কিন্তু পুরুষের সঙ্গে তাকে জড়িত হ’তে হয়, এবং বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সে দেখতে পায় নারীকে বন্দী করার কৌশল : ‘অম্বর যখন প্রথম দাড়াইয়াছিল, তখন অম্বরের উত্তরীয়ে গাঁটছড়া বাধা–কাজেই বাণীকেও সেই সঙ্গে বাধ্য হইয়াই দাড়াইতে হয়। সে অমনি ঘোর বিরক্ত হইয়া ভাবিল,–এই ত প্ৰভুত্ব আরম্ভ হইয়া গেল। দেখিতেছি!–উনি দাড়াইলে দাড়াইতে হইবে, চলিলে চলিতে হইবে। আমায় যেন কিনিয়া ফেলিয়াছেন।’ অম্বরনাথ তার অযোগ্য, তাকে সে বিয়ে করেছে সম্পত্তি রক্ষার জন্যে; মহৎ অম্বরনাথও স্বামীর অধিকার দাবি না ক’রে রাজি হয়েছে তাকে উদ্ধার করতে; তবু বাণীর মনে হইতে লাগিল, আজ এ গৃহের সম্রাজী সে হইলেও এ ব্যক্তি তাহার প্রভু। তাহার উপর যেন ইহার একটা দখলীস্বত্ব জন্মিয়া গিয়াছে।’ তার মনে জাগে হিন্দু নারীর মহাপ্রশ্ন : ‘হিন্দুর সব ভাল, কেবল এইটিই বড় মন্দ। বিবাহ করিতে হইবে। কেন,–এমন কঠোর নিয়ম, কেন? মেয়ে হইয়া জনিয়াছি বলিয়া এতই কি মহাপাতক করিয়াছি… যিনি আমারই অন্নে প্রতিপালিত হইবেন, তিনিই হইবেন আমার প্রভু?’ যে-বিয়েকে এতো ঘেন্না করে নারী, তাতেই বসতে হয় তাকে। বিয়ের পর বাণী মিলিত হয় নি। স্বামীর সাথে, তার স্বামী দেবতার অধিক মহত্ত্ব দেখিয়ে দূরে চ’লে গেছে। তবে অনুরূপা দেবী এর পর বাণী ও নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ক’রে বাণীকে দীক্ষিত করতে থাকেন পিতৃতন্ত্রের বিধিবিধানে, স্বামীকে ক’রে তুলতে থাকেন দেবতা। তিনি ছক ভেঙেছেন শুধু ছকটিকে আরো শক্ত ক’রে নির্মাণ করার জন্যে। তিনি বাণীর মধ্যে ঢোকাতে থাকেন বেদমন্ত্র, তাকে ক’রে তুলতে থাকেন। মহাসতী : ‘বাণী গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিল। হিন্দুর মেয়ে যে স্বামীর সহিত হাসিমুখে কেমন করিয়া জ্বলন্ত চিতায় পুড়িয়া বিচ্ছেদের শান্তি করিত আজ তাহা বুঝিলাম। এ যে কি অচ্ছেদ্য বন্ধন!… সেই যে কালমন্ত্র. সেই অনুজ্ঞার সম্মোহনবিদ্যা প্রভাবে লুপ্তচৈতন্যবৎ হইয়া পত্নী সেই দিনই পতির হৃদয়ে হৃদয়, চিন্তায় বাক্যে চিন্তা বাক্য সমস্তই সঁপিয়া দেয়; তাহার। আর স্বাতন্ত্র্য কিছুই বাকি থাকে না।’ অনুরূপা বাণীর কানে বাজাতে থাকেন পিতৃতন্ত্রের গীতিকা : ‘তাহার কানের কাছে সেই মুহূৰ্ত্তে যেন বাজিয়া উঠিল, ‘স্ত্রীলোকের স্বামী ভিন্ন অন্য সুখ নাই, অন্য কামনা নাই, এমন কি, অন্য দেবতাও নাই।’–সে ঈষৎ শিহরিয়া উঠিল। এ কি মার কথা–না দেবতার আদেশ?’ এটা আসলে পিতৃতন্ত্রে দীক্ষিত অনুরূপার চক্রান্ত।
অনুরূপা বেদমন্ত্র দিয়ে বাণীকে পুরুষপুজোয় আগ্রহী ক’রে তোলেন : ‘যদি প্রতিমায় তাহার পূজা করি, তবে মানুষের মধ্যেই বা না করি কেন?’ লেখিকা বাণীকে ক্রমশ দীক্ষিত করতে থাকেন পিতৃতান্ত্রিক বিধানে, আলোর নামে তাকে ঠেলে দিতে থাকেন। অন্ধকারে : ‘এইরূপে তাহার জীবনে একসঙ্গে দুইটী আলো জুলিয়া উঠিতেছিল,–নারীজীবনের সারধৰ্ম্ম পতিপ্ৰেম, অপরটিী সকল প্রেমের সারা ভগবৎপ্ৰেম।’ বাণীর মধ্যে তিনি জাগিয়ে তোলেন ছকবাধা এক নারীকে : ‘স্বামী স্ত্রীর গুরু কেন, আজ তাহা বুঝিতেছি। আর কে আমায় এমন করিয়া এ শিক্ষা দিতে পারিতি?’ অনুরূপা কাজ করেছেন। পুরুষতন্ত্রের চর হিশেবে; তিনি নারীকে প্রথম নিজের অধিকার দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে পরে বেঁধেছেন শেকলে, বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন নিজের লিঙ্গের সাথে। তার চক্রান্তে বাণী হয়ে ওঠে। পুরুষের প্রিয় ছকবাধা নারী : সেই ভীস্মমুষ্টি পরে পতিপ্রেমের অমৃত্যভিষেকে এবং নিৰ্ব্বাসিত অম্বরের মন্ত্রশক্তি তেজে তপঃপূত-চরিত্রা, ব্ৰহ্মচারিণী, স্নেহ প্রেম করুণার জীবন্ত মূৰ্ত্তি এক সতী নারীর প্রতিষ্ঠা করিল।’ বাণী সমগ্ৰ নারীজাতিকে নিয়ে আত্মসমর্পণ করে স্বামী ও পিতৃতন্ত্রের পায়ে : ‘হ্যা, তোমার বাণী, তোমারই স্ত্রী, তোমারই দাসী, তোমারই সহধৰ্ম্মিনী।…আমি তোমায় অনেক কষ্ট দিয়েছি, তবু আমি তোমার স্ত্রী, তোমার শিষ্যা-তোমার দাসী। আমায় ক্ষমা করিবে না কি?’ যে-বাণী স্বামীর দেহও কখনো ছোয় নি, সে মৃত্যুর হাত থেকে স্বামীকে ফিরিয়ে আনার জন্যে অবতীর্ণ হয় সতীরূপে : ‘এ নূতন জন্মে মৃত্যুর কাছে তোমায় ভিক্ষা করে ফিরিয়ে নিয়ে তোমায় আমি আমার করুব। পারব না? কেন পারব না? সাবিত্রী তার মৃত স্বামীকে বঁচিয়েছিলেন,–আর আমি পাবৃব না?–কেন, আমি কি সতী স্ত্রী নই?’ বেদমন্ত্রদীক্ষিত এ-আধুনিক সতী তার স্বামীকে মৃত্যুর কবল থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে প্রয়োগ করে। এ-পদ্ধতি : ‘তাহার মনের মধ্যে কোথা হইতে এ প্রতীতি সুদৃঢ় হইয়া উঠিল, যে তাহা হইলেই সে তাহার এই মৃত-কল্প স্বামীকে বাচাইয়া তুলিতে পরিবে। তাহার শোণিতোষ্ণতাহীন নীল শিরার উপর সে নিজের উষ্ণশোণিত প্রবাহিত ধমনী একাগ্রচিত্তে স্থাপন করিয়া রাখিয়াছিল, যেন সেই সঙ্গে কোন অদৃশ্য শক্তিবলে সে আপনার শরীর হইতে তপ্ত শোণিত ধারা তাহার অঙ্গে সঞ্চালিত করিয়া দিতেছে. সমস্ত ইন্দ্ৰিয়দ্বার এক সঙ্গে রুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল। কেবল সেই সৰ্ব্বসমাহিত সতী চিত্তের সমুদয় শক্তিকে উদ্ধৃদ্ধ করিয়া সে তাহার মৃত্যুবৎ স্থির স্বামীর দেহে আপনার জীবন হইতে জীবনী-ধারা ঢালিয়া দিতে চাহিতেছিল।’ বেদমন্ত্র চিকিৎসাপদ্ধতিতে সে সফল হয়েছে কিনা অনুরূপা দেবী তা বলেন নি, তবে তিনি সফলভাবে একটি নারীকে বিন্যস্ত করেছেন পিতৃতন্ত্রের ছকে। নারীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ক’রে অনুরূপা অর্জন করেছিলেন জনপ্রিয়তা।