বেদের এক নাম শুতি, কারণ গুরুশিষ্যপরম্পরায় মুখে মুখে আর শুনে শুনে বেদাধ্যয়ন হত। প্রাচীন ভারতের লিপির প্রচলনের পরেও বেদাভ্যাসের এই পদ্ধতি বজায় ছিল, এখনও কিছু কিছু আছে। পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতরা সহজে প্রশংসা করেন না, কিন্তু তারাও মেনেছেন যে অন্তত তিন হাজার বৎসর যাবৎ বেদবিদ্যা মুখে মুখেই চলে আসছে এবং অপরিবর্তিত আছে। শুধু তার বাক্য নয়, উদাত্ত অনুদাত্ত স্বরিত ভেদে তার উচ্চারণ বা পঠনরীতিও প্রায় যথাযথ রক্ষিত হয়েছে। এই আশ্চর্য ঘটনার কারণ, বেদের প্রতি ভারতবাসীর অসীম শ্রদ্ধা। বাঙলা দেশে বেদচর্চা প্রায় লোপ পেয়েছিল, সেজন্য মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ কয়েকজন বাঙালী পণ্ডিতকে শুদ্ধ পাঠ শেখবার জন্য কাশী পাঠিয়েছিলেন। এখনও ব্রাহ্ম উপাসনায় প্রাচীন রীতিতে উপনিষদাদির শ্লোক উচ্চারিত হয়।
শুধু বেদ নয়, সংস্কৃত কাব্য পাঠের রীতিও অতি প্রাচীন এবং সর্বত্র প্রায় একরকম। কিন্তু বাঙালীর সংস্কৃত উচ্চারণে বিকার এসেছে। শুনেছি কোনও এক পণ্ডিত রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, সংস্কৃত বাক্য রচনার যেমন গৌড়ী আর বৈদভী রীতি আছে তেমনি বাঙালীর সংস্কৃত উচ্চারণকে গৌড়ী রীতি রূপে মেনে নিতে দোষ কি? এই উক্তির জন্য তিনি ধমক খেয়েছিলেন। আমরা সংস্কৃত কবিতা সুর করে পড়তে জানি না, নীরস গদ্যের মতন পড়ি; কিন্তু ভারতের অধিকাংশ প্রদেশে সুর করে পড়াই রীতি। বিহারী উত্তরপ্রদেশী মরাঠী গুজরাটী এবং দ্রাবিড় পণ্ডিতরা প্রায় একই সুরে সংস্কৃত কাব্য আবৃত্তি করেন। এই চিরাগত রীতির কারণও সংস্কৃতের প্রতি শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ।
আমাদের দেশের অনেক ওস্তাদ মনে করেন, গান-বাজনা গুণিজনের স্বচ্ছন্দ বিহার বা কসরতের ক্ষেত্র, যদি নির্দিষ্ট সুর আর তাল মোটামুটি বজায় রাখা হয় তবে কর্তব বা সুর ভাঁজায় গায়কের চিরন্তন অধিকার আছে। গান যদি বেওয়ারিশ হয় কিংবা গানের বাক্য যদি তুচ্ছ আর সুরের বাহন মাত্র হয় তবে কর্তবে আপত্তির কারণ থাকতে পারে না। কিন্তু রচয়িতা যদি কবিতার সঙ্গে তাল মান লয় যোগ করে গান রচনা করেন তবে তার অলংকরণের অধিকার গায়কের থাকে না। কালিদাস পার্বতী-পরমেশ্বরকে বাগর্থ তুল্য সম্পৃক্ত বলেছেন। কবি যখন গান রচনা করেন তখন বা আর অর্থের সঙ্গে সুরও সম্পৃক্ত করেন, অর্থাৎ কবিরচিত গানে কবিতার সঙ্গে সুরের অচ্ছেদ্য ও অপরিবর্তনীয় বন্ধন ঘটে।
রবীন্দ্রকাব্যের বাক্যের পরিবর্তন যেমন গর্হিত, রবীন্দ্রসংগীতের সুরের পরিবর্তন বা অলংকরণও তেমনি গর্হিত। মনালিসার বাঁকা হাসি যদি ভাল না লাগে তবে অতি বড় চিত্রবিশারদেরও তা সোজা করবার অধিকার নেই। যিনি মনে করেন, নির্দিষ্ট রীতিতে না পেয়ে রবীন্দ্রসংগীত আরও শ্রুতিমধুর করে গাওয়া যেতে পারে, তার উচিত অন্য গান রচনা করে তাতে নিজের– সুর দেওয়া।
