সভা শেষে সবাই বিবিয়ানার পথে রওনা দিয়েছে। গ্রামের মেঠাপথে সবাই মিছিল করে হাঁটছে। ব্যানার আর পোস্টার, বিশাল ফাঁকা প্রান্তরের মাঝ দিয়ে আঁকাবাকা সড়ক কুশিয়ারা নদীর তীর ঘেঁষে চলে গেছে। আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি মানুষের সেই মিছিল অন্তত কয়েক কিলোমিটার লম্বা। গ্রামের মানুষজন রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে, বউঝিরা গাছের আড়াল থেকে উকি দিচ্ছে, কোথাও হাত তালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে, পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছোটছোট শিশুরা পিছু পিছু ছোটাছুটি করছে। তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ একী উত্তেজনা।
বড় কোনো মিছিলে হাঁটার আমার বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এমনিতে হাঁটতে বের হলে ক্লান্ত হলে ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেওয়া যায়। কিন্তু এখানে বিশ্রাম নেবার উপায় নেই। সবাই যে ছন্দে হাটছে আমাদেরও সেই ছন্দে হাঁটতে হবে। গ্রামের পথে হাঁটতে গেলে কতটুকু হাঁটা হয়েছে তা বের কর খুব মুশকিল। কোনো এক বিচিত্র কারণে আমাদের গ্রামের মানুষ দুরত্বকে মাইল-কিলোমিটারে প্রকাশ করতে পারে না। তবে আমার পকেটে একটা জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম-উপগ্রহের সিগন্যাল ব্যবহার করে অবস্থান বের করার একটি যন্ত্র ছিলো।) সেটার হিসাব অনুযায়ী ঠিক সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটার পর পুলিশ আমাদের থামিয়ে দিলো। মিছিলটি পুলিশের বেষ্টনী ভেঙে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল না, কাছাকাছি একটা স্কুলের মাঠে একত্র হয়ে মুহুর্মুহু স্লোগানের মাঝে তাদের ঘোষণাপত্র পাঠ করলো। আমি খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার ফিরে আসতে শুরু করলাম। অন্যরা আট দিনে হেটেছে তিনশ কিলোমিটার। আমরা একদিনে হেটেছি মাত্র এগারো কিলোমিটার। কিন্তৃ তাতে আমার মনে হতে লাগল আমরা বুঝি বিশাল একটা কাজ করে ফেলেছি।
২.
ঘরকনো মানুষ বলে একরকম দক্ষযজ্ঞ মানুষ থেকে আমি দূরে থাকি, তবে গ্যাস রপ্তানীর ব্যপারটি এই দেশের জন্য এমন ভয়ংকর একটি ষড়যন্ত্র যে এখন আর ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই। আমার ধারণা সরকার যদি এটি বন্ধ না করে তাহলে আগে হোক পরে হোক সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে। ব্যক্তিগতভাবে লংমার্চের শেষ অংশটুকুতে থাকতে পারা আমার জন্য খুব চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা ছিলো।
আমাদের দেশের সংবাদপত্র পড়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা থেকে আমি বলতে পারি সংবাদপত্রের খবর হিসেবে এই লংমার্চটুকু অত্যন্ত একটা চমৎকার বিষয় ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার এই পুরো ব্যাপারটি নিয়ে সংবাদপত্রগুলো ছিল একেবারেই নিস্পৃহ। কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ সেই রঙিন এবং উদ্দীপ্ত তারুণ্যের মিছিলের ছবিটি বেশিরভাগ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়নি। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না ডেইলি স্টারের মতো সম্ভান্ত একটি পত্রিকা এই ঘটনার সংবাদটুকুও ছাপেনি।
ব্যাপারটি আমায় খুব ভাবনায় ফেলেছে। সংবাদপত্রের কর্মচারী এবং সাংবাতিকরা নিশ্চয়ই আমার মতো সাধারণ মানুষ, কিন্তু সংবাদপত্রের মালিকরা নিশ্চয়ই বিত্তশালী মানুষ। সাধারণ মানুষ আর বিত্তশালী মানুষের স্বার্থ নিশ্চয়ই এক নয়। আমি নিশ্চিত বিবিয়ানা লংমার্চের এই বিশাল জাতীয় একটি ঘটনাকে বাংলাদেশের মানুষের চোখের আড়ালে সরিয়ে রাখার ব্যাপারটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়- এর নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। যারা খবরের কাগজের মালিক, বিশাল যাদের অর্থবিত্ত, কোনো না কোনোভাবে নিশ্চয়ই এই গ্যাস বিক্রির ব্যাপারটির সঙ্গে, এ সম্পর্কে দেশের মানুষের সচেতনতার সঙ্গে তাদের একটা সম্পর্ক আছে। কাজেই ভবিষ্যতেও নিশ্চয়ই গ্যাস রপ্তানীর ব্যাপারে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের কথা সম্ভবত সংবাদমাধ্যমগুলোতে সেভাবে প্রচার করা হবে না। যারা গ্যাস রক্ষার জন্য পথে নামবেন, তাদের সম্ভবত একটা দুরুহ পথ অতিক্রম করতে হবে, সেই পথে সংবাদপত্রের সাহায্য তারা তেমন পাবে না। জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী সম্ভবত সেটি আগে থেকেই জানেন, পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাই বুঝি এত তাচ্ছিল্য।
৩.
বিবিয়ানা লংমার্চে যোগ দিয়ে আরো কয়েকটি ব্যাপার নিয়ে আমি এক ধরনের নস্টালজিয়া অনুভব করেছি। আমাদের চারপাশে ছাত্র রাজনীতির কলুষিত রূপটি দেখে আমাদের সবার মন বিষিয়ে গেছে। ছাত্ররা যখন তাদের তারুণ্যের শক্তি ব্যয় করে কেন্টিনে ফাও খাওয়ার জন্য, বিকশাওয়ালার থেকে চাদা তোলার জন্য বা ছিনতাই করা ভাগাভাগি করতে মারামারি করার জন্য তখন লজ্জায় আমাদের মাথা হেট হয়ে যায়। কিন্তু এই লংমার্চে এসে আমি অসংখ্য তরুণ তরুণিকে দেখেছি যারা নিশ্চয়ই এই দেশে নানা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। দেশের সম্পদ রক্ষার করার জন্য নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে শক্তি পেয়ে তারা তিনশ কিলোমিটার হেটে চলে এসেছে। আদর্শের পথ ধরে চলে আসার সুশৃংখল একটি দল। আমাদের ছাত্রজীবনে আমরা যেরকমটি দেখেছিলাম। সেটি দেখে আমি এক ধরনের নস্টালজিয়া বোধ করেছি। দেশের পড়াশুনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য আমি অনেকবার ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছি। কিন্তু লংমার্চে এসে আত্মত্যাগী, পরিশ্রমী, সুশৃংখল দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থাকা এই ছাত্রছাত্রীদের দেখে মনে হয়েছে আমরা কি আবার ষাট এবং সত্তরের দশকের আদর্শবান তেজস্বী ছাত্রছাত্রীদের ফিরে পেতে পারি না।