২.
আমি আশা করছি, বর্তমান সরকার আত্মতুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে ১৯৭৫ সালের সেই সময়টুকুর কথা একবার ভাববে। বঙ্গবন্ধুর খুনিরা সেই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর দুঃসাহস পেয়েছিল কারণ, তখন দেশটি ভালো চলছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অর্থনীতি বলে কিছু নেই, খাবার নেই, দুর্ভিক্ষ, বাকশাল, রক্ষী বাহিনী-সব মিলিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ ছিল হতাশ এবং ক্ষুব্ধ। এত দিন পর আমরা জানি এর অনেকটুকু ছিল দেশ এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফল, অনেকটুকুর ওপর কারও হাত ছিল না সেটি আমাদের দুর্ভাগ্য-কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারকে স্বীকার করতেই হবে, একটা বড় অংশ ছিল তাদের ভুলভ্রান্তি এবং অন্যায়-অবিচার। বঙ্গবন্ধুর দলের মানুষের অপকর্মের দায়ভারই নিতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে আর তাঁর পরিবারের মানুষকে। যদি সেই সময় আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থক আর কর্মীরা দেশটাকে এ রকম নৈরাজ্যকর একটা জায়গায় ঠেলে না দিত, এই খুনিরা তাহলে এত বড় একটা ঘটনা ঘটানোর দুঃসাহস পেত না।
আওয়ামী লীগ আবার দেশ শাসনের দায়িত্বটুকু পেয়েছে, দেশের মানুষ অনেক বড় স্বপ্ন দেখে তাদের ক্ষমতায় এনেছে। প্রতি মুহূর্তে তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে, আমার দলের মানুষ কি এই দেশের সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে দিচ্ছে? দলের মানুষ ছোট একটা লাভ করার জন্য কি পুরো দেশটাকে বিশাল একটা বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে?
আমি পুরো দেশের খবর জানি না, খবরের কাগজে অত্যন্ত খণ্ডিত একটা ছবি দেখি সেটা থেকে অনুমান করার চেষ্টা করি। সব সময় অনুমান সঠিক হয় না। কিছুদিন আগে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংগঠন বাউল সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। কোনো একটা কারণে ছাত্রলীগের ছেলেরা সেখানে হামলা করে স্টেজ ভেঙে চেয়ার-টেবিল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সাউন্ড সিস্টেম নষ্ট করে দিয়েছিল। বাংলাদেশের সব খবরের কাগজে খবরটা ছবিসহ ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। যে খবরটা ছাপা হয়নি সেটা হচ্ছে, তার পরেও সবাই মিলে অত্যন্ত চমত্কারভাবে দুই দিনের সেই বাউল সম্মেলন অনুষ্ঠানটি উদ্যাপন করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের বাইরের সবাই সেটি উপভোগ করেছে। কাজেই, খবরের কাগজ থেকে আমরা যে তথ্যগুলো পাই সেগুলো খণ্ডিত, সেগুলো পূর্ণাঙ্গ নয়।
কিন্তু যে বিষয়গুলো আমি নিজের চোখে দেখি, সেগুলো খণ্ডিত নয়, সেগুলো পূর্ণাঙ্গ। কাজেই, আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের চোখে দেখেছি, এখানে ছাত্রলীগের ছেলেরা নিজেদের ভেতর মারামারি করছে, একদল আরেক দলের ওপর হামলা করছে। সেই হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করছে, ধর্মঘট ডেকে লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, নিজেরা নিজেদের কুপিয়ে আহত করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ইন্টারনেট ব্রাউজ করার সবচেয়ে সুন্দর ল্যাবরেটরিটি ভেঙে গুঁড়ো করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে। আমি অন্তত এই একটা ঘটনার কথা বলতে পারি, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সুন্দর ডিজিটাল পরিবেশটি তারা অবলীলায় ধ্বংস করে দিয়েছে। (আমার এত মন খারাপ হয়েছিল যে আমি সেটি কখনো দেখতে যাইনি। বিশ্ববিদ্যালয় নিজের খরচে সেটি আবার ঠিক করে দিয়েছে।) শুধু যে দল বেঁধে এ রকম হাঙ্গামা হচ্ছে তা নয়, নীতিহীন নেতা তৈরি হচ্ছে, তারা মাস্তানি করছে, ছাত্রীদের অসম্মান করছে।
আমি জানি, আওয়ামী লীগের বড় নেতারা এই পুরো ব্যাপারটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলবেন, সমগ্র দেশের বিশাল কর্মকান্ডের তুলনায় এটি অত্যন্ত ক্ষুদ্র বিষয়! কিন্তু এই ছোট ছোট অসংখ্য ক্ষুদ্র বিষয় যখন একত্র হয়, তখন সেটি আর ক্ষুদ্র বিষয় থাকবে না। যখন দেশের মানুষ একদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে, ‘ধুর! এদেরকে দিয়ে কিছু হবে না। সবই আসলে এক মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ!’ তখন তাদের বুঝতে হবে, একটা খুব ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে যাচ্ছে। আমরা নিজের চোখে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট দেখেছি। তাই আমরা কোনোভাবেই হতাশ এবং ক্ষুব্ধ দেশবাসী দেখতে চাই না।
শুধু যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অসহিষ্ণু ছাত্রলীগ- যুবলীগের তাণ্ডব হচ্ছে তা নয়, আরও বড় বড় ব্যাপারও ঘটছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অত্যন্ত দক্ষ এবং কার্যকর ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। তিনি সত্ এবং নীতিবান মানুষ ছিলেন কিন্তু স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁর জীবনকে অতিষ্ঠ করে দিয়ে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করিয়েছে। আমি যতদূর জানি, পদত্যাগ পত্রে তিনি স্পষ্ট করে সেই কথা লিখে দিয়েছেন। শুধু যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ রকম ঘটনা ঘটেছে তা নয়, পাবনা বিশ্ববিদ্যালয়েও সেই একই ঘটনা ঘটেছে, ভাইস চ্যান্সেলরকে সরে যেতে হয়েছে। আমি দেশের অন্য অনেক কিছু না বুঝতে পারি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হয় আর কী না হয় সেই জিনিসটা বুঝতে পারি। তাই আমি খুব স্পষ্ট ভাষায় বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে কাজগুলো ঘটছে, সেগুলো কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এগুলো যে শুধু অনৈতিক তা নয়, এগুলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঠিক মানুষকে নিয়োগ না দিয়ে দলীয় অপদার্থ মানুষদের জোর করে ঢুকিয়ে দিলে সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি আর কোনো দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। অন্যরা শুনছে কী না জানি না, আমরা কিন্তু এই দেশের অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যুঘণ্টা শুনতে শুরু করেছি।
আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে, তাদের অনেক বড় কাজ করার সুযোগ আছে। কিন্তু অত্যন্ত সংকীর্ণ দলীয় কিছু বিষয়ে নাক গলিয়ে তারা যেন কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে না দেয়। এই অতি সাধারণ বিষয় বোঝার জন্য কি রকেটবিজ্ঞানী হতে হয়?