ বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে সন্দেহ নিরসন ও জ্ঞান লাভের সহায়।
যে কোষগ্রন্থের প্রস্তাব করছি তার উদ্দেশ্য বাংলা ভাষার গৌরব বর্ধন নয়, শুধুই উপস্থিত প্রয়োজন সাধন। সাধ্যের অতিরিক্ত সঙ্কল্প করলে কাজ অগ্রসর হবে না, হয়তো পণ্ড হবে। এমন একটি গ্রন্থ চাই যা থেকে ছাত্র শিক্ষক লেখক পাঠক সাংবাদিক রাজনীতিক ব্যবসায়ী প্রভৃতি সকলেই দেশীয় বিষয় সম্বন্ধে জিজ্ঞাসার সংক্ষিপ্ত উত্তর পান। যা ইংরেজী গ্রন্থে পাওয়া যায় তা দেবার কিছুমাত্র প্রয়োজন দেখি না, তাতে সম্পাদনের শ্রম আর প্রকাশের খরচ অনর্থক বাড়ানো হবে। আমরা এখনও ইংরেজী ভাষার চর্চা করি। যখন ইংরেজী বর্জন করব, তখন বিষয়কোষের পরিধি বাড়ালেই চলবে, যাতে বিদেশী গ্রন্থের দরকার না হয়। আপাতত পাশ্চাত্ত্য কোনও বিষয় জানতে হলে ইংরেজী সাইক্লোপিডিয়াই দেখব। যা তাতে নেই, যা নিতান্ত এদেশের শুধু তার জন্যই বাংলা বিষয়কোষের প্রয়োজন।
শব্দকোষের মতন বিষয়কোষ বর্ণানুক্রমেই সংকলিত হওয়া আবশ্যক। বিষয়ের শ্ৰেণী ভাগ করলে (অর্থাৎ বিজ্ঞান ইতিহাস শিল্প জীবন-চরিত ইত্যাদি পৃথক পৃথক দিলে) সুবিধা হবে না। প্রস্তাবিত গ্রন্থে আল্পস্, লন্ডন, পিরামিড, তড়িত্তত্ত্ব, সাইক্লোট্রন, ব্যাকটিরিয়া, বাওবাব বৃক্ষ অনাবশ্যক, কিন্তু অবিভক্ত ভারতের নগর পর্বত নদী মন্দিরাদি, পশুপক্ষী, কীট-পতঙ্গ, শাল সেগুন ধান যব গম আম কাঁঠাল কলা থাকবে। এদেশের চটকল, কাপড় কল, কাগজ, সিমেন্ট, রাসায়নিক সার, লোহা তামা এঞ্জিন টেলিফোন বন্দুক কামান বারুদ প্রভৃতির কারখানা, দামোদর পরিকল্পনা ইত্যাদির কথাও থাকবে। সীজার শেক্সপীয়র মার্কস স্তালিন চার্চিল, ফরাসী বিপ্লব, ইউরোপীয় দর্শন সাহিত্য ও কলা বাদ যাবে; চন্দ্রগুপ্ত কালিদাস তুলসীদাস রবীন্দ্রনাথ বরাহমিহির গান্ধী, সিপাহী-বিদ্রোহ, ভারতীয় দর্শন সাহিত্যকলা দিতে হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় এলিজাবেথ বাদ যাবেন, আলেকজান্ডার, হিউএসাং, মহম্মদ ঘোরি, অলবেরুনি, ভিক্টোরিয়া থাকবেন, কারণ তাঁদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঘটেছিল। কৃষ্ণ বুদ্ধ চৈতন্য রামমোহন রামকৃষ্ণ থাকবেন, বিদেশী হলেও জরথুস্ত্র খ্রীষ্ট মহম্মদ সেন্ট টমাস থাকবেন, কারণ এঁদের সঙ্গে বহু ভারতবাসীর ধর্মীয় সম্বন্ধ আছে; কিন্তু আখেনাটেন, সেন্ট পল, মার্টিন লুথার বাদ যাবেন। কংগ্রেস, মোসলেম লীগ, হিন্দু মহাসভা, কমিউনিস্ট পার্টি প্রভৃতি ভারতীয় রাজনীতিক দল থাকবে, কিন্তু নাৎসী বলশেভিক কুমেনটাং প্রভৃতি বাদ যাবে।