আসলে তখনও, পরশুরাম গল্পসমগ্র প্রায় কণ্ঠস্থ করলেও রাজশেখর প্রবন্ধাবলী ক্কচিৎ পড়েছি। আজ সমস্ত পড়ে উপলব্ধি করছি দুজনের রচনার গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য। পরশুরামের প্রতিটি গল্পে শেষরক্ষা দৃঢ় শৃংখলিত; রাজশেখর বসুর সব প্রবন্ধে সমগ্র বক্তব্য উপস্থাপনের পরেই আকস্মিক abrupt সমাপ্তি। রবীন্দ্রকাব্যবিচারেও তা স্খলিত হয় নি।
রবীন্দ্রনাথের পরম স্নেহধন্য রাজশেখরের–যার অধিকাংশই আজও সাধারণের অজানা-রবীন্দ্রনাথের প্রতি শেষ ঐহলৌকিক শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে রবীন্দ্রলোকে প্রত্যাবর্তন মোটেই সমাপতন নয়। বোধহয় বহুপূর্বনির্ধারিত ছিল।
–দীপংকর বসু]
স্নেহদ্রব্য
স্নেহদ্রব্য (১৮৮১/১৯৫৯)
বাঙালীর রান্নায় সরষের তেল আর ঘি বহুকাল থেকে চলে আসছে। কুড়ি-পঁচিশ বৎসর আগে পঞ্জাবী আর উত্তরপ্রদেশীকে বলতে শুনেছি, সরষের তেল খেলে পেট জ্বলে যায়, কিন্তু এখন তারাও খেতে আরম্ভ করেছে। গান্ধীজী বলতেন, লংকা আর সরষের তেল বিষবৎ ত্যাজ্য। কিন্তু লংকাখোর দক্ষিণভারতবাসীর জঠর এপর্যন্ত দগ্ধ হয় নি, বাঙালীর জঠরও সরষের তেলে স্নিগ্ধ আছে, যদিও কেউ কেউ বিষাক্ত ভেজাল তেল খেয়ে রোগে পড়েছেন।
বনস্পতি নাম কোন মহাপণ্ডিত চালিয়েছেন জানি না। সরকার এই উৎকট নাম মেনে নিয়েছেন। এর আভিধানিক অর্থ–পুষ্পব্যতিরেকে ফলজনক বৃক্ষ, অশ্বত্থাদি; বৃক্ষ মাত্র (শব্দসার)। হিন্দীতে বনস্পতি মানে উভিদ। যদি সেই অর্থই ধরা হয় তা হলেও উদভিজ্জ তৈলজাত দ্রব্যবিশেষের নাম বনস্পতি হবে কেন? গরু থেকে দুধ হয়, দুধ থেকে ঘি। সে কারণে ঘিকে গরু বলা চলে কি? এই প্রবন্ধে হাইড্রোজেনেটেড অয়েলকে সংক্ষেপে হাইড্রোতেল বলব। বিভিন্ন কারখানায় প্রস্তুত এই দ্রব্য ডালডা, রসোই, কুসুম, পকাও ইত্যাদি নানা নামে বিক্রি হয়।
গত যুদ্ধের আগে ঘি আর সরষের তেলের যে দাম ছিল এখন তার পাঁচ ছ গুণ হয়েছে। হাইড্রোতেল প্রায় পঁয়ত্রিশ বৎসর পূর্বে বিদেশ থেকে আসতে আরম্ভ করে। প্রথম প্রথম হোটেলের রান্নায়, ময়রার ভিয়ানে, আর ঘিএর ভেজালে চলত, কিন্তু সাধারণ গৃহস্থ তা পছন্দ করত না, যদিও দাম ছিল দশ আনা সেরের কাছাকাছি, অর্থাৎ ঘিএর অর্ধেক। অনেকে মনে করত, বস্তুটি অপকারী, অন্তত তার ফুড-ভ্যালু কিছু নেই। হাইড্রোতেল সম্বন্ধে সাধারণের ভয় ক্রমশ দূর হল, গৃহস্বামীর আপত্তি থাকলেও গৃহিণীরা লুকিয়ে আনাতে লাগলেন। কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের কত্রী আমাকে বলেছিলেন, কি করা যায় বলুন, ছেলেগুলো রাক্ষসের মতন লুচি খাচ্ছে, কাহাতক ঘি যোগান? (ঘি তখন পাঁচ সিকে সের)।
এখন এদেশে প্রচুর হাইড্রোতেল তৈরি হচ্ছে, জনকতকের আপত্তি থাকলেও জনসাধারণ বিনা দ্বিধায় খাচ্ছে। কিন্তু সম্প্রতি এই বস্তুটির বিরুদ্ধে নূতন অভিযোগ উঠেছে, এবং সবিশেষ জানবার জন্য অনেকে আগ্রহী হয়েছেন। এই প্রবন্ধে তেল ঘি হাইড্রোতেল প্রভৃতি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করছি।
