ভারতীয় বিদ্যার্থী সেকালে গুরুগৃহে যে শিক্ষা পেত তাকে তখনকার হিসাবে সর্বাঙ্গীণ বলা যেতে পারে। বিবিধ বিদ্যা আর শাস্ত্রবিহিত অনুষ্ঠান বা ritualএর সঙ্গে সদাচার আর সামাজিক কর্তব্যও শিক্ষণীয় ছিল। এখন গুরুগৃহের স্থানে স্কুল-কলেজ হয়েছে, শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তায় আস্থা ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। এখনকার বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা অত্যল্প, ধর্ম বা সামাজিক কর্তব্য শেখাবার তাঁদের সময় নেই, যোগ্যতাও নেই।
ধর্মশিক্ষার জন্য কেউ কেউ মুষ্টিযোগের ব্যবস্থা করে থাকেন। ছেলেরা নিয়মিত গায়ত্রী জপ, সন্ধ্যা-আহ্নিক, স্তোত্রপাঠ, গীতা-অধ্যয়ন ইত্যাদি করুক। মেয়েরা মহাকালী পাঠশালার অনুকরণে নানা রকম ব্রতপালন আর শিবপূজা করুক। ছাত্রছাত্রীদের রামায়ণ মহাভারত পুরাণাদি শোনাবার ব্যবস্থা হক। সর্বশক্তিমান পরমকারুণিক ঈশ্বরে বিশ্বাস আর ভক্তি যাতে হয় তার চেষ্টা করা হক।
পাশ্চাত্ত্য দেশেও দুক্কিয়া বেড়ে গেছে। অনেকে বলেন, স্বর্গ-নরকে সাধারণের আস্থা কমে যাওয়াই নৈতিক অবনতির কারণ। Pie in the sky আর hell fire, অর্থাৎ পরলোকে গিয়ে পুণ্যবান স্বর্গীয় পিষ্টক খাবে আর পাপী নরকাগ্নিতে দগ্ধ হবে, এই বিশ্বাস লোপ পাচ্ছে। কলকাতার রাস্তায় খ্রষ্টীয় বিজ্ঞাপন দেখা যায়–Jesus Christ can save to the uttermost! ফ্রেমে বাঁধানো অনুরূপ আশ্বাসবাক্য দেশী ছবির দোকানে পাওয়া যায়–একমাত্র হরিনামে যত পাপ তরে, পাপিষ্ঠের সাধ্য নাই তত পাপ করে। কিন্তু এই সব বাণীতে কোনও ফল হয় না, কারণ জনসাধারণ ইহসর্বস্ব হয়ে পড়েছে।
দৃষ্ক্রিয়া বৃদ্ধির নানা কারণ থাকতে পারে। বোধ হয় একটি প্রধান কারণ, জুয়াড়ী প্রবৃত্তি বা gambling spiritএর প্রসার। লোকে দেখছে, দুষ্কর্মাদের অনেকেই ধরা পড়ে না, যারা ধরা পড়ে তাদেরও অনেকে শাস্তি পায় না। অতএব দুষ্কর্ম করে নিরাপদে লাভবান হবার প্রচুর সম্ভাবনা আছে। এক শ জন দুষ্কর্মার মধ্যে যদি পঁচাত্তর জন সাজা না পায় তবে সেই পঁচাত্তরের মধ্যে আমারও স্থান হতে পারে, অতএব আইনের ভয়ে পিছিয়ে থাকব কেন? ঝুঁকি না নিলে কোনও ব্যবসাতে লাভ হয় না, দুষ্কিয়াও একটা বড় ব্যবসা। লোকনিন্দা গ্রাহ্য করবার দরকার নেই, আমি যদি ধনবান হই তবে আমার দুষ্কর্ম জানলেও লোকে আমাকে খাতির করবে।