রবীন্দ্র-জন্মদিন
রবীন্দ্র-জন্মদিন (১৮৮১/১৯৫৯)
কোনও মহাপুরুষের উদ্দেশে লোকে যখন সমবেতভাবে শ্রদ্ধার অর্ঘ দেয়। তখন এক বা একাধিক প্রতীক উপলক্ষ্য করেই তা দিয়ে থাকে। এই প্রতীক প্রতিমূর্তি হতে পারে, কৃতির নিদর্শন হতে পারে, জন্মস্থান সাধনাস্থান বা জন্মদিনও হতে পারে। যদি অসংখ্য অনুরাগী জন একই কালে বা একই স্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তবে সেই শ্রদ্ধা বিপুলতা পায়।
পঁচিশে বৈশাখে অনেক লোক জন্মেছে, কিন্তু একাধিক রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয় নি। অতএব এই তারিখের কোনও নিজস্ব নিরপেক্ষ মহত্ত্ব নেই। ফলিত জ্যোতিষে যাঁদের আস্থা আছে তারা হয়তো বলবেন, শুধু দিন ক্ষণ তিথি নক্ষত্র নয়, আরও অনেক রকম জটিল যোগাযোগ চাই, তবেই রবীন্দ্রনাথের তুল্য পুরুষের উদ্ভব হতে পারে। যাঁরা কার্যকারণের অনন্ত শৃঙ্খলা মানেন তারা বলবেন, শুধু জ্যোতিষিক সমাবেশ নয়, অসংখ্য কারণপরম্পরার ফল স্বরূপ রবীন্দ্রনাথের উদ্ভব হয়েছিল, কিন্তু তার নির্ণয় আমাদের অসাধ্য।
তীর্থস্থানের মাহাত্ম্য দেবতার অধিষ্ঠানের জন্য নয়, বহু কাল যাবৎ অগণিত ভক্তের সমাগমের ফলে সামান্য স্থানও পুণ্যভূমি হয়ে ওঠে। চৈত্র শুক্ল-নবমী, ভাদ্র-কৃষ্ণ-অষ্টমী, ক্রিসমাস ডে প্রভৃতির পুণ্যতা রামচন্দ্র শ্রীকৃষ্ণ বা যিশুখ্রীষ্টের জন্মের জন্য নয়, অসংখ্য ভক্ত একই দিনে শ্রদ্ধা নিবেদন করে, সেই কারণেই তা পুণ্যদিন। পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্রনাথের জন্ম একটি আকস্মিক ঘটনা। তিনি যদি সামান্য লোক হতেন তবে এই দিন কেউ গ্রাহ্য করত না। তিনি অসামান্য, তাই এই দিনকে উপলক্ষ্য করে গুণগ্রাহী ভক্তজন সমবেতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করে, এবং তার ফলেই এই দিনটি পুণ্যময় পর্বদিনে পরিণত হয়েছে।
বুদ্ধ খ্রীষ্ট চৈতন্যদেব প্রভৃতির যে বিবরণ সমকালীন লোকরা রেখে গেছেন তার কতটা ইতিবৃত্ত আর কতটা পৌরাণিক বা mythical তার নির্ণয় সহজ নয়। ধর্মনেতা বা অবতারদের চরিতকথায় কালক্রমে অতিরঞ্জন এসে পড়ে। ভাগ্যক্রমে রবীন্দ্রনাথ ধর্মনেতা ছিলেন না এবং তিনি স্বয়ং স্মৃতিকথা লিখে গেছেন। যারা তার অন্তরঙ্গ ছিলেন তাঁদের অনেকে কবির কথা লিখেছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন তারা এখনও লিখছেন। পঞ্চাশ ষাট সত্তর বৎসর পরে এই সাক্ষাৎদর্শীদের কেউ জীবিত থাকবেন না, তখন তাদের লিখিত বিবরণ আর কবির স্বরচিত আত্মকথাই আমাদের ঐতিহাসিক সম্বল হবে।