৪.
গ্যাস বিক্রিয় একটা অযৌক্তিক প্রস্তাব তুলে সারাদেশে একটা বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে। আমার মনে হয় প্রস্তাবটি যে কত অর্থহীন সেটা বোঝার জন্য সবারই কয়েকটি সংখ্যার কথা জানা উচিত। প্রথম সংখ্যাটি হচ্ছে এক হাজার কোটি। বর্তমান প্রস্তাব অনুযায়ী গ্যাস রপ্তানী করা হলে বাংলাদেশ বছরে এক হাজার কোটি টাকা পাবে। আমরা যারা গুণে গুণে টাকা খরচ করি, দরদাম করে রিকশায় উঠি তাদের কাছে এক হাজার কোটি টাকা অনেক বেশি মনে হতে পারে কিন্তু একটা দেশের জন্য এক হাজার কোটি টাকা ক্ষুদ্র একটি সংখ্যা। সংখ্যাটি কত ছোট বোঝানোর জন্য মনে করিয়ে দেয়া যায় যে, বাংলাদেশে বছরে বিদ্যুৎ আর গ্যাসই চুরি হয় (system loss) এক হাজার একশ কোটি টাকার। সরকার যদি শুধু তার দায়িত্ব পালন করে বিদ্যু আর গ্যাস চুরি বন্ধ করতে পারে তাহলেই বছরে গ্যাস রপ্তানীর এক হাজার কোটি টাকা উঠে গিয়েও একশ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। এরকম একটা অবস্থায় যে কাজটি করা উচিত সেটি না করে কেন দেশকে সর্বশান্ত করার একটা ষড়যন্ত্র করতে শুরু করে দেব?
গ্যাস বিক্রি করে যে এক হাজার কোটি টাকার লোভ দেখানো হচ্ছে সেটা যে অত্যান্ত ক্ষুদ্র একাট সংখ্যা সেটা বোঝানোর জন্য সবাইকে আরো মনে করিয়ে দেওয়া যায় যে আমাদের সামরিক আর অন্যান্য অনুৎপাদনশীল খাতে বছরে খরচ হয় প্রায় পনের হাজার কোটি টাকা-সেখানে যদি দশ ভাগের এক ভাগও বাচানো যায় তাহলেই গ্যাস বিক্রির দেড় গুণ টাকা উঠে আসে। শুধু তাই নয়, এদেশে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার কোটি কালো টাকা তৈরী হয়। সরকার যদি শুধু ভালো ভালো বক্তৃতা না দিয়ে এই কালো টাকার শতকরা দুইভাগও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলেই গ্যাস রপ্তানীর সমান টাকা পাওয়া যাবে। আমি অর্থনীতিবিদ নই- এই সংখ্যাগুলো নিয়েছি ডিসেম্বরের আট তারিখে এলজিইডি ভবনে পঠিত ড. আবুল বারাকাতের প্রবন্ধ থেকে। সেখানে এর চাইতেও চমকপ্রদ তথ্য আছে। দেশের সাধারণ মানুষের সেগুলো জানা খুব দরকার। গ্যাস বিক্রি, গ্যাস বিক্রি বলে সরকার হঠাৎ করে যেভাবে ক্ষেপে উঠেছে সেটা দেখে অনেকের ধারণা হতে পারে ব্যাপারটি বুঝি আমাদের দেশের জন্য একটা বিশাল ব্যাপার।এটি করে টাকায় টাকায় দেশ সয়লাব হয়ে যাবে- আসলে সেটি একেবারেই সত্যি নয়। টাকার পরিমাণটি কম-এত কম যে সেটা নিয়ে আদৌ কেউ মাথা ঘামাচ্ছে সেটাই হচ্ছে আমাদের বিষ্ময় ও সন্দেহের কারণ। তার চাইতেও বড় কথা বাংলাদেশের সঙ্গে বিদেশী কোম্পানিগুলোর যে চুক্তি করা হয়েছে, সেখানে পাইপ লাইন দিয়ে গ্যাস বিক্রি করার কথা লেখা নেই। তাহলে হঠাৎ করে তাদের চুক্তি বাইরে একটা সুবিধা দেয়ার জন্য সবাই উঠেপড়ে লেগেছে কেন?
