(এই নিবন্ধে জীবনের বাইরের কোনো ব্যাপারের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়নি। জীবনের ভেতরেই যে শ্রেষ্ঠ-নিকৃষ্ট, সুন্দর-অসুন্দর রয়েছে তারি প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। জীবনশিল্পের মানেই এই উৎকর্ষ অপকর্ষ সম্বন্ধে সচেতনতা। জীবনশিল্পীরা উৎকৃষ্ট অপকৃষ্ট উভয়কে মেনে নিয়ে জীবনকে শিল্পের মতো ধাপে ধাপে সাজিয়ে দেন। মূল্যবোধ সম্বন্ধে তারা সম্পূর্ণ সচেতন থাকেন। প্রয়োজনের দিকটা প্রধান দিক হলেও যে শ্রেষ্ঠ দিক নয়, শ্রেষ্ঠ দিক অপ্রয়োজনের দিক, কেননা তাতেই মানুষের মুক্তি–এই বোধ না থাকলে সত্যকার জীবনশিল্পী হওয়া যায় না।
সমাজশিল্প জীবনশিল্পের বুনিয়াদ। আর জীবনশিল্প মূল্যবোধেরই অভিব্যক্তি। দার্শনিক যাকে superstructure বলেছেন, তার গোড়ায়ও মূল্যবোধ। তাই তা অবহেলিত হওয়ার মতো জিনিস নয়। বরং superstructure-এর দিকে লক্ষ্য রেখেই main structure গড়ে তোলা দরকার। নইলে সমাজ-পরিবর্তন মানুষকে বেশিদূর এগিয়ে দিতে সক্ষম হবে না। গ্রিসে superstructure (সৌন্দর্যজগৎ) প্রাধান্য লাভ করেছিল।*[* শিল্প ও জ্ঞানের জন্য যদি পৃথিবীতে কোনো জাতি বেঁচে থাকে, তবে তা ঠিক জাতি। গ্রিসে প্রতি তিন ব্যক্তির মধ্যে এক ব্যক্তি হয় ভাস্কর, নয় ভাস্করের সহকর্মী ছিল। আর্ট ও কালচার তাদের কাছে উপরি পাওনা ছিল না, ছিল জীবনের প্রধান লক্ষ্য। তাই তারা চমৎকার সভ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল।] রিনেসাঁসের ইটালিতেও। কিন্তু তাদের main structure তথা কল্যাণের জগৎ ত্রুটিবিহীন ছিল না। অনেক নিষ্ঠুরতা ও ব্যভিচারের কাহিনী তাদের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে রেখেছে। অধুনা কল্যাণের জগৎটি যথাসম্ভব ত্রুটিবিমুক্ত ও নিষ্কলুষ করে গড়ে তুলবার চেষ্টা চলেছে। সে ভালো কথা। কিন্তু superstructure-এর দিকে লক্ষ্য রাখা চাই। কেননা, তা-ই সভ্যতা। আর সভ্যতা আপনাআপনি সৃষ্ট হয় না, তার জন্য বিশেষ আগ্রহ ও যত্নের প্রয়োজন।* [ * কয়েক বছর আগে ক্লাইভ বেলকে অনুসরণ করে বিভিন্ন পত্রিকায় আমি সভ্যতা সম্বন্ধে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখি। সেগুলিতে বেল সাহেবের কথাই ছিল বেশি, আমার কথা সামান্য। বর্তমান প্রবন্ধে বেল সাহেবের কথা সামান্য, আমার কথাই বেশি। তথাপি প্রেরণা ক্লাইভ বেল থেকে নেওয়া হয়েছে স্বীকার করা দরকার। নইলে বিবেকদংশনের জ্বালা ভোগ করতে হবে।]
মেরুদণ্ড
If the wicked flourish and the fittest survive, Nature must be the God of rascals.— G.B.S.
যেদিন ‘সারভাইভাল অব দি ফিটেস্ট’–এই সাধারণ সত্যটি দার্শনিকের কণ্ঠে প্রথম ঘোষিত হল, সেদিন থেকেই পৃথিবীর সর্বনাশের সূত্রপাত। কেননা, মূল্যবোধ বিস্মৃত হয়ে সেদিন থেকেই মানুষ তার শ্রেষ্ঠ গুণরাজিকে অবহেলা করে নিকৃষ্ট শক্তিসমূহের পূজার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলে, আর শুধু বাঁচার কথাটা বড় হয়ে উঠল বলে সৌন্দর্য, প্রেম ও আনন্দ মানুষের দৃষ্টিসীমা থেকে অনেক দূরে সরে গেল। সে বুঝতে পারলে, এসব গৌণ ব্যাপার, বাঁচার জন্য এসবের কোনো প্রয়োজন নেই, যদি পাওয়া যায় ভালো। অধিকন্তু ন দোষায়- না পাওয়া গেলেও তেমন দুঃখ নেই।
দার্শনিকের চেষ্টা হয় অনেক সময় ‘মাচ এডো এবাউট নাথিং’ অথবা পর্বতের মূষিক প্রসবের মতো। অনেক মাল-মশলা সংগ্রহ ও গবেষণার ফলে তারা যে-সত্যে এসে পৌঁছোন, অনেক সময় তা মামুলি সত্য ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু দর্শনের সমর্থনে তাই হয়ে ওঠে সকলের শ্রদ্ধেয় সাধারণ ব্যাপারটাও অসাধারণ হয়ে দেখা দেয়। ফিট লোকেরাই সবসময় বেঁচেছে ও বাঁচবে একথাটা বলার জন্য দার্শনিকের গবেষণার প্রয়োজন হয় না, সামান্য পর্যবেক্ষণশীলেরাও তা বলতে পারে। সুতরাং এ সিদ্ধান্তের জন্য দার্শনিকের কোনো কৃতিত্ব নেই তাঁর কৃতিত্ব সত্যে পৌঁছার জন্য তার যে আয়োজন–তাতে; উপাদান সংগ্রহ ও বিচিত্র তথ্য আবিষ্কারে মানুষ হঠাৎ-সৃষ্ট জীব নয়, জীবপরম্পরার ধারাবাহিক পরিণতি, এই সত্যের উদঘাটনে।
অথচ মানুষ সেইটেই বড় বলে গ্রহণ করলে–নাচুনে বুড়ি ঢোলের তালি পেলে যেমন আনন্দে আত্মহারা হয়, মানুষও তেমনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজের ভিতরের যুদ্ধংদেহী ভাবটিকে আঁকড়ে ধরলে–তেল সিঁদুর দিয়ে দেবতার মতো তার পূজা শুরু করলে। নিজেরা যা স্বভাবতই ভালোবাসে, দার্শনিকের সমর্থনে তাই তাদের কাছে অধিকতর প্রিয় হয়ে উঠল আর দার্শনিকরা যা ধরতে ছুঁতে পান না, মানবজীবনের সেই শ্রেষ্ঠ সম্পদ ধ্যান-কল্পনা, প্রেম-সৌন্দর্যের কদর কমতে লাগল। এসব কী? বিজ্ঞান তো এসব ঠাহর করতে পারে না। সুতরাং এদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান না হয়ে উপায় কী? সত্য তাই বিজ্ঞানের সহায়তায় যাচাই করতে গেলে মূল্যের তো কথাই নেই, এসবের কোনো অস্তিত্বই থাকে না। কেননা, মানুষ যেখানে প্রকৃতির সৃষ্টি সেখানেই বিজ্ঞানের অধিকার, যেখানে সে নিজের রচনা সেখানে বিজ্ঞান বেকার। প্রেম, সৌন্দর্য ইত্যাদি মানুষের নিজের সৃষ্টি বলে বিজ্ঞান এদের সম্বন্ধে নির্বাক অথবা সন্দিহান। কিন্তু এদের সাধনাই মনুষ্যত্বের সাধনা, তথা সভ্যতার সাধনা। যোগ্যতমের উদ্বর্তন নীতি এই সাধনার পরিপন্থী, কেননা তা শুধু বাচবার জন্য প্রয়োজনীয় নখদন্ত ও নখদন্তের স্থানীয় বন্দুক-বোমা-সঙ্গিনকেই বড় করে তোলে-উদার বুদ্ধিকে বর্জন করে সঙ্কীর্ণ বুদ্ধির আশ্রয় গ্রহণ করতে শেখায়। ফলে মানুষের অধোগতি ঘটে।