শ্রীপ্রমথনাথ বিশীর কোনও বইএ পড়েছি, অক্ষয়কুমার দত্ত অহরহ ভাবতেন, ব্রহ্মাণ্ড কি প্রকাণ্ড! শেষ বয়সে তার মাথার অসুখ হয়েছিল, নিরামিষ ছেড়ে আমিষ খেতে শুরু করেছিলেন। প্রকাণ্ড ব্রহ্মাণ্ডের চিন্তাই বোধ হয় তার অসুখের কারণ।
বিপুল, বিশাল, বিরাট, ভূমা, অসীম ইত্যাদি শব্দের একটা মোহিনী শক্তি আছে। অত্যন্ত বৃহতের চিন্তা আমাদের একটু অভিভূত করে, তার উপলব্ধিতে আমরা বিস্ময়াবিষ্ট হই, আনন্দিত হই, কিঞ্চিৎ ভয়ও পাই। অদৃষ্টপূর্ব বিশ্বরূপ দর্শন করে অর্জুন হর্ষিত অর্থাৎ রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন, তাঁর মন ভয়ে প্ৰব্যথিত হয়েছিল। আবার কেউ কেউ বিপুলতা থেকে আশ্বাসও পান। ভবভূতি তার জীবদ্দশায় অবজ্ঞাত ছিলেন। মালতীমাধব নাটকের প্রস্তাবনায় এই বলে তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছেন কাল নিরবধি, পৃথিবীও বিপুলা; কোনও কালে কোনও দেশে এমন লোক থাকতে পারেন যিনি আমার সমানধর্মা এবং এই রচনার গুণগ্রহণে সমর্থ।
.
আকাশ সমুদ্র হিমালয় ইত্যাদির বিশালতা কবিকে ভাবাবিষ্ট করে। দেশ আর কাল নিয়ে দার্শনিকরা চিরকাল মাথা ঘামিয়েছেন, এই দুই বিরাট পদার্থের কি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, না শুধুই আমাদের অধ্যাস বা illusion? এখনও তারা এ রহস্যের সমাধান খুঁজে পান নি। বিজ্ঞানীরা সমস্তই মাপতে চান, তাদের মানদণ্ড একদিকে বেড়ে চলেছে, আর একদিকে সূক্ষ্মাদপি সূক্ষ্ম হচ্ছে, আগে যে সংখ্যা পর্যাপ্ত মনে হত এখন তাতে কুলয় না। সেকালেও লোকের ধারণা ছিল যে আকাশে অসংখ্য তারা আছে, কিন্তু শুধু চোখে যা দেখা যায় তার সংখ্যা তিন হাজারের বেশী নয়, লোকে তাই অসংখ্য মনে করত। এখন যন্ত্রের যত উৎকর্য হচ্ছে ততই বেশী তারা দেখা যাচ্ছে, লক্ষ থেকে কোটি, তার পর বহু কোটি।
এক শ বৎসর আগে পাশ্চাত্ত্য দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত লোক বাইবেলের উক্তি অনুসারে বিশ্বাস করতেন যে খ্রীষ্টজন্মের প্রায় চার হাজার বৎসর পূর্বে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল। উনিশ শতকের মধ্যভাগে ভূবিজ্ঞানী লায়েল বললেন, পৃথিবীর বয়স কয়েক হাজার নয়, কয়েক কোটি বৎসর। তার পর ডারউইন আর ওআলেস প্রচার করলেন, লক্ষ লক্ষ বৎসর ব্যাপী ক্রমিক পরিবর্তনের ফলে পুরাতন জীব থেকে নব নব জীবের উদ্ভব হয়েছে। তখনকার গোঁড়া খ্রীষ্টানরা (মায় বিলাতের প্রধান মন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন) এই মতের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগলেন, কিন্তু তর্কযুদ্ধে পরাস্ত হলেন। আধুনিক গবেষণায় স্থির হয়েছে, পৃথিবীর বয়স কয়েক কোটি নয়, বহু কোটি বৎসর।
আমাদের শাস্ত্রোক্ত সৃষ্টিতত্ত্বের কালপরিমাণ আরও বিপুল। চতুর্যগ = ৪৩ লক্ষ ২০ হাজার বৎসর। এক মন্বন্তর = ৩০ কোটি ৬৭ লক্ষ ২০ হাজার বৎসর। ব্রহ্মার এক অহোরাত্র = ২৮,৮০০ কোটি বৎসর। ব্রহ্মার আয়ু = ১০,৩৬৮র পর ১২ শূন্য দিলে যত হয় তত বৎসর।
