৩.
এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে রাজনীতিতে একটা বিশাল ওলট-পালট শুরু হয়ে গেছে। রাজনীতিবিদদের গালাগাল করা একটা ফ্যাশনের মতো হয়ে যাওয়ায় আমি সেটা আর করতে চাই না। বিশেষ করে এই দেশ সামরিক বাহিনী আর রাজনীতিবিদ প্রায় সমান সমান সময় শাসন করেছে, দেশের এই অবস্থার জন্য গালাগাল শুধু রাজনীতিবিদদের শুনতে হবে কেন? সবচেয়ে বড় কথা, রাজনীতিতে যত না তৃণমূল রাজনৈতিক নেতা, তার থেকে অনেক বেশি ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা আর সাবেক সেনা কর্মকর্তা। যেসব রাজনৈতিক নেতা সারা জীবন পথেঘাটে ঘুরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে মিশে মিশে রাজনীতি করে এসেছেন, তাঁরা যখন দেখেন কোনো একজন মালদার ব্যবসায়ী কিংবা আমলা কিংবা সাবেক সেনা কর্মকর্তা হঠাৎ উড়ে এসে তাঁর এলাকায় জুড়ে বসেছেন তখন তাঁরা নিশ্চয়ই একধরনের হতাশা অনুভব করেন। আমার যদি সুযোগ থাকত, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোকে বলতাম, তারা যেন তৃণমূল পর্যায়ে থেকে উঠে আসা জননেতাদের নির্বাচনের সুযোগ দেয়। ব্যবসায়ী-আমলা আর সাবেক সেনা কর্মকর্তা গাছেরটাও খেয়েছেন, এখন নিচেরটা কুড়ানোর প্রয়োজন কী? তাঁরা অন্যভাবে দেশ সেবার সুযোগ পাবেন।
তবে আমি একটা বিষয় নিয়ে সব সময়ই একধরনের বিভ্রান্তি অনুভব করে এসেছি। কোন রাজনৈতিক দলের ভেতরে কোন ধরনের কোন্দল, কে কাকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছেন, কে কতটুকু চাটুকারিতা করে করে কাছে চলে আসছেন এ খবরগুলো প্রতি মুহুর্তে আমাকে খবরের কাগজে পড়তে হয়−যারা টেলিভিশন দেখে তাদের নিশ্চয়ই সেটা দেখতে হয়, শুনতে হয়। আমাদের সাধারণ নাগরিকদের কি রাজনৈতিক দলগুলোর পারিবারিক কলহ শোনার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন আছে? আমি যে জিনিসগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর মুখে শুনতে চাই, সেগুলো একটিবারও কেন শুনতে পাই না? দেশের মানুষকে তারা কী দেবে, সেটি কেন তারা বলে না?
প্রথমেই আমি জানতে চাইব দ্রব্যমূল্য নিয়ে তারা কী ভাবছে। তারা কী জানে এ দেশের কত লাখ মানুষ হঠাৎ গরিব হয়ে গেছে? কত পরিবার খবরের কাগজ পড়া বন্ধ করে দিয়েছে? এই ঈদে কত লাখ শিশু নতুন কাপড় কিনতে পারেনি? কত লাখ মা সন্তানের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে নিজে অভুক্ত থেকেছেন? আমরা পরিষ্ককারভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে শুনতে চাই, তারা সংসদে গিয়ে নিজেদের জন্য বিনা শুল্কে গাড়ি আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেবে, নাকি এ দেশের মানুষের জন্য কিছু করবে? যদি কিছু করার পরিকল্পনা থাকে, সেটি কীভাবে করবে? কত তাড়াতাড়ি করবে?
