কোনও সাহিত্যিকের রচনা ভাল কি মন্দ তার বিচার সমালোচকরা ধীরে সুস্থে করেন। তাঁদের মানদণ্ড অনির্দেশ্য, সকলে তা প্রয়োগ করতে পারে না। যদি বিদগ্ধতার খ্যাতি থাকে তবে পাঠক-সাধারণ তাদের অভিমতই মেনে নেয়। মত প্রকাশে দেরি হলেও ক্ষতি হয় না। কিন্তু সিনেমা-ছবির নির্বাচন অবিলম্বে করতে হয়, সেনসর-বোর্ড বেশী সময় নিতে পারেন না। তারা কিরকম মানদণ্ড অনুসারে শ্লীলতা-অশ্লীলতা বিচার করবেন?
সেনসর-বোর্ডের সদস্যদের রুচি যদি মোটামুটি একরকম হয় তবে বিচার কঠিন হবে মনে করি না। তাদের অতিমাত্রায় উদার না হওয়াই উচিত। যদি তারা মনে করেন, কোনও ছবি দেখে এক শ দর্শকের মধ্যে দশজনের চিত্তবিকার হতে পারে তবে সে ছবি মঞ্জুর করবেন না। মনোবিজ্ঞানীরা যাকে psychosomatic effect বলেন, অর্থাৎ মানসিক উত্তেজনার ফলে দৈহিক বিকার (পূর্বে উদ্ধৃত Sydney Moseleyর উক্তিতে তারই ইঙ্গিত আছে)–তার সম্ভাবনা থাকলে সে ছবি অবশ্যই বর্জন করবেন। বিদেশে সে ছবি দেখানো হয় কিনা, ভারতের অন্য প্রদেশের সেনসর-বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে কিনা–তা ভাববার দরকার নেই। যা তাদের নিজের বিচারে অবাঞ্ছিত, এখানকার সেনসর-বোর্ড তা অবশ্যই নিষিদ্ধ করবেন।
সম্প্রতি শ্ৰীযুক্ত চপলাকান্ত ভট্টাচার্য বলেছেন, পরিবারের সকলে যে ছবি একসঙ্গে দেখতে পারে শুধু সেই ছবিই মঞ্জুর করা উচিত, প্রাপ্তবয়স্ক আর অল্পবয়স্কর জন্য ভেদ রাখা অন্যায়। এই প্রস্তাব অতি সমীচীন। কেবল প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য–এই কথা বিজ্ঞাপনে লিখলেই অল্পবয়স্কদের লোভ বাড়ানো হয়।
আর্টের অসংখ্য উপাদানের মধ্যে কিঞ্চিৎ কামকলার প্রয়োজন থাকতে পারে। সিনেমা আর সাহিত্যে তার প্রয়োগ যদি সংযত করা হয় তবে আর্ট আর সংস্কৃতি চর্চার কিছুমাত্র ক্ষতি হবে না।
[এই প্রবন্ধের সাত বৎসর আগে (১৯৫১) একই কথা লিখেছেন পরশুরাম-রামধনের বৈরাগ্য গল্পে। তাতে বোধহয় আধুনিক অশ্লীল বাঙলা সাহিত্যের ইন্ধন ছিল! –স:।]
ধর্মশিক্ষা
ধর্মশিক্ষা (১৮৮১/১৯৫৯)
আমাদের দেশে সব রকম দুষ্কর্ম আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। চুরি ডাকাতি প্রতারণা ঘুষ ভেজাল ইত্যাদি দেশব্যাপী হয়েছে, অনেক রাজপুরুষ আর ধুরন্ধর ব্যবসায়ীর কর্মে অসাধুতা প্রকট হয়েছে, জননেতাদের আচরণেও অসংযম আর গুণ্ডামি দেখা দিয়েছে, ছেলেরা উদ্ধৃঙ্খল দুর্বিনীত হয়েছে। অনেক সরকারী অফিসে কাজ আদায়ের জন্য চিরকালই আমলাদের ঘুষ দিতে হত। এখন তাদের জুলুম বেড়ে গেছে, উপরওয়ালাদের বললেও কিছু হয় না, তারা নিম্নতনদের শাসন করতে ভয় পান।
প্রাচীন ভারতে চোরের হাত কেটে ফেলা হত। বিলাতে দেড় শ বৎসর আগে সামান্য চুরির জন্যও ফাঁসি হত। রাজা রতন রাও কুলনারীহরণের জন্যে নিজের পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এই রকম কঠোর শাস্তির ভয়ে দুর্বত্তরা কতকটা সংযত থাকত, কিন্তু একেবারে নিরস্ত হত না।
