গাজ্জালি নিজের সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ভারাতুর কল্পনা প্রয়োগ ক’রে দিয়েছেন এ-নারীদের রূপের ইন্দ্ৰিয়উত্তেজক, আধুনিক দৃষ্টিতে হাস্যকর, বর্ণনা [দ্র রফিক (১৯৭৯, ৩০২)] :
সেখানে অন্সরাসদৃশ পুণ্যময়ী নারীরা রয়েছে, আল্লাহ তাদের আলোকের দ্বাবা সৃষ্টি করেছেন, তারা যেন মরকত ও প্রবালের মতো। আনতনয়না সে-নারীরা তাদের স্বামী ব্যতীত আর কোরো প্ৰতি দৃষ্টিপাত করে না, জ্বিন ও মানবদের মধ্যে কেউই তাদের ইতিপূর্বে স্পর্শ কবে নি, তাদের স্বামীরা যখনই তাদের সাথে মিলিত হবে তখনই তাদেব কুমারী দেখতে পাবে ; তাদের শলায় থাকবে নানা রঙেব সত্তরটা ক’রে হার, কিন্তু সেগুলো তাদে্র শরীরে একটা কেশের মতোও ভারী মনে হবে না। যেমন কাচের গোলাসের লাল শরাব বাইরে থেকে দেখা যায় তেমনি তাদের অস্থি, মাংস, চর্ম, কণ্ঠনালীর মধ্য দিয়ে তাদের সর্বাঙ্গ দেখা যাবে। তাদের মাথায় চুল মুক্তা ও পদ্মরাগমণি দ্বা্রা সুশোভিত থাকবে।
বেহেশত পুরুষের বিলাসস্থল, সেখানে পার্থিব নারী বা স্ত্রীদের স্থান নেই। পৃথিবীতে তারা চুক্তিবদ্ধ দাসী, স্বর্গে অনুপস্থিত বা উপেক্ষিত। ইসলামি আইনে নারীকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে এ-দৃষ্টিকোণ থেকেই।
শরিয়া আইনের উৎস কোরান ও সুন্নাহ, এ-আইনও ঐশী। তবে এতে প্রাকইসলাম আরবের নানা রীতির মধ্য থেকে বিশেষ কিছু রীতিকে বেছে নিয়ে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে ইসলামি রীতি বা আইনরূপে। প্রাকইসলাম আরবের সে-সমস্ত রীতিই গৃহীত হয়েছে ইসলামে, যা খর্ব করে নারীর অধিকার; যা আগের স্বাধীন নারীকে পরিণত করে পুরুষের দাসীতে। ইসলামি আইন বিবর্তনশীল নয়, তাই দেশেদেশে মুসলমান নারীর মৌলিক অধিকার চোদ্দো শো বছর আগে যা ছিলো, এখনো তাই আছে; তবে নানা দেশে নারীকে দেয়া হয়েছে এমন কিছু অধিকার, যা ইসলামসম্মত নয়। বাঙলাদেশি ও সৌদি নারীর মূল অধিকার একই, যদিও বাঙলাদেশি নারী সৌদি নারীর থেকে কিছুটা বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে, ধর্মের বিধি অনুসারে যা তার প্রাপ্য নয়। এ-আইন নারীকে দিয়েছে কিছুটা সম্পত্তির অধিকার, যা অন্য কোনো সনাতন আইন দেয় নি; তবে এ-আইনে দুটি নারী একটি পুরুষের সমান, আর স্বামী হচ্ছে নারীর প্রভু। অনেক মুসলমান দেশে এখন সংবিধানে বলা হয় নারীপুরুষের অধিকার সমান, কিন্তু বিশেষ আইনে এসে দেখা যায় ওই সাম্য সংবিধানের সৌন্দৰ্য বাড়িয়েছে, কিন্তু নারীকে রাখা হয়েছে পুরুষের অধীনে। যেমন, কাতারের সংবিধানে (১৯৭০ : বিধি ৯) বলা হয়েছে ; ‘জাতি, লিঙ্গ বা ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক ভোগ করবে সমানাধিকার’; তবে কাতারে, ও আরো নানা মুসলমান রাষ্ট্রে, নারীর ভোটাধিকারই নেই। মরক্কোর সংবিধানে এক জায়গায় নারীদের আইনগত, রাজনীতিক, ও আর্থনীতিক সমানাধিকার দেয়া হয়েছে, কিন্তু একটু পরেই আরেক বিধিতে নারীকে ক’রে তোলা হয়েছে স্বামীর আইনসঙ্গত দাসী। এ-বিধিতে বলা হয়েছে : স্ত্রী বাধ্য ও বিশ্বস্ত থাকবে স্বামীর কাছে, স্বামীর পিতামাতা ও আত্মীয়স্বজনদের সম্মান করবে, এবং স্ত্রী যদি নিজের বাপমাকেও দেখতে যেতে চায়, তখনো স্বামীর অনুমতি নিতে হবে [দ্র নিউল্যান্ড (১৯৭৯, ২৪)]। ইসলামি আইনে স্বামীর বাধ্য থাকা স্ত্রীর আইসঙ্গত দায়িত্ব। এ-আইন স্ত্রীকে কিছুটা আর্থ অধিকার দিয়ে তাকে বেঁধে রেখেছে বহু ব্যক্তিগত অসুবিধার শেকলে।