আমরা ঘরপোড়া গরু- তাই সিদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই। অতীতে বিদেশী কোম্পানীদের খুশি করার জন্য আমাদের দেশের স্বার্থ পুরোপুরি বিসর্জন দেওয়ার এতগুলো উদাহরণ দেখেছি (সিমিটার, মাগুড়ছড়া, কাফকো) এবং এ ব্যাপারে সকল সরকারই একরকম। তাই আমরা এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছি। অতীতে উদাহরণ দেখে বলে দেয়া যায় এই সরকার যদি গ্যাস বিক্রির এই চক্রান্ত সত্যি সত্যি কোনোভাবে কাজে লাগিয়ে ফেলে তাহলে ভবিষ্যতে নতুন কোনো ষড়যন্ত্র হবে না সেটি কে বলতে পারে? আজ থেকে চার পাচ বছর পরে হয়তো বিদেশী তেল কোম্পানির ধুরন্ধর আইনজীবীদের কৌশলী শব্দচয়নের কারণে আমরা গ্যাস বিক্রির কোনো টাকা তো পাবই না; বরং নিজেদের পকেটের ভর্তুকি দিয়ে সেই গ্যাস দিল্লিতে পৌছে দিয়ে আসতে হচ্ছে।
৫.
আমাদের সংবিধান বলেছে বাংলাদেশের এই গ্যাস সম্পদের মালিক দেশের মানুষ, সেই হিসেবে গ্যাস সম্পদে আমারও নিজের একটা মালিকানা আছে। মানুষের বাড়িঘর জমিজিরাত এরকম নানা ধরনের সহায়সম্পদ থাকে। আমার সেরকম কিছু নেই, বলা যেতে পারে গ্যাসের মালিকানায় আমার অংশটুকুই হচ্ছে আমার একমাত্র স্থাবর সম্পত্তি। রাস্তার টোকাইশিশু, রিকশাওয়ালা এবং গ্রামের চাষীরও তাতে সমান অধিকার এবং মাননীয় জ্বালানী প্রতিমন্ত্রীরও তার অংশের বাইরে এক সিএফটি গ্যাস বেশি নেই। সে সম্পদটি আমার সেটি যদি আর কেউ বিক্রি করে দেওয়ার কথা বলে তাহলে আমাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। রাস্তা দিয়ে হেটে যাবার সময় একজন দুর্বৃত্ত যদি আমার মানিব্যাগ ছিনতাই করে নেয়, তার সঙ্গে এই গ্যাস বিক্রি করার মৌলিক পার্থক্য নেই। এর মালিক আমরা এবং আমরা অনুমতি দেইনি। কাজেই এই গ্যাস বিক্রি করা হবে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে বিক্রি করা। পাইপ লাইন বসিয়ে গ্যাস বিক্রির কথা নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল না। কাজেই এই সরকারের গ্যাস বিক্রি করার কোনো নৈতিক বা আইনগত অধিকার নেই। কিছু ভাড়াটিয়া বিশেষঞ্জের কথায় তারা গ্যাস বিক্রি করতে পারবে না। একান্তই যদি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাহলে তারা গণভোটের ব্যবস্থা করবে। যতদিন এই গণভোটের ব্যবস্থা না করা হচ্ছে অনুগ্রহ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত না নেয়া হবে বুদ্ধিমানের কাজ এবং গ্যাস বিক্রি করার পরিকল্পণাটি পুরোপুরি পরিত্যাগ করা হবে দেশপ্রেমিকের কাজ। গ্যাস বিক্রি বন্ধ করতে একটি দীর্ঘ লংমার্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন আমরা সবাই জানতে চাই কত দীর্ঘ এই বিবিয়ানা লংমার্চ।