আমি আর কিছু না বলে সিগারেটটি জ্বেলে ধীরে ধীরে টানতে লাগলুম, আর মনে মনে ভাবলুম : লোকটা ভাগ্যবান, লেখাপড়ার ফলে বেদনার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আমি বদনসিব, আমার আর মুক্তি হল না। বেদনা থেকে মুক্তি আর আত্মিক মৃত্যু এক নয় কি? সহজ নিশ্চিন্ত জীবনের মূল্য কতটুকু? অসম্ভবের ক্ষুধা না থাকলে জীবনে আর থাকে কী? বন্ধুর মসৃণ জীবনের ক্রমবিকাশটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল :এমএ ডিগ্রী, বিসিএস পরীক্ষা, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, এমএলএ অথবা মন্ত্রীকন্যা, এসডিও, ম্যাজিস্ট্রেট, তার পরে সকলের যা হয় তাই। সেই শেষ অনিবার্য পরিণতি, আর বিস্মৃতি। মানে ‘তরককি’ যাকে বলে, তার সবটাই তিনি করবেন, কিন্তু প্রকৃত উন্নতি কতটুকু করবেন, তা বুঝতে পারলুম না।
মানুষ সব জায়গাতেই অর্থনীতির হাতে বন্দী, শুধু এই সৌন্দর্য ও আনন্দের ব্যাপারেই সে মুক্ত। এর জন্য প্রয়োজনীয় কেবল প্রকৃত ক্ষুধা, আর কিছু হলে ভালো, না হলেও চলে। একবার যার অন্তরে এই ক্ষুধা জেগেছে, সে-ই তার স্বাধীনতা উপলব্ধি করেছে এক অবস্তুনির্ভর আলোকে তার জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। যারা দুদিক সামলাতে চান-শ্যাম ও কুল–উভয় দিক রক্ষা করতে চেষ্টা করেন, বুঝতে হবে, তাদের জীবনে সত্যিকারের ক্ষুধার অভাব–সৌন্দর্যের ডাকে তাদের আত্মা উতলা হয়নি। এই ক্ষুধা, জাদুমন্ত্রের মতো এ এক অদ্ভুত জিনিস। যে অনুভব করলে, সে বেঁচে গেল; আর যে অনুভব করতে পারলে না, সে হতভাগ্য, এক অনির্বচনীয় আনন্দ থেকে তাকে বঞ্চিত থাকতে হল। তার কাছে তাই বড় হয়ে ওঠে অর্থ আর আচার পূজা–নিজেকে ফাঁকি দেওয়ার সবচেয়ে বড় উপায়।
ওপরের দার্শনিক মতবাদ সৌন্দর্য ও আনন্দের ব্যাপারে ক্ষুধামান্দ্য ঘটিয়ে নিশ্চেষ্টতার প্রশ্রয় দেয় বলে তাকে সাবধানে গ্রহণ করা উচিত। মানুষ অবস্থার দাস নয়, প্রভু–এটাই মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় আশ্বাসের কথা। সাধারণভাবে মানুষের দৈন্য-দুর্দশা দূর করার চেষ্টা ভালো। কিন্তু অর্থ না হলে সৌন্দর্য ও আনন্দচর্চা চলতে পারে না এবং তা ধনেরই একটা By-product–এর মতো মারাত্মক ধারণা আর নেই।
সৌন্দর্যের কথা মনে রাখলে খাওয়া-পরার কথা আপনাআপনি এসে পড়ে, কিন্তু খাওয়া-পরার কথা মনে রাখলে সৌন্দর্যের কথা মনে নাও আসতে পারে। আর সৌন্দর্যপ্রেমই খাওয়া-পরার ব্যাপারে সংযম ও শালীনতা এনে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। শুধু নিজের তৃপ্তির দিকে নজর রাখলে চলবে না, সকলেরই তৃপ্ত হওয়া দরকার–একমাত্র সৌন্দর্যপ্রেমই তা আমাদের শেখাতে পারে। কেননা, প্রকৃত সৌন্দর্যপ্রেমিকের কাছে মানুষের হাসিমুখের মূল্য অনেক।