সমাজরক্ষার জন্য যথোচিত দণ্ডবিধি অবশ্যই চাই, কিন্তু তার চাইতেও চাই এমন শিক্ষা আর পরিবেশ যাতে দুষ্কর্মে প্রবৃত্তি না হয়। অনেকে বলেন, বাল্যকাল থেকে ধর্মশিক্ষাই দুষ্পবৃত্তির শ্রেষ্ঠ প্রতিষেধক। রিলিজস এডুকেশনের জন্য বিলাতে আইন আছে, সকল খ্রীষ্টান ছাত্রকেই বাইবেল পড়তে হয় এবং তৎসম্মত ধর্মোপদেশ শুনতে হয়। বিভিন্ন শ্রেণীর নিষ্ঠাবান খ্রীষ্টান মাত্রেই এই শিক্ষা অত্যাবশ্যক মনে করেন। কিন্তু যুক্তিবাদী র্যাশনালিস্টরা (যাঁদের মধ্যে অনেক খ্যাতনামা মনীষী আছেন) বলেন খ্রীষ্টীয় বা অন্য কোনও ধর্মের ভিত্তিতে মরালিটি বা সামাজিক কর্তব্য শেখানো শুধু অনাবশ্যক নয়, ক্ষতিকরও বটে, তাতে বুদ্ধি সংকীর্ণ হয়।
বাল্যকাল থেকে সুনীতি আর সদাচার শিক্ষা কর্তব্য, এ সম্বন্ধে মতভেদ নেই। কিন্তু সেকিউলার বা লোকায়ত ভারত-রাষ্ট্রের প্রজার জন্যে এই শিক্ষার ভিত্তি কি হবে? শিক্ষার্থীর সম্প্রদায় অনুসারে হিন্দু জৈন শিখ মুসলমান খ্রীষ্টান প্রভৃতির ধর্মশাস্ত্র, অথবা শাস্ত্রনিরপেক্ষ শুধুই নীতিবাক্য?
রিলিজন শব্দের বাঙলা প্রতিশব্দ নেই। ক্ৰীড বা নির্দিষ্ট বিষয়ে আস্থা না থাকলে রিলিজন হয় না। হিন্দুধর্ম ঠিক রিলিজন নয়, কারণ তার বাঁধাধরা ক্রীড নেই। কিন্তু যেমন মুসলমান আর খ্রীষ্টীয় ধর্ম, তেমনি জৈন শিখ বৈষ্ণব আর ব্রাহ্ম ধর্মও রিলিজন। ভারতীয় ছাত্র যদি মুসলমান খ্রীষ্টান জৈন শিখ বৈষ্ণব ব্রাহ্ম ইত্যাদি হয় তবে তার সাম্প্রদায়িক ক্ৰীড অনুসারে তাকে শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু সাধারণ হিন্দু ছাত্রকে কিংবা মিশ্র সম্প্রদায়ের বিদ্যালয়ে কি শেখানো হবে? শুধু অল্পবয়স্কদের জন্যে ব্যবস্থা করলে চলবে না, প্রাপ্তবয়স্করাও যাতে কুকর্মপ্রবণ না হয় তার উপায় ভাবতে হবে।
ধর্ম শব্দের শাস্ত্রীয় অর্থ অতি ব্যাপক–যা প্রজাগণকে ধারণ করে। অর্থাৎ সমাজহিতকর বিধিসমূহই ধর্ম, যাতে জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হয় তাই ধর্ম। ইংরেজীতে gentlemanএর একটি বিশিষ্ট অর্থ–chivalrous wellbred man। জেন্টলম্যান বা সজ্জনের যে লক্ষণাবলী, তা যদি বহুগুণ প্রসারিত করা হয় তবে তাকে ধর্ম বলা যেতে পারে। শুধু ভদ্র আচরণ, মার্জিত আলাপ, সত্যপালন, দুর্বলকে রক্ষা করা ইত্যাদি ধর্ম নয়, শুধু ভক্তি বা পরমার্থতত্ত্বের চর্চাও ধর্ম নয়। স্বাস্থ্য বল বিদ্যা উপার্জন সদাচার সুনীতি বিনয় (discipline) ইন্দ্রিয়সংযম আত্মরক্ষা দেশরক্ষা পরোপকার প্রভৃতিও ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গ। বঙ্কিমচন্দ্র তার ধর্মতত্ত্ব গ্রন্থে যে গুণাবলীর অনুশীলন ও সামঞ্জস্য বিবৃত করেছেন তাই ধর্ম। মানুষের সাধনীয় ধর্মের এমন সর্বাঙ্গীণ আলোচনা আর কেউ বোধ হয় করেন নি।