সব খাতা ফেরৎ দেওয়া হয়েছে, স্যারের হাতে এখন একটি মাত্র খাতা এবং স্যার সেই খাতাটা ফেরৎ না দিয়ে হাতে ধরে আছেন। স্যার হঠাৎ টেবিলে থাবা দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, “এখন তোদেরকে একটা জিনিস দেখাব, সবাই দেখ”।
স্যারের গলা শুনে সবাই সামনে তাকাল। স্যার তখন আমাকে ডাকলেন। আমি স্যারের দিকে এগিয়ে গেলাম, কাছাকাছি পৌছাতেই খপ করে আমার কানটা ধরে ফেললেন, তারপর সেটা ধরে রেখেই স্যার পরীক্ষার খাতাটা খুলে সারা ক্লাশকে দেখালেন পরীক্ষার খাতার উপরে আমার বিশাল শিল্পকর্ম। কোকাকোলার বোতল এবং হাস্যমুখী একজন মানুষ এবং বড় বড় করে লেখা “কোকাকোলা পান করুন।” ছবিটি দেখে সারা ক্লাশে একটা বিষ্ময়ধ্বনী উঠল আর স্যার আমার কান ধরে একটা ঝাঁকুনী দিয়ে বললেন, “আমার সাথে মশকরা? কোকাকোলা পান করুন?”
ক্লাশের ছেলেরা এবারে খুব আনন্দ পেল, কেউ শাস্তি পেলে সাধারণতঃ আনন্দ হয় না কিন্তু এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার, স্যার খুব রেগে যাওয়ার ভাণ করে আছেন কিন্তু আসলে যে বেশী রাগেন নি সেটা বুঝতে পারো বাকী নেই। ছেলেমেয়েরা হাত তালি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করলা। স্যার আরেক বার কান টেনে হাতে খাতাটা দিয়ে বললেন, “নে, ভাগ”।
একজন জিজ্ঞেস করল, “কত পেয়েছে, স্যার?”
“পেয়েছে সবচেয়ে বেশী। কিন্তু বেশী পেলেই কি মশকরা করবে নাকি? তাও পরীক্ষার খাতায়?”
এতদিন পর এখনো আমি বুঝতে পারি না যদি অন্য সব জায়গায় কোকাককোলার বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় তাহলে পরীক্ষার খাতায় তার একটা বিজ্ঞাপন দিলে ক্ষতি কি?
বই: আধ ডজন স্কুল
প্রকাশকাল: বই মেলা ১৯৯৬
প্রকাশ করেছে: শিখা প্রকাশনী
গ্লানিমুক্তির ডিসেম্বর
ডিসেম্বর মাসটি চমত্কার একটি মাস। এই মাসে শীতের একটা আমেজ পাওয়া যায়, বাগানে বাগানে রঙিন মৌসুমি ফুল ফুটতে শুরু করে, বাজারে শীতের সবজি উঠতে শুরু করে, বাচ্চাদের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে তাদের আনন্দ শুরু হয়, বিদেশ থেকে আপনজনেরা দেশে বেড়াতে চলে আসে, নানা ধরনের দেশি-বিদেশি কনফারেন্স শুরু হয়-কিন্তু এর কোনোটাই ডিসেম্বর মাসটিকে আলাদা করে দেখার কারণ নয়! ডিসেম্বর মাসটি চমত্কার একটি মাস, এর কারণ, এটি আমাদের বিজয়ের মাস। এই মাসে রাজাকাররা গর্তে ঢুকে থাকে-এই মাসে আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদাভাবে স্মরণ করি। এই মাসে মন্ত্রী না হয়েও আমরা গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে ফেলি। আমাদের মধ্যে যারা একাত্তরের ভেতর দিয়ে এসেছি, তারা বিজয় দিবসের কথা স্মরণ করে এখনো এক ধরনের শিহরণ অনুভব করি।
মনে হচ্ছে, এই ডিসেম্বর মাসে আরও একটা বিষয় যোগ হবে-এই মাসে বহু বছর পর আমরা পৃথিবীর একটা নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞের বিচার শেষ করে গ্লানিমুক্ত হতে পারব। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডটা অনেক দিক থেকেই ছিল অবিশ্বাস্য। এই দেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম না হলে বাংলাদেশের জন্ম হতো না। খুব সংগত কারণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অসংখ্যবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চেয়েছে; কিন্তু সাহস পায়নি। অথচ বাংলাদেশের জন্মের সাড়ে তিন বছরের মাথায় বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার তাঁকে হত্যা করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল-এটি এখনো বিশ্বাস করা যায় না। পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করার উদাহরণ খুব কম নেই। যুক্তরাষ্ট্রের লিংকন কেনেডি থেকে শুরু করে মিসরের আনোয়ার সাদাত, পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো বা ভারতের ইন্দিরা গান্ধী-ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই আমরা এ রকম অনেক উদাহরণ পেয়ে যাব। কিন্তু শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে? নববিবাহিত বধূ কিংবা ১০ বছরের শিশুসন্তান? এই হত্যাকাণ্ডের সময় ঠিক কী ঘটেছিল বহুদিন সাধারণ মানুষ সেটি জানতে পারেনি। বিচার প্রক্রিয়ার কারণে সেই হত্যাকাণ্ডের খুঁটিনাটি আবার নতুন করে প্রকাশ পেয়েছে। আমার ধারণা, যাঁরা সেই বর্ণনাগুলো পড়েছেন, তাঁদের অনেকেই ‘মানুষ’ প্রজাতির ওপর থেকেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন।