স্নেহ (fat)— ইংরেজী ফ্যাট শব্দের অর্থ প্রাণিদেহের চর্বি, কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় মাখন ঘি আর উভিজ্জ তেলও ফ্যাটএর অন্তর্গত। এই ব্যাপক অর্থে ফ্যাট সংজ্ঞার প্রতিশব্দ রূপে অনেকে লেখেন, চর্বি বা চর্বিজাতীয় দ্রব্য। ইংরেজী প্রয়োগের অন্ধ অনুকরণে সরষে তিল ইত্যাদির তেলকে চর্বি বললে আমাদের সংস্কারের উপর পীড়ন হয়। বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গে ফ্যাটএর প্রতিশব্দ স্নেহ বা স্নেহদ্রব্য লেখাই ভাল, তাতে ভুল বোঝবার সম্ভাবনা থাকবে না।
স্নেহাম্ল (fatty acid)— স্নেহ শব্দের এক অর্থ স্নিগ্ধতা, চিক্কণতা, বা তেলা ভাব। ভ্যাসেলিন, লুব্রিকেটিং অয়েল প্রভৃতিও চিক্কণ, কিন্তু তাদের রাসায়নিক গঠন স্নেহ বা ফ্যাটের তুল্য নয়। স্নেহ মাত্রেরই প্রধান উপাদান গ্লিসারিন এবং কয়েক প্রকার স্নেহাম্ল বা ফ্যাটি অ্যাসিড। রসায়ন শাস্ত্রে যাকে অম্ল বা অ্যাসিড বলা হয় তার স্বাদ টক নাও হতে পারে। অধিকাংশ স্নেহাম্ল টক নয়।
অপূরিত (unsaturated) ও প্রপূরিত (saturated)— প্রত্যেক স্নেহাম্লের অণুতে কতকগুলি কার্বন হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের পরমাণু থাকে। এই সব পরমাণুর বিন্যাস ও সংখ্যা এক-এক স্নেহাম্নে এক-এক প্রকার। এক শ্রেণীর স্নেহাম্লে আরও হাইড্রোজেন পরমাণু জুড়ে দিতে পারা যায়, অপর শ্রেণীতে তা পারা যায় না। প্রথম শ্রেণীকে বলা হয় অপূরিত (অনসাটুরেটেড), অর্থাৎ যতটা হাইড্রোজেন থাকতে পারে ততটা নেই, হাইড্রোজেনের কিছু আসন খালি আছে। অপর শ্রেণীর স্নেহাম্লকে বলা হয় প্রপূরিত (সাটুরেটেড), অর্থাৎ এগুলিতে পূর্ণমাত্রায় হাইড্রোজেন আছে, আসন খালি নেই।
বিভিন্ন তেলে আর ঘিএ যে স্নেহাম্ল থাকে তার মধ্যে অপূরিত আর প্রপূরিতর শতকরা হার মোটামুটি এই রকম–
অপূরিত—প্রপূরিত
সরষের তেল—৫০—৫০
তিল তেল—৮৫—১৫
চীনাবাদাম তেল—৭৫-৮৭—২৫-১৩
নারকেল তেল—২—৯৮
ঘি (গাওয়া ভঁয়সার কিছু তারতম্য আছে)—২৯—৭১
সরষে তিল আর চীনাবাদাম তেলে অপূরিত স্নেহাম্ল প্রচুর আছে, এই সব তেল শীতকালেও তরল থাকে। নারকেল তেল আর ঘিএ প্রপূরিত বেশী, ঠাণ্ডায় জমে যায়।
রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন সংযোগ করলে অপূরিত স্নেহা প্রপূরিত হয়ে যায়, তার ফলে তরল তেল গাঢ় হয়। যোজিত হাইড্রোজেনের মাত্রা অনুসারে তেলের রূপ ঘিএর মতন নরম, ছাগল-ভেড়ার চর্বির মতন জমাট বা মোমের মতন শক্ত করা যায়। এদেশে ৯ ভাগ চীনাবাদাম তেলে ১ ভাগ তিল তেল মিশিয়ে তাই থেকে হাইড্রোতেল তৈরি হয়, কিন্তু সবগুলির গাঢ়তা সমান নয়। হাইড্রোতেলের কথা পরে হবে, এখন সাধারণ তেলের কথা বলছি।