আমি কঠিনভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের এই দুর্ভাগা দেশের ৯০ ভাগ সমস্যা মিটিয়ে দেওয়া সম্ভব শুধু শিক্ষাব্যবস্থাটাকে ঠিক করে দিয়ে। আমরা পরিষ্ককারভাবে জানতে চাই, এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থাটাকে ঠিক করে দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না। তারা বাজেটের কত অংশ এখানে দেবে। বাংলা মাধ্যম, মাদ্রাসা আর ইংরেজি মাধ্যম নামে আমরা মধ্যবিত্ত, দরিদ্র আর বড়লোকের যে তিনটি ধারা তৈরি করেছি সেটাকে একত্র করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি না। মেধাবী ছাত্রদের আবার বিজ্ঞানমুখী করবে কি না। শিক্ষকদের সম্মানজনক বেতন দেবে কি না। গাইড বই নিষিদ্ধ করে দেবে কি না। ছাত্রছাত্রীদের প্রাইভেট কোচিংয়ের পীড়ন থেকে মুক্তি দিয়ে আনন্দময় স্কুলে ফিরিয়ে আনবে কি না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি করবে কি না।
আমাদের দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি তিন ধরনের মানুষ−চাষি, পোশাককর্মী আর প্রবাসী শ্রমিক। যাদের শ্রমে এ দেশ চলছে আমরা জানতে চাইব, সেই তিন শ্রেণীর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আলাদা কোনো পরিকল্পনা আছে কি না। সারের জন্য, সেচের জন্য চাষিরা মাথা কুটে মরবে কি না। তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার সুযোগ থাকবে কি না। পোশাক কারখানার মেয়েদের সম্মানজনক বেতন দেওয়া হচ্ছে কি না। তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে কি না। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার সুযোগ আছে কি না। প্রবাসী শ্রমিকদের বিদেশে নিরাপদ জীবন যাপনের সুযোগ আছে কিনা। দেশে এলে তাদের ভ্রমণের বিষয়গুলো সহজ করে দেওয়া হচ্ছে কি না। তাদের কষ্টের অর্জনে এ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় তাদের সেই প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়া হচ্ছে কি না।
আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে জানতে চাইব, তারা আমাদের ইলেকট্রিসিটি দেবে কি না। দিলে কতটুকু দেবে! কবে দেবে? কীভাবে দেবে? আমরা জানতে চাইব, গ্যাস-তেল-কয়লা নিয়ে তাদের কী পরিকল্পনা? সব সময়ই আমাদের আতঙ্কে থাকতে হয়, এই বুঝি কোনো এক ষড়যন্ত্রে আমাদের সম্পদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের এই উদ্বেগ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা হবে কি না।
পরিবেশ দুষণে বাংলাদেশের বড় অংশ ভবিষ্যতে পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা শোনা যায়। আমরা শুনতে চাই, এ নিয়ে রাজনৈতিক দল কী ভাবছে? তারা কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করবে।
আমরা জানতে চাই, এ দেশে সব ধর্মের সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ পাশাপাশি সমান অধিকার নিয়ে থাকতে পারবে কি না। আমরা জানতে চাইব, নির্বাচনে জেতার পর এ দেশে আবার নতুন করে হতভাগিনী পূর্ণিমাদের হাহাকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হবে কি না। আমরা জানতে চাইব, এ দেশটিকে ধর্মান্ধ মানুষের দেশে পাল্টে দেওয়া হবে কি না। দেশের হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ধর্মের নামে জলাঞ্জলি দেওয়া হবে কি না। আমরা জানতে চাইব, এ দেশকে আধুনিক সেক্যুলার দেশ হিসেবে গড়ে তোলা হবে কি না।
আমরা কী জানতে চাই তার তালিকা দীর্ঘ−আমি শুধু অল্প কয়েকটি কথা উল্লেখ করেছি−সব এখানে লিখতে পারব বলে মনে হয় না। তবে একটা বিষয় আমরা সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে জানতে চাইব। সেটা হচ্ছে, তারা ক্ষমতায় এলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে কি না। যদি করে, তাহলে কেমন করে করবে? কত দিনের ভেতর করবে?
যে রাজনৈতিক দল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার দেবে না, সেই রাজনৈতিক দলের আর যাই থাকুক এ দেশের মাটিতে থাকার অধিকার নেই, এ দেশের বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার অধিকার নেই।
ডিজিটাল টাইম’ এবং ঘোড়ার মৃতদেহ
এই বছর জুন মাসের ১৯ তারিখ বাংলাদেশে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এ ধরনের একটা কাজ করা হবে এ রকম কানাঘুষা হচ্ছিল, আমার ধারণা ছিল এত বড় একটা ব্যাপার—সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হবে, দেশের জ্ঞানী-গুণী মানুষেরা বলবেন, এটা নেহায়েত এক ধরনের খামখেয়ালিপনা—সোজা কথায় পাগলামো। তখন আর এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হবে না। দেশ যখন রাজা-বাদশাহরা শাসন করতেন তখন তাঁরা এ রকম খামখেয়ালিপনা করতেন—কথা নেই বার্তা নেই তাঁরা পুরো রাজধানী এক শহর থেকে অন্য শহরে নিয়ে যেতেন। রাজা-বাদশাহদের সেই খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি করত না, কার ঘাড়ে দুটি মাথা আছে যে, এর প্রতিবাদ করে নিজের গর্দানটি হারাবে? আমি ভেবেছিলাম, এখন তো রাজা-বাদশাহদের আমল নয়—এখন গণতান্ত্রিক সরকার, এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই কিছু খামখেয়ালি মানুষ নিয়ে ফেলবে না।
কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, আমি অবাক হয়ে দেখলাম, দেশের ইলেকট্রিসিটি বাঁচানোর কথা বলে হুট করে একদিন ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে দেওয়া হলো! আমি দুর্বলভাবে পত্রিকায় একটা লেখা লিখেছিলাম—কিন্তু কার সময় আছে আমাদের মতো মানুষের লেখা পড়ার কিংবা সেই লেখা বিবেচনা করার? আজকে আবার লিখতে বসেছি, আগের বার যখন লিখেছিলাম তখন নিজের ভেতর যে অনুভূতিটা ছিল সেটা ছিল খানিকটা হতাশার। এখন যখন লিখছি তখন আমার ভেতরকার অনুভূতিটা রীতিমতো ক্রোধের অনুভূতি। আস্ত একটা দেশের মানুষকে প্রতারণা করা হলে যেটুকু ক্রোধান্বিত হওয়ার কথা আমি এই মুহূর্তে ঠিক সে রকম ক্রোধান্বিত। ‘ডে লাইট সেভিং’ এর কথা বলে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এখন বলা হচ্ছে, এটা বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সময় নির্ধারণের পদ্ধতির বাইরে ঠেলে দিয়ে পাকাপাকিভাবে এক ঘণ্টা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এর চেয়ে বড় প্রতারণা আর কী হতে পারে?