পিতৃতান্ত্রিক আইনে বিয়ে হচ্ছে নারীবলি, শরিয়ায়ও তাই। ইসলামে বিয়ে ঐশী ধর্মানুষ্ঠান নয়, বিয়ে একটি রাসকসহীন কর্কশ চুক্তি [দ্র এম হিদায়াতুল্লাহ (১৯০৬, ২৮২)]। এ-চুক্তি দুটি সমমানুষের মধ্যে নয়, অসম মানুষের মধ্যে; তাই ইসলামে বিয়ে এক অসম চুক্তি, যাতে পুরুষটি ভোগ করে চুক্তির সুবিধা আর নারীটি ভোগ করে পীড়ন। এ-আইনে স্ত্রী হয়ে ওঠে। চুক্তিবদ্ধ দাসী; সে নিজেকে চুক্তি ক’রে সমর্পণ করে একটি পুরুষের খেয়ালখুশির কাছে। বিয়ের চুক্তিকে এঙ্গেলস (১৮৮৪, ২২৮) তুলনা করেছিলেন মালিক ও শ্রমিকের অসম চুক্তির সাথে। তিনি দেখান যে মালিক ও শ্রমিক যখন চুক্তি করে, তখন কাগজেকলমে মনে হয় যেনো তারা স্বেচ্ছামূলক চুক্তি করেছে; আইন এ-নিয়েই খুশি থাকে। মালিক পক্ষ যে বেশি শক্তিশালী, তার চাপ যে মারাত্মক, আইন মাথা ঘামায় না তা নিয়ে; যতোক্ষণ চুক্তি বলবৎ থাকে ততোক্ষণ মনে করা হয় যে তারা ভোগ করছে সমান অধিকার। বিয়ের চুক্তিও এমনি; আইন এটুকুতেই সন্তুষ্ট যে দু-পক্ষই সম্মতি জানিয়েছে। বাস্তব জীবনে কী ঘটছে, সে সম্পর্কে আইনের উদ্বেগ নেই। ইসলামি আইনে বিয়ের চুক্তি মালিক-শ্রমিকের চুক্তির থেকেও ভয়াবহ ও শোষণমূলক, কেননা এখানে চুক্তি ক’রেই একজনকে দেয়া হয় অশেষ অধিকার এবং আরেকজনের প্রায় সমস্ত অধিকার বাতিল হয় কিছু সুযোগসুবিধার বিনিময়ে। ইসলামি আইনে স্ত্রী হচ্ছে চুক্তিবদ্ধ দাসী, যে স্বামীকে দেবে যৌনতৃপ্তি ও বৈধ সন্তান, কিন্তু স্বামী যখন ইচ্ছে মনের খেয়ালে শুধু তিনবার ‘তালাক’ বলে ছেড়ে দিতে পারবে তাকে। চুক্তির কথা বলা হলেও ইসলামি বিয়েতে পুরুষ ও নারীটি চুক্তিতে আসে না, চুক্তিতে আসে পুরুষ ও নারীর অভিভাবক। বিয়েতে নারীর সম্মতির কথাও বলা হয়, কিন্তু তা সম্মতির অভিনয়। ইসলামি বিয়ের চুক্তির ব্যাখ্যা আনোয়ার আহমদ কাদারির বই থেকে, কিম্ভূত বাঙলায়, অনুবাদ করেছেন এক ভাষ্যকার। তাঁর অনুবাদ : ‘ইহা এমন এক চুক্তি যাহার দ্বারা একজন পুরুষ কর্তৃক একজন নারীকে সম্ভোগের অধিকার দ্বারা দখল করা বুঝায়’ [দ্র মোঃ মজিবর (১৯৮৯, ৫৩)]। ইসলামি বিবাহ চুক্তির নৃশংসতা স্পষ্ট ধরা পড়েছে উৎকট বাঙলায় অনুদিত ভাষ্যটিতে। বিয়েতে একটি পুরুষ ‘দখল করে’ একটি নারীকে; দখল করে ‘সম্ভোগের অধিকার দ্বারা’! ‘সম্ভোগ’ ও ‘দখল’ দুটিই নৃশংস প্রভুর কাজ। এ-চুক্তির অনন্ত সুফল উপভোগ করে পুরুষ, নারী হয় শিকার। ‘ক্রীতদাসীও এমনভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে নিজেকে সমর্পণ করে না প্রভুর কাছে যেভাবে করে মুসলমান স্ত্রী। ইসলামে বিয়ে যেহেতু চুক্তি, তাই তা চিরস্থায়ী নয়; যে-কোনো সময় স্বামী তা বাতিল করতে পারে। তবে এতেও পুরুষ সুখ পায় নি, তারা নিয়েছে একেবারে অস্থায়ী চুক্তির সুবিধাও, যা দেখা যায় শিয়া সম্প্রদায়ের ‘মুতা’ বিয়েতে। মুতা বিয়ে হচ্ছে এক বিশেষ সময়ের জন্যে, একদিনের বা একরাতের জন্যেও হ’তে পারে, বিয়ে বা যৌনচুক্তি। এ-বিয়ের চুক্তিতে নারী হয়ে ওঠে শুধুই উপভোগ্য মাংস।