আপনি অঙ্কপাত করে অনায়াসে এক গুগল অর্থাৎ ১এর পর ১০০ শূন্য লিখতে পারেন, লাইনটি লম্বায় চার-পাঁচ ইঞ্চির বেশী হবে না। কিন্তু গুগলপ্লেক্স লেখবার চেষ্টা করবেন না, পাগল হয়ে যাবেন। কাগজে কুলোবে না, ঘরেতেও নয়, পৃথিবীতেও নয়, আকাশের অতিদূরস্থ নক্ষত্র পর্যন্ত শূন্যের পর শূন্য বসিয়ে যেতে হবে।
গন্ধর্ব পুষ্পদন্ত যে মহিম্নস্তব রচনা করেছেন তার একটি শ্লোকে আছে–
সমুদ্র যদি মসীপাত্র হয়, তাতে যদি অসিতগিরিসম স্তূপীকৃত কজ্জল গোলা হয়, সুরতরুর শাখা যদি লেখনী হয়, ধরণী যদি পত্র হয় এবং শারদা যদি সর্বকাল লিখতে থাকেন, তথাপি হে মহেশ, তোমার গুণাবলীর পারে পৌঁছতে পারবেন না। পুষ্পদন্ত যদি আধুনিক গণিতের সংখ্যা জানতেন তা হলে সংক্ষেপে বলতে পারতেন, হে মহেশ, তোমার গুণরাশি গুগলপ্লেক্সের চাইতেও বেশী।
সংখ্যাবিশারদরা অনেক রকম অদ্ভুত হিসাব করেছেন। মানবজাতি যখন প্রথম বলতে শিখল তখন থেকে এখন পর্যন্ত মোট কত কথা বলেছে? শিশুর আধ-আধ কথা প্রেমালাপ গালাগালি রাজনীতিক বক্তৃতা ইত্যাদি সব নিয়ে ১এর পিঠে মোটে ১৬টা শূন্য, গুগলের চাইতে ঢের কম।
নোবেল-পুরস্কৃত এডিংটন হিসাব করেছেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত প্রোটন আছে তার সংখ্যা ১৩৬.২x১এর পর ২৫৬ শূন্য। ইলেকট্রনের সংখ্যাও তাই। অর্থাৎ গুগলের চাইতে বেশী কিন্তু গুগলপ্লেক্সের চাইতে কম।
আমাদের গ্যালাক্সি বা ছায়াপথে কত তারা আছে? জ্যোতিষীরা অনুমান করেন, ৩,০০০ কোটি থেকে ১০,০০০ কোটির মধ্যে, অর্থাৎ ৩এর পর ১০ শূন্য এবং ১এর পর ১১ শূন্যর মধ্যে। গুগলের চাইতে ঢের কম।
দাবা খেলার যত চাল হতে পারে তার সংখ্যা কত? আগে ১এর পর ৫৯ শূন্য বসান। যে সংখ্যা পাবেন তত শূন্য ১এর পর বসান। গুগলের চাইতে বেশী কিন্তু গুগলপ্লেক্সের চাইতে কম।
এইবার অতি ক্ষুদ্র রাশি সম্বন্ধে কিঞ্চিৎ বলে এই প্রবন্ধ শেষ করব। আমাদের শাস্ত্রোক্ত অণু-পরমাণু কি বস্তু তা বোঝা যায় না। সংস্কৃত অভিধানে এসরেণুর অর্থ–ছয় পরমাণুর সমষ্টি, অথবা গবাক্ষচ্ছিদ্রাগত রৌদ্রে দৃশ্যমান চঞ্চল সূক্ষ্ম পদার্থ। জীববিজ্ঞানে কীটের চাইতে কীটাণু ছোট, তার চাইতে জীবাণু বা মাইক্রোব ছোট, তার চাইতে ভাইরস ছোট (অণুবীক্ষণে অদৃশ্য)। রসায়নের অণু আরও ছোট, পরমাণু তার চাইতে ছোট, প্রোটন আরও ছোট, ইলেকট্রন সব চাইতে ছোট।
সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মের উত্তম উদাহরণ হোমিওপ্যাথিক ঔষধ। মাদার টিংচারে যে মূল বস্তু থাকে তার ১০ ভাগের ১ ভাগ থাকে প্রথম ডাইলিউশনে। তৃতীয় ডাইলিউশনে ১,০০০ ভাগের ১ ভাগ! দ্বাদশ ডাইলিউশনে লক্ষ কোটি ভাগের ১ ভাগ। শততম ডাইলিউশনে থাকে ১ গুগলের ১ ভাগ। হোমিওপ্যাথরা বলেন, ডাইলিউশন বৃদ্ধিতে ঔষধের পোটেন্সি বৃদ্ধি হয়। অবিশ্বাসীরা বলেন, ১০০ ডাইলিউশনে পৌঁছবার আগেই এমন অবস্থা হয়। যে এক শিশিতে অণু-প্রমাণ ঔষধও থাকে না। বিশ্বাসী বলেন, তোমার অঙ্কশাস্ত্র যাই বলুক, অণু-প্রমাণ ঔষধও থাকুক বা না থাকুক, স্পষ্ট দেখছি উপকার হয়, অতএব তর্ক না করে খেয়ে যাও, বিশ্বাসেই কৃষ্ণলাভ হয়।