প্রচলিত ধারাপাতে সংখ্যার এই তালিকা দেখা যায়–এক, দশ, শত, সহস্র, অযুত, লক্ষ, নিযুত (million), কোটি, অবুদ, বৃন্দ, খর্ব, নিখর্ব, শঙ্খ (billion), পদ্ম, সাগর, অন্ত্য, মধ্য, পরাধ। বৃন্দএর অন্য নাম অজ। Prof N W Pirie, FRS ১৯৫৪ সালে লিখিত Origin of Life প্রবন্ধে অজ শব্দ প্রয়োগ করেছেন।
পরার্ধ মানে ১এর পিঠে ১৭ শূন্য। ছেলেবেলায় আমরা যে ধারাপাত পড়তুম তাতে পরার্ধের পরেও অনেক সংখ্যা ছিল। তাদের নাম ভুলে গেছি, শুধু শেষের দুটি মনে আছে–পার, অপার। আমাদের যিনি অঙ্ক শেখাতেন তাকে জিজ্ঞাসা করলুম, অপারের পরে কোন্ সংখ্যা? তার বিদ্যা বেশী ছিল না, উত্তর দিলেন, অপার সব চাইতে বড়, তার পরে আর সংখ্যা নেই। আমি বললুম, কেন, অপারের পিঠে তো আরও শূন্য জুড়ে দেওয়া যায়। তিনি বললেন, তাতে তোর লাভটা কি? অপারের বেশী টাকাও তোর হবে না, কইবিচিও হবে না। মাস্টারমশাই রিয়ালিস্ট ছিলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ-কথিত পিঁপড়ের মতন। চিনির এক কণায় যদি পেট ভরে তবে বস্তার সন্ধান করা বোকামি।
বিজ্ঞানীরা টাকা গোনবার জন্য সংখ্যা চান না, যেসব বৃহৎ বা সূক্ষ্ম বা রাশি রাশি বস্তু নিয়ে তাদের কারবার, তার পরিমাপের জন্যই সংখ্যা দরকার। লক্ষ, কোটি, মিলিয়ন, বিলিয়ন ইত্যাদিতে এখন কাজ চলে না। তারায় তারায় দূরত্ব মাপা হয় আলোকবর্ষ (প্রায় ৬এর পর ১২ শূন্য মাইল), অথবা parsec (প্রায় ১৯ এর পর ১২ শূন্য মাইল) দিয়ে, অতি সূক্ষ্ম বস্তু মাপা হয় Angstrom unit দিয়ে (১ সেন্টিমিটারের ১০ কোটি ভাগের ১ ভাগ)।
খ্যাতনামা গণিতজ্ঞ দার্শনিক A N Whitehead লিখেছেন-Let us grant that the pursuit of mathematics is a divine madness of the human spirit, a refuge from the goading emergency of contingent happenings। অর্থাৎ ধরা যেতে পারে, গণিতের চর্চা এক রকম দিব্যোন্মাদ, ঝঞ্জাট থেকে নিষ্কৃতি পাবার উপায়। হোআইটহেডের যদি ভারতীয় অলংকার শাস্ত্র পড়া থাকত তা হলে হয়তো লিখতেন–গণিতচর্চায় যে আনন্দ লাভ হয় তা ব্রহ্মস্বাদসহোদর।
যাঁরা খাঁটী গাণিতিক তারা সংখ্যা নির্ধারণ করেই খুশী, তা দিয়ে কি মাপা হবে সে চিন্তা তাদের নেই। Edward Kasner একজন বিখ্যাত মার্কিন গণিতজ্ঞ। খেয়ালের বশে একদিন তিনি একটা সংখ্যা স্থির করলেন–১এর পিঠে ১০০ শূন্য। তাঁর ন বছরের ভাইপোকে বললেন, ওরে, একটা নাম বলতে পারিস? ভাইপো বলল, googol। নামটি গ্রীক লাটিন বা ইংরেজী নয়, ছোট ছেলের স্বচ্ছন্দ বালভাষিত, যেমন হাটটিমাটিমটিম। কিন্তু এই গুগল নাম এখন সর্বস্বীকৃত হয়েছে। কাসনার তার ভাইপোকে আবার বললেন, গুগলের চাইতে ঢের বড় একটা সংখ্যা বলতে পারিস? ভাইপো বলল, পারি, একের পিঠে দেদার শূন্য বসিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না হাতে ব্যথা হয়। কাসনার বললেন, তা হলে তো একটা মূর্খ পালোয়ানের কাছে। আইনস্টাইনকে হেরে যেতে হবে, সংখ্যার নির্ধারণ গায়ের জোরে হতে পারে না। তখন ভাইপো চিন্তা করে বলল, একের পিঠে এক গুগল শূন্য, এর নাম হক googolplex। কাসনার বললেন, তথাস্তু, গাণিতিক সমাজও তাই মেনে নিলেন।