বহুকালের সংস্কার সহজে মুছে যায় না, স্বর্গ নরকে বিশ্বাস কমে গেলেও পাপের জন্যে একটা প্রচ্ছন্ন অস্বস্তিবোধ অনেকের আছে এবং তা থেকে মুক্তি পাবার আশায় তারা সুসাধ্য উপায় খোঁজে। বিস্তর লোক মনে করে, গঙ্গাস্নান, একাদশী পালন, দেববিগ্রহ দর্শন, গো-ব্রাহ্মণের কিঞ্চিৎ সেবা, মাঝে মাঝে তীর্থভ্রমণ ইত্যাদি কর্মেই পাপস্খলন হয়। হরিনাম-কীর্তনে বা খ্রীষ্ট-শরণে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, এই উক্তির সঙ্গে উহ্য আছে–আগে অনুতপ্ত হয়ে পাপকর্ম ত্যাগ করতে হবে। কিন্তু লোকে কুকর্মের অভ্যাস ছাড়তে পারে না, মনে করে ভগবানের নাম নিলেই নিত্যনৈমিত্তিক সমস্ত পাপ ক্ষয় হবে। লোভী ডায়াবিটিক যেমন মিষ্টান্ন খায় আর ইনসুলিন নেয়।
আইনের ফেসাদে পড়লে লোকে যেমন উকিল মোক্তার বাহাল করে, তেমনি অনেকে পাপস্খলনের জন্য গুরুর শরণ নেয়। সেকেলে মন্ত্রদাতা গুরুর প্রতিপত্তি এখন কমে গেছে, আধুনিক জনপ্রিয় সাধু-মহাত্মারা গুরুর স্থান নিয়েছেন। তারা একসঙ্গে বিপুল ভক্তজনতাকে উপদেশ দেন, যেমন গৌতম বুদ্ধ দিতেন এবং একালের রাজনীতিক নেতারা দেন। অনেকে মনে করে, আমার মাথা ঘামাবার দরকার কি, গুরুকে যদি ভক্তি করি আর ঘন ঘন তাঁর কাছে যাই তা হলে তিনিই আমাকে রক্ষা করবেন। আমাদের দেশে– সাধুসন্তের আবির্ভাব চিরদিনই হয়েছে, জনসাধারণের কাছে তারা ভক্তি শ্রদ্ধাও প্রচুর পেয়েছেন। কিন্তু এখনকার জনপ্রিয় গুরু-গুর্বীর সন্নিধানে যে বিপুল ভক্তসমাগম হয় তা বোধ হয় বুদ্ধ আর চৈতন্যদেবের কালেও দেখা যায় নি। শ্রীরামকৃষ্ণ আর শ্রীঅরবিন্দেরও এমন ভক্তভাগ্য হয় নি।
একদিকে গুরুভক্তির তুমুল অভিব্যক্তি, অন্যদিকে দুষ্কর্মের দেশব্যাপী প্লাবন, এই দুইএর মধ্যে কার্যকারণসম্বন্ধ আছে কি? একথা বলা যায় না যে গুরুভক্তি বেড়ে যাওয়ার ফলেই দুষ্কর্মের প্রবৃত্তি বেড়ে গেছে, কিংবা গুরুরা জাল ফেলে চুনোপুঁটি রুই কাতলা সংগ্রহ করছেন। সাধুসঙ্গকামী ধার্মিক সজ্জন এখনও অনেক আছেন তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এমন হতে পারে যে দুষ্কর্ম বৃদ্ধির ফলেই সাধু মহাত্মা গুরুর চাহিদা বেড়ে গেছে, বিনা আয়াসে পাপমুক্ত হবার মতলবে এখন অসংখ্য লোক গুরুর দ্বারস্থ হচ্ছে।
ভক্ত অথচ লম্পট মাতাল চোর ঘুষখোর ইত্যাদি দুশ্চরিত্র লোক অনেক আছে। তথাপি দেখা যায়, যারা স্বভাবত ভক্তিমান তারা প্রায় শান্ত সচ্চরিত্র হয়। কিন্তু স্বাভাবিক যোগ্যতা না থাকলে কোনও লোককে যেমন গণিতজ্ঞ বা সংগীতজ্ঞ করা যায় না, তেমনি কৃত্রিম উপায়ে অপাত্রকে ভক্তিমান করা যায় না। মামুলী নৈষ্ঠিক ক্রিয়াকর্ম করলে বা স্তোত্র আবৃত্তি করলে চিত্রের পরিবর্তন হবার সম্ভাবনা অতি অল্প। পুরোহিত মন্ত্র পড়ান–অপবিত্র বা পবিত্র যেকোনও অবস্থায় যদি পুণ্ডরীকাক্ষকে স্মরণ করা হয় তবে বাহ্য আর অভ্যন্তর শুচি হয়ে যায়। কেবল নাম স্মরণেই যদি দেহশুদ্ধি আর চিত্তশুদ্ধি হত তবে লোকে অতি সহজে দিব্যজীবন লাভ করত। গোঁড়া আচারনিষ্ঠ স্ত্রীপুরুষও কত মন্দ হতে পারে তার অনেক চিত্র শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে পাওয়া যায়।