অতি সূক্ষ্মের আর একটি উদাহরণ–ব্যাঙের আধুলির গল্প। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের কঙ্কাবতীতে তার ভাল বর্ণনা আছে। ব্যাঙ তার বন্ধুকে একটি আধুলি ধার দিয়েছিল। শর্ত এই ছিল যে প্রতি কিস্তিতে অর্ধেক শোধ। করতে হবে। প্রথম কিস্তিতে চার আনা, দ্বিতীয়তে দু আনা, তার পর যথাক্রমে এক আনা, দু পয়সা, এক পয়সা আধা পয়সা ইত্যাদি। ব্যাঙ হিসাব করে দেখল, তার পাওনা কোনও দিন শোধ হবে না, একটু বাকী থাকবেই। সে মনের দুঃখে কাঁদতে লাগল। ব্যাঙ যদি বুদ্ধিমান হত তবে বুঝত যে কয়েক কিস্তি পরেই বাকীর পরিমাণ নগণ্য হয়ে যাবে, অনন্তকাল তাকে অপেক্ষা করতে হবে না।
অন্তরকলন বা differential calculusএর আবিষ্কর্তা লাইবনিৎস সম্বন্ধে একটি গল্প আছে। একদিন তিনি পুশিয়ার রানীকে বললেন, যদি অনুমতি দেন তবে আজ আপনাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র infinitesimal রাশির রহস্য বুঝিয়ে দেব। রানী বললেন, আপনাকে বোঝাতে হবে না, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাকে বলে তা এখানকার এই সভাসদের আচরণ থেকেই আমি টের পাই।
[পরশুরামএর শেষ রচনা–দাঁড়কাগ, ১-৬-১৯৫৯এ লেখা। ১৫-৬এ আর একটি গল্প–জামাইষষ্ঠী–আরম্ভ করেও কোনদিন তা শেষ করেন নি। এর পর প্রায় দশ মাস জীবিত ছিলেন পরশুরাম; কিন্তু তাঁর কুঠার অবনমিত ছিল।
রাজশেখর বসু কিন্তু এই সময়ে পাঁচটি প্রবন্ধ লেখেন। তার কলম থামে মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে–রবীন্দ্রকাব্যবিচার লিখে।
রবীন্দ্ৰশতবর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে, কলকাতা বেতারএর পক্ষে শ্রীঅমল হোমের অনুরোধে এই প্রবন্ধ রচনা আরম্ভ করেন ১৭-৪-১৯৬০এ, তার চিরাচরিত নিয়মে পেনসিলে লিখে; শেষ হয় ২৬ এপ্রিল। (এও তাঁর চিরকালীন অভ্যাস–সব কিছুরই তারিখ লিখে রাখা।) ২৭ এপ্রিল সকালে এর একপাতা ফেআর কপিও করেন। বেলা একটা নাগাদ অকস্মাৎ নিঃশব্দ নিষ্ক্রমণ।
লেখাটা আর হল না–অমল হোমকে জানানো হয়েছিল। কিন্তু কয়েকমাস পরে কাগজপত্রের মধ্যে এটির আবিষ্কর্তা-রাজশেখরের সব রচনার দিশারী–আমি। রবীন্দ্ৰশতবর্ষে যথাসময়ে এটি কলকাতা বেতারে পঠিত হয়।
এটি পড়ে দশ বৎসর আগে আমার ধারণা হয়েছিল আসন্ন মৃত্যুর আভাস এতে আছে, একটি শৃংখলাবদ্ধ সূচনা মাঝপথে দিশা হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লিখেছিলুম–এও কি সেই রাজশেখরীয় সংক্ষিপ্ততা?