শুধু যে বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছিল তা নয়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আত্মীয়তা থাকার কারণে শেখ মণি এবং আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হত্যা করেছিল। সেনাবাহিনীর যে কর্মকর্তাকে সব মৃতদেহ সমাহিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তাঁর লেখা তালিকাটি পড়লে এখনো শিউরে উঠতে হয়। সেই দীর্ঘ তালিকায় বঙ্গবন্ধু, শেখ নাসের, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের পরিবারের সবার নামের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে একাধিক অজ্ঞাত পরিচয় ১০/১২ বছরের বালক কিংবা ‘১০ বছর বয়সী একটি ফুটফুটে বালিকা’-এর কথা। আমার খুব জানার ইচ্ছে করে, তারা কারা!
১৫ আগস্টের হত্যার মাঝে ছিল এক ধরনের পাশবিক নৃশংসতা। এর পরের হত্যাকাণ্ড, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ঠান্ডা মাথায় একটা সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র। নভেম্বরের ৩ তারিখ জেলখানায় বেছে বেছে সেই নেতাদের হত্যা করা হলো, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করে বাংলাদেশকে সামনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। জেলখানায় বন্দীদের হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই, কিন্তু সেটি করা হয়েছিল, কারণ, এই খুনিচক্র তো শুধু পাশবিক আনন্দের জন্য খুন করেনি, তারা খুন করেছিল বাংলাদেশকে তার আদর্শ থেকে চিরদিনের জন্য লক্ষ্যচ্যুত করতে।
বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সবাইকে হত্যা করার নৃশংস ঘটনার পর সবাই হয়তো ভেবেছিল বর্বরতার সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু এই দেশের মানুষ শিউরে উঠে আবিষ্কার করল, সেই বর্বরতা শেষ হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। তার ৪১ দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর খন্দকার মোশতাক আহমদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নামে পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম একটি দলিল প্রকাশ করলেন, যে দলিলে পরিষ্কার করে লেখা হলো, যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তাঁর স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূদের হত্যা করেছে, শিশু রাসেলকে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে এই দেশে কোনো মামলা করা যাবে না। পৃথিবীর নৃশংসতম খুনিরা শুধু খুনি নয়, তারা এই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষ-এই দেশের কোনো আইন তাদের স্পর্শ করতে পারবে না। ব্যাপারটি এখানেই শেষ হলো না, ১৯৭৯ সালে সামরিক আইনের অধীনে নির্বাচন করে জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে বিজয়ী হয় আর ১৯৭৯ সালের এপ্রিলের ৯ তারিখ কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ পঞ্চম সংশোধনী নামে আমাদের সংবিধানে স্থান করে নিল! এটি আমাদের সেই সংবিধান, যে সংবিধানটি এই দেশের মুক্তিযোদ্ধারা বুকের রক্ত দিয়ে যুদ্ধ করে অর্জন করেছিল। যে বঙ্গবন্ধু এই সংবিধানটি এই দেশকে উপহার দিয়েছিলেন, সেই সংবিধানে ঘোষণা করা হলো, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের এই দেশের মাটিতে বিচার করা যাবে না। এর চেয়ে উত্কট নিষ্ঠুরতার উদাহরণ কি এই পৃথিবীতে আছে?