যে সব দেশে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে নেওয়া হয় এবং পিছিয়ে নেওয়া হয় আমি সে রকম একটি দেশে প্রায় ১৮ বছর ছিলাম। কাজেই এই ব্যাপারটি কী আমি সেটা খুব ভালো করে জানি। আমার ধারণা, কেন এই ধরনের বিচিত্র একটা কাজ করা হয় সে ব্যাপারে এ দেশের বেশির ভাগ মানুষের ধারণা ছিল না। কাজেই হুট করে যখন এটা করা হলো, তখন সবাই নিশ্চয়ই আকাশ থেকে পড়েছে। ইলেকট্রিসিটি বাঁচানোর একটা খোঁড়া যুক্তি দিয়ে ঘটনাটা ঘটানো হয়েছিল, তাই অনেক পত্র-পত্রিকাও এর পক্ষে সম্পাদকীয় লিখে ফেলেছিল, আমি আবিষ্কার করেছিলাম এর বিরুদ্ধে কথা বলার মানুষ বলতে গেলে কেউ ছিল না।
আমার ধারণা ছিল, ব্যাপারটা ঘটার পর দেশে এমন একটা গোলমাল লেগে যাবে যে, সরকার সঙ্গে সঙ্গে টের পাবে কাজটা খুব বড় ধরনের বোকামি হয়েছে। (আমার মাঝে মাঝে জানার ইচ্ছা করে, সরকারটা কে বা কী! এটা কী একটা বিমূর্ত ব্যাপার, যারা অদৃশ্য থেকে দেশের বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, কিন্তু কে ঘটনাটা ঘটিয়েছে সেটা কী কেউ জানতে পারবে না?) যাই হোক, আমি সবিস্ময়ে লক্ষ করলাম, দেশে কোনো বড় ধরনের গোলমাল হলো না, সবাই ব্যাপারটা বেশ সহজেই মেনে নিল। বলতে দ্বিধা নেই, আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম।
দেশে কেন বড় ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না, সেটা বুঝেছি অনেক পরে। আমার পরিচিত একজন হঠাত্ খুব বড় ধরনের ঝামেলায় পড়েছে, রীতিমতো পুলিশের হস্তক্ষেপ করিয়ে তাকে ঝামেলামুক্ত করা হয়েছে। মানুষটি সবিস্তারে যখন আমার কাছে ঘটনাটি বর্ণনা করছে, তখন তাকে আমি মাঝপথে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাত তখন কয়টা?’
মানুষটি বলল, ‘আসল টাইম ১০টা। ডিজিটাল টাইম ১১টা।’
আমি তখন সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলাম, এ দেশের অনেক মানুষ ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে নেওয়ার বিষয়টা গ্রহণ করেনি। তারা এখনো সেটাকে সরকারের এক ধরনের খামখেয়ালি কাণ্ড হিসেবে ধরে নিয়ে ‘আসল টাইমে’ তাদের জীবন চালিয়ে যাচ্ছে! শুধু তাই নয়, তারা সরকারের হুট করে ঘড়ির কাঁটা এক ঘণ্টা এগিয়ে দেওয়ার ফলে তৈরি হওয়া এই নতুন সময়টার নাম দিয়েছে ‘ডিজিটাল টাইম’—যদিও ডিজিটাল প্রযুক্তি বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।
এই সরকার নির্বাচনে জিতে দেশ চালানোর দায়িত্ব পেয়েছে দেশের কমবয়সী ভোটারদের ভোটে, তারা মেনিফেস্টোর দুটি বিষয়কে খুব আগ্রহের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল, একটা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার, দ্বিতীয়টি হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের অঙ্গীকার। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কথাটা খুব সুন্দর দুই শব্দে বুঝিয়ে দেওয়া যায় যে, আমরা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটা দেশ গড়তে চাইছি। শব্দটি অত্যন্ত ইতিবাচক, শব্দটির মাঝে একটা স্বপ্ন লুকিয়ে আছে।
‘ডিজিটাল টাইম’ শব্দটিতে কোনো স্বপ্ন লুকিয়ে নেই, এটা একটা টিটকারি! এটা একটা রসিকতা। সরকারের চমত্কার একটা স্বপ্নকে টিটকারিতে পরিণত করার সুযোগ যাঁরা করে দিয়েছেন তাদের কী জিজ্ঞেস করা যায়, তাঁরা কার বুদ্ধিতে এটা করেছেন?