রিনেসাঁস গোড়ার কথা ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি
বিনোস কথাটার শব্দগত অর্থ পুনর্জন্ম, অর্থাৎ পুরাতনে ফিরে যাওয়া, অথবা পুরাতনকে ফিরে পাওয়া; কিন্তু ভাবগত অর্থ নবজন্ম, মানে মানবমহিমা তথা বুদ্ধি ও কল্পনার পুনঃপ্রতিষ্ঠা। রিনেসাঁসের ইতিহাস তাই জীবন-সূর্যের পুনরোদয়ের ইতিহাস–বুদ্ধি ও কল্পনার জয়যাত্রার ইতিহাস।
য়ুরোপের ইতিহাস থেকে কথাটি নেওয়া হয়েছে। অতএব একবার সেদিকে তাকানো দরকার।
য়ুরোপের মধ্যযুগ শাস্ত্রশাসনের যুগ–পোপের সর্বময় প্রভুত্বের যুগ। বুদ্ধিবিচার, অনুভূতি-কল্পনা প্রভৃতি মানবীয় গুণসমূহের প্রতি এ-যুগ আস্থাহীন। জগৎ ও জীবনের প্রতি এযুগের বিস্ময়-দৃষ্টি নেই, বরং এসবকে তা পতনের ফাঁদ বলেই গণ্য করে। সৌন্দর্যও প্রেম, এসব তো শয়তানের কারসাজি, সুতরাং এদের জব্দ করা আর শয়তানকে জব্দ করা এক কথা। তাই চলল আত্মবিকাশের পরিবর্তে নিদারুণ আত্মনির্যাতনের পালা। আর এই নির্যাতনে নির্যাতনে ক্ষীয়মাণ মানবাত্মা পরিণামে বিদ্রোহী হয়ে প্রশ্ন করলে এ কি সত্যি? এই জগৎ ও জীবন, এই প্রেম ও সৌন্দর্য এসব কি সত্যই মিথ্যা? এই সন্দিগ্ধ-দৃষ্টি তাকে নিয়ে গেল সত্যের সোনার সিংহদুয়ারে, সে বুঝতে পারলে জীবনচর্চাই জীবনের উদ্দেশ্য, আর প্রেম সৌন্দৰ্যকল্পনা ও বিচারবুদ্ধির অনুশীলনই জীবনের অনুশীলন। এই উপলব্বির সঙ্গে সঙ্গেই আধুনিক যুগের সুপ্রভাত। মানবমহিমা মেঘমুক্ত সূর্যের মতো প্রকাশিত হয়ে এই উজ্জ্বল প্রভাতের সৃষ্টি করলে।
জীবনপ্রীতির এই সোনার ফসল ফল গ্রিক জ্ঞানচর্চার ফলে। গ্রিক সাহিত্য, দর্শন ও শিল্পের গোড়ার কথা-যে দেহকেন্দ্রিক জীবনপ্রীতি, এ একরকম সাধারণ সত্য। কিন্তু তাই বলে গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ফিরে পাওয়াকেই রির্সোস বললে ভুল করা হবে, যেমন ভুল করা হবে উপায়কে লক্ষ্য বা লক্ষণকে আসল বস্তু বলে গ্রহণ করা হলে।
অতএব পুরাতনে ফিরে যাওয়াই রির্সোস নয়, জীবনপ্রীতি তথা বুদ্ধি, অনুভূতি ও কল্পনাপ্রীতিই রিনের্সস। ওয়ালটার পেটার বলেন : রিনের্সাস কথাটা আজকাল কেবল পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রাচীন গ্রিক-সাহিত্যপ্রীতি না বুঝিয়ে এমন এক জটিল আন্দোলন বোঝায়, গ্রিক জ্ঞানপ্রীতি যার একটা দিক বা লক্ষণ মাত্র! তার মতে রিনের্সাসের যুগ বুদ্ধি ও কল্পনার বস্তুর প্রতি আগ্রহশীল এক উদার জীবনের যুগ। কি পুরাতন, কি নতুন, বুদ্ধি ও কল্পনার বস্তুর খোঁজে এ-যুগ চঞ্চল। অবশ্য গ্রিসের প্রতি এযুগের দৃষ্টি বিশেষ ও অধিক। তার হেতুও আছে জীবনপ্রীতির এমন উজ্জ্বল সূর্য গ্রিস ছাড়া আর কোথাও উদিত হয়নি। তাই জ্বলন্ত আদর্শের জন্য সেদিকে না তাকিয়ে তার উপায় ছিল না।