বঙ্গবন্ধুর খুনিরা তখন দেশ-বিদেশে সগৌরবে তাদের হত্যাকাণ্ডের কথা ঘোষণা করে বেড়াচ্ছে। বহুদিন পর এই দেশের মানুষ টেলিভিশনে সেটি দেখেছে, যারা দেখেনি তারা ইন্টারনেটের ইউটিউবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী (নধহমধনধহফযঁ শরষষবৎ) লিখে খোঁজ করলেই সেটা পেয়ে যাবে। সেই হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততা কতটুকু ছিল, তাদের নিজের মুখে দেশের মানুষ, পৃথিবীর মানুষ শুনতে পারবে।
তার পর একদিন নয়, দুই দিন নয়, এক বছর নয়, দুই বছর নয়, ২১ বছর কেটে গেছে। জিয়াউর রহমানের সরকার, এরশাদের সরকার এবং খালেদার সরকার সেই খুনিদের টানা ২১ বছর বুক আগলে রক্ষা করেছে, দেশ-বিদেশে কূটনীতিকের চাকরি দিয়েছে, তাদের পদোন্নতি হয়েছে, সগর্বে তারা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সেই ইনডেমনিটি বিলটিকে আমাদের সংবিধান থেকে অপসারণ করে প্রথমবার খুনিদের আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আনার ব্যবস্থা করেছে। খুনিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। সেই বিচারকাজ শেষ হতে সময় লেগেছে ১৩ বছর।
মামলা করা যায়নি একুশ বছর, মামলা করার পর বিচারকাজ শেষ হতে সময় লেগেছে ১৩ বছর। এর মাঝে বিচারকদের নিয়োগ দেওয়া হয়নি, যাঁরা আছেন তাঁদের অনেকে বিব্রত হয়েছেন এবং সেগুলো দেখে আমরা শুধু বিব্রত হইনি, ক্ষুব্ধ হয়েছি এবং ক্রুদ্ধ হয়েছি। তার পরেও দেশের মানুষ ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে। একটা ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে ঝটপট বিচার করে খুনিদের ঝুলিয়ে প্রতিশোধের তীব্র আনন্দটুকু সহজেই পাওয়া যেত; কিন্তু সেটি করা হয়নি। এটি আমাদের দেশের বিশাল একটি অর্জন। আমরা এখন মাথা তুলে বলতে পারি, এই দেশের মাটিতে আমরা খুনিদের বিচার করে দেশকে, দেশের মানুষকে গ্লানিমুক্ত করেছি।
আত্মস্বীকৃত খুনিদের দম্ভোক্তিগুলো আমরা অসংখ্যবার শুনেছি, নতুন প্রজন্ম ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন আরও অনেক সহজে শুনতে পারে। বিচারকাজ চলার সময় আবিষ্কার করেছি, প্রাণ বাঁচানোর জন্য এখন তারা সব দায়দায়িত্ব অস্বীকার করে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে, তখন আমরা না চাইলেও আমাদের ঠোঁটের কোণে একটা বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। আমি চাই, যখন তাদের গলায় জল্লাদেরা ফাঁসির দড়িটি পরাবে, তখন অন্তত একবারও যেন তাদের সামনে শিশু রাসেল এবং ১০/১২ বছরের নাম না জানা সেই বালক বা ফুটফুটে বালিকাদের চেহারাটা ভেসে